পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকারের ভূমিকাটাই মুখ্য আর বেসরকারি খাতের ভূমিকাটা গৌণ
Tweet
পর্যটনের বর্তমান চালচিত্র ও সম্ভাবনা নিয়ে জনাব জামিউল আহমেদের সাথে পর্যটনিয়ার সম্পাদক আবু রায়হান সুমনের কথোপকথনের আজ দ্বিতীয় পর্ব
পর্যটনিয়া: বাংলাদেশের পর্যটনে তখনকার দিন আর আজকের দিনের মধ্যে পরিবর্তন কতোখানি?
জামিউল: প্রায় চল্লিশ বছর আগে যখন পর্যটনে সম্পৃক্ত হলাম তখন অনেকেই পাগল বলেছে। কিন্তু আজকে যারা পর্যটনে ক্যারিয়ার শুরু করে তাদেরকে কেউ আর পাগল বলে না। এই পরিবর্তনটা বলার মতো একটা পরিবর্তন। এর সুফল এখন নতুন প্রজন্ম পাচ্ছে। আজকে সারা বাংলাদেশে মানসম্পন্ন অনেক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউজ, আধুনিক রেস্তোরা ইত্যাদি হয়েছে, নতুন আরও হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের বিনোদন পার্কের পাশাপাশি পরিবহণ খাতেরও উন্নয়ন হয়েছে। পরিবহণ খাতের উন্নয়নে তো বলা যায় রীতিমতো বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। আধুনিক সব ধরনের যানবাহন আমাদের আছে। সড়কপথ, রেলপথ, নৌপথের পাশাপাশি আকাশপথেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। মানুষ একটু সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও যেতে পারছে, সেখানে থাকতে পারছে, খেতে পারছে, বিনোদনের সুযোগ পাচ্ছে; এগুলো অবশ্যই পর্যটন খাতের একটা উন্নয়ন। তবে, পর্যটনের উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতকেই এগিয়ে আসতে হবে। অবশ্য এটা স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে বেসরকারি খাত পর্যটনে যতটা ভুমিকা রাখতে পেরেছে সরকারি খাত সেই তুলনায় ততদূর এগিয়ে আসতে পারেনি।
পর্যটনিয়া: পর্যটন উন্নয়নে সরকার কী ভূমিকা রাখতে পারে?
জামিউলঃ কোনো দেশের পর্যটন উন্নয়নের জন্য বেসরকারি খাতের যেমন গুরুত্ব আছে তেমনি সরকারী খাতেরও গুরুত্ব আছে। কেউ কাউকে বাদ দিয়ে পর্যটন উন্নয়ন করতে পারবে না সেটা সম্ভবও না। বিভিন্ন ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে বেসরকারি খাত যেমনি পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তুলবে তেমনি সরকারী খাতও বিভিন্ন ধরনের সাধারন অবকাঠামো যেমনঃ রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, পয়ঃনিষ্কাসন, নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি সাপোর্ট সার্ভিস নিশ্চিত করবে। তাই পৃথিবীর যেকোনো দেশেরই পর্যটন উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা অনেকটা অভিবাবকের মতো। গার্ডিয়ানশিপটা সরকারের হাতেই থাকবে।
পর্যটনিয়া: ব্যবসাটা কি সরকারি খাতই করবে নাকি বেসরকারি খাত করবে?
জামিউল: বেসরকারি খাত ব্যবসা করবে আর সরকার সেই ব্যবসা করার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ তৈরী করে দেবে। সরকার তো আর ব্যবসা করবে না, ব্যবসা করবে বেসরকারি খাত। তবে যেসব ডেস্টিনেশনে পর্যটন সেবা অপ্রতুল সেসব স্থানে সরকার ব্যবসায় অংশগ্রহণ করবে। মোটকথা হলো, সরকার জেনারেল ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরী করে দিবে আর ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার বেসরকারি উদ্যোক্তারা নিজেরাই করবে তাদের ব্যবসার প্রয়োজনে। এভাবে সরকারি আর বেসরকারি খাতের সমন্বয়ের মাধ্যমেই পর্যটন এগিয়ে যাবে। তবে,পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের ভূমিকাটাই মুখ্য আর বেসরকারি খাতের ভূমিকাটা গৌণ।
পর্যটনিয়া: বাংলাদেশে পর্যটন কি একটা শিল্প?
জামিউলঃ বাংলাদেশ সরকার পর্যটনকে অনেক আগেই শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং পর্যটন বাংলাদেশে একটা শিল্পই। কিন্তু কথা হলো, একটা খাতকে শুধু শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বসে থাকলেই হবে না, দরকার প্রয়োজনীয় শিল্প সহায়ক সুবিধাদি নিশ্চিত করা। তাই আমি মনে করি, পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারের আরও অনেক বেশি সুনজর দেয়া দরকার।
পর্যটনিয়া: কী রকম?
জামিউলঃ কোনো একটা দেশ যখন পর্যটনে সফলতা অর্জন করে তখন শুধু সরকারই নয় অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদেরও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। তাই পর্যটনকে অন্যান্য শিল্পের চেয়ে আলাদাভাবে দেখতে হবে। কেন না পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে এমন অনেককিছু পরিবর্তন আসতে পারে যা শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠীই নয় গোটা জাতির জীবনে নানা ঋনাত্নক প্রভাব ফেলতে পারে, যা কাম্য নয়।
পর্যটনিয়াঃ ‘ ঋণাত্নক প্রভাব বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?
জামিউলঃ ঋণাত্নক প্রভাব বলতে এটিই বুঝানো হয়ে থাকে যে, ধরা যাক কোনো একটা দেশ হঠাৎ পর্যটনে অনেকটা উন্নত অবস্থায় পৌঁছে গেলো। এই অবস্থাটা দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একঃ যদি কোন দেশে বিদেশি ট্যুরিস্ট অধিক সংখ্যক আসা শুরু করে তাহলে এই অতিরিক্ত বিদেশি পর্যটকের চাপে নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকে। কেন না এতেকরে নানা রকম অপকর্ম আর অপসংস্কৃতি চালু হতে পারে, নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার বেড়ে যেতে পারে, যৌনতা ছড়িয়ে যেতে পারে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। তাছাড়া পানি-বিদ্যুত-গ্যাস ইত্যাদি সেবা সার্ভিসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। দুইঃ প্রত্যেকটা ডেসটিনেশনের একটা নির্দিষ্ট ট্যুরিস্ট কেরিং ক্যাপাসিটি (টিসিসি) থাকে। ক্যাপাসিটির বেশী পর্যটক আসলে সেই ট্যুরিস্ট স্পট চিরতরে ধ্বংস হতে পারে। মনে রাখতে হবে, শুধু বিদেশি পর্যটকই নয় আভ্যন্তরীন পর্যটকও একটা ট্যুরিস্ট স্পট ধ্বংস করতে পারে। আভ্যন্তরীন পর্যটক হয়তো সেদেশের সংস্কৃতিগত দিক থেকে কোনো হুমকি নয় কিন্তু গণপর্যটনের প্রভাবে আরো অনেক কিছুই হুমকির মধ্যে পড়তে পারে এমনকি ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে।
পর্যটনিয়াঃ যেমন?
জামিউলঃ উদাহরণ হিসেবে আমরা আমাদের দেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের কথা বলতে পারি। সেন্টমার্টিন একটি প্রবাল দ্বীপ। এই দ্বীপটাকে রক্ষা করতে হলে সেখানে পর্যটকের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা নাহলে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটকের বেশি পর্যটক গেলে এই দ্বীপ হুমকির মুখে পড়বে। সাধারণ দৃষ্টিতে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ কথাটা খারাপ শোনা যায় কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। নিয়ন্ত্রণহীন মাত্রায় পর্যটক সেখানে গেলে তারা যত্রতত্র চলাফেরা করবে, নিয়ম না মেনে ঘোরাঘুরি করবে, রাত্রি যাপন করবে, খাবার খাবে, নানা রকম কর্মকাণ্ড করবে ফলে সেখানে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় জমবে। তাই এই অতিরিক্ত লোকজনের চাপ এবং ময়লা-আবর্জনা দিনশেষে পরিবেশের উপর একটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবেই।