পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান
Tweet
কোন উপায় নেই, সমাধান নেই। ভাববারও সময় নেই। এখনই পথে নামতে হবে, সঙ্গীদেরকে ধরতে হবে। কত দ্রুত নামলে, চূড়া থেকে গোড়ায় দেখতে পাবো? তার চেয়েও দ্রুত নামতে তৎপর হলাম আমরা। উঠতে আমার মন চায়, নামতে আমার প্রাণ যায়। অনেকটা গড়িয়ে পড়ার মতই নামছি আমরা দু’জনে।
নির্জন দূর্গম পাহাড়ী
পথ, সারি সারি পাইন বন, ঝিরি ঝিরি পাতায় বাতাসের গুঞ্জরন যেন মুমূর্ষ মানুষের বাঁচার
আর্তনাদ। উঠবার সময়ে রেখে যাওয়া কুকুরগুলো নামবার সময়ে তেড়ে এসেছিল হো হো করে। আমাদের
হাতে লাঠি। কিন্তু লাঠি তুলে ভয় দেখানোর সাহসটুকুও নেই দুজনের কারো। ফ্যাল ফ্যাল
করে চেয়ে থাকলাম ওদের দিকে। আমাদের অসহায়ত্ব দেখে ওরাও তখন তাকিয়েছিল পলকহীন
দৃষ্টিতে। যেন বুঝেছিল বিপদে আছি আমরা। পথে কোন এক সময়, দেখা হলো চারজনের একটি
পরিবারের সাথে। পরিচয়ও হলো। তাদের পূর্ব পুরুষের বাস ছিল নোয়াখালী, ১৯৪৭ সালের
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পিতা নোয়াখালী ছেড়ে কলিকাতায় পাড়ি জমান। এখন তারা হাওড়াবাসী।
অনেক দূরের মানুষ তারা।
তবুও মনে হয় অতি আপনজন। তাদেরকে পাওয়ার আনন্দ ছিল চৈত্রের দুপুরে মরুভূমিতে পাওয়া
একফোঁটা জলের মতো। যেহেতু আমরা দলছুট, তাই অনুমতি সাপেক্ষে তাদের রেখে আমরা নামতে
থাকলাম দ্রুত। পাহাড়ের পাদদেশে তখন সন্ধ্যার শেষ হয়ে শুরু হলো রাত্রীর। কৃঞ্চপক্ষ
রাত্রী।
জোসনা উঠতেও বহু দেরী।
ওঠার সময়ে দেখে যাওয়া ভাসমান সে দোকান গুলো নেই, পাকিংলটে পার্ক করা গাড়িগুলো নেই,
সঙ্গীরা নেই, কোন মানুষের গন্ধ নেই। আছে শুধু বেওয়ারিশ লোমখাড়া স্বাস্থ্যবান কুকুরের
দল। একদল অপরদলকে ধরতে ছুটছে। হয়তো খেলতে নয়তোবা আক্রমন করতে। হাউমাউ আর ঘাউ ঘাউ।
ঝড়ো বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে
কয়েক গুন। কিছুটা হাঁটতেই পেলাম একটি প্রাইভেট কার। আশার সঞ্চার হলো মনে। কিন্তু
না, এসে গেল হাওড়ার পরিবারটি। তাদেরই অপেক্ষায় ছিলো গাড়িটি। অতিরিক্ত জায়গার সংকুলান
না থাকায় আমাদের অনুমতি সাপেক্ষে চলে গেলো তারা। যতক্ষণ দেখা গেলো ব্যাক লাইটের
আলো, ততক্ষণ চেয়ে রইলাম আমরা তার পানে।
পাহাড়ের উপরেই গলা
শুকিয়েছিল, তাই নতুন করে শুকানোর কিছু নেই আর। এবং সেখানে অপেক্ষা করারও সুযোগ আর
নেই। এতক্ষন যে আমরা সেখানে রয়েছি, কুকুর গুলো বোধ হয় বুঝতে পারেনি। হয়তো তাই
দুর্ঘটনাও ঘটেনি কোন। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব অনিরাপদ ঐ এলাকা ত্যাগ করতে হবে
আমাদের। তাই আঁধার রাতে লক্ষহীন পথে চললাম দুজনে।
গহীন বনে, নির্জনে
নিঃশব্দে আস্তে আস্তে ধীর পথ চলা। ভয় আর শংকায় বিবর্ণ চোখমুখ। অনেক্ষণ পরে মামুন
ভাইকে বললাম, ভাইয়া ভ্রমণের বর্ণনায়, কোনভাবেই দল ত্যাগ না করার কথা পরিষ্কার ভাবে
উল্লেখ করা ছিল। সুতরাং ভুলতো আমাদেরই।
মামুন ভাই বাঘের গর্জনে
ধমক দিয়ে বসলেন। বললেন, দল ত্যাগ করলাম কোথায় মিয়া? তারা তো আমাদের সাথে পাহাড়ে
উঠেছে, চুড়ায় পৌঁছাতে পারেনি, সে ব্যর্থতা তাদের। আর চূড়ায় চড়তে আমাদের কেউ নিষেধ
করেনি। তাছাড়া গ্রুপ গাইড আছে। সে তো আমাদের জঙ্গলে ফেলে যেতে পারে না, যদি আমরা
ভুল করেও থাকি।
এবার গেল আমার বাকশক্তি।
না চেনা, না জানা পথে, অজানা উদ্দেশ্যে ছোট ছোট ধাপে আমাদের পথ চলা। পাশ দিয়ে যতবার
কুকুরের দল খোঁত খোঁত করতে করতে চলে যায়, প্রতিবারই মনে হয় মৃত্যর হাত থেকে বেঁচে
গেলাম আমরা এযাত্রা। শরীর ভার, মন ভার, নিজের পা আরো ভার। নিজেকে অনেক কষ্টে টেনে
তুলে নামাতে হয় আবার।
কত সৌন্দর্য, কত আনন্দ,
কত বিনোদন, কোন কিছুই ভাবনায় নেই আর। মনে পড়ছে শুধু আপনজনদের কথা। সত্যি যদি
মৃত্যুর মত ঘটনা দিয়ে এই ভ্রমন শেষ হয় তাহলে কি তারা জানবে সে মৃত্যুর রহস্য? আমার
প্রেতাত্মা কি তাদের বুঝাতে পারবে অতি উৎসাহ আর বোকামিতে ভরা আমার এই আচরণ!!
একজন আরেকজনের হাত শক্ত
করে ধরে আছি যেন যমদূত ছাড়া কেউ ছুটাতে না পারে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে পৌছে গেলাম
তিন মাথার মোড়। সেখানে থেকে চোখে পরে দূরে জ্বলে থাকা ল্যাম্প পোষ্টের আলো। কিন্তু
আলোর দেখা মিললেও মনের মাঝে অন্ধকার ঘনিভূত হলো আরও। কারন রাস্তা সামনে তিনটি।
কোনটিতে চলবো? কারও ফোন নম্বর নেই, পারো হোটেলের ঠিকানা নেই, কোন মানুষ নেই,
রাস্তায় নির্দেশক নেই, কোথায় আমাদের গন্তব্য?
এ আমাদের কোন পাপের
শাস্তি! মনের মাঝে প্রশ্ন এখন একটাই। হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার মনে হয় আকাশ থেকে পড়লো যেন! গাড়ির
ড্রাইভার ধমকের স্বরে জিজ্ঞাস করলো, Who
are you? Why are you standing here?
মামুন ভাইকে সরিয়ে দিয়ে সামনে
গেলাম আমি। তার চেয়েও জোরেসোরে বললাম, অপরাধ যদি থাকে জেলে ভরো। কিন্তু এখান থেকে
আগে সরাও।
একহাতে মামুন ভাইয়ের হাত,
আরেক হাতে খুললাম গাড়ির দরজা। খুলতে দেরি, ঢুকতে দেরি নাই। হুরমুড়িয়ে ঢুকে বসে
পড়েছি। কিন্তু গাড়ির সিট নয় মেয়ে মানুষের কোলে। শুরু হলো হৈ চৈ! শত শত কুত্তার চেঁচামেচির
চেয়ে মাত্র ক’জন মানুষের চেঁচামেচিতে জঙ্গল যেন আবার প্রাণ ফিরে পেলো!
ইংলিশ, বাংলা, হিন্দি,
ভূটানী, না জানি আরও কত ভাষাতে প্রলাপ বকতে থাকলেন মহিলা। তা বুঝারও চেষ্টা করিনি।
শুধু প্রস্তুতি নিচ্ছি, মারলে মারুক। কিন্তু গাড়ি থেকে নামবো না। বুঝতে একটু সময় বেশি
লাগলেও দেখলাম ড্রাইভার কিংগা, গাইড সোহেল ভাই আর মহিলা কিংগার গার্লফেন্ড।
মামুন ভাই তার হাতের
ক্যামেরা দিয়ে সোহেল ভাইকে আচ্ছা এক বাড়ি লাগালো। আমার মাথায় আরেকটা দিবে, ততক্ষনে
বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো কিংগার গার্লফ্রেন্ড। মারামারি আর হলো না। হলো না কোন কথাও। সাই
সাই করে চলতে থাকলো গাড়ি।
রাতের পারো শহর কতই না সুন্দর! অল্প দূরে দূরে ল্যাম্পপোষ্ট শুধু আলো আর আলো। নেই কোন মানুষের পদচারণা। মাথা ধরে, চোখ খুলে দেখলাম রাতের পারো শহর। হোটেলে এসে মনে হলো নতুন জীবন পেলাম।
২ thoughts on “পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান”
-
Pingback: পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান | পর্যটনিয়া
-
Pingback: পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান | পর্যটনিয়া
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.