ভ্রমণপিয়াসীর অপেক্ষায় থাকে নিথর জলের লেক মহামায়া
Tweet
মনে হচ্ছিলো যেন কেটে গেছে কয়েকশ’ বছর, অথচ যাওয়া হয়নি আমাদের কোথাও। নদী, মাটি, বাতাসে ভেসে ভেসে প্রকৃতির কোলে ডুবে যাওয়ার জন্য আঁইঢাই করছিলো সবার প্রাণ। হুট করেই একদিন জুনিয়র কয়েকজন ভাই তুললো ঘুরতে যাওয়ার কথা। সাত্থে সাথে একপায়ে খাড়া হয়ে গেলাম যাওয়ার জন্য আমরা। তারপর স্বাভাবিকভাবেই, চিরচিরায়ত নিয়ম অনুযায়ী কোথায় যাওয়া যায় কিংবা কিভাবে যাওয়া যাবে ইত্যাদি সব প্ল্যানের ভার পড়লো বর্ণা, শাহাদাৎ আর মিঠুর ওপর। আর আমি হচ্ছি দুধভাত। যখনই সময়-সুযোগ পাচ্ছি, জয়েন করবার চেষ্টা করছি কাজকর্মে। ঘুরতে যাওয়াতেও যে আছে একগাদা সীমাবদ্ধতা। ব্যস্ততার দরুন সবারই প্রথম সমস্যা সময় নিয়ে। যেখানেই যাওয়া হোক না কেন, সময়সীমা সারাদিনই কেবল। কিছুদিন ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত হলো ৯ ডিসেম্বর যাওয়া হবে সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সী-বীচে। আর পথিমধ্যে ঢু মারা হবে মীরসরাইয়ের মহামায়া লেক, ইকোপার্কেও।
৯ ডিসেম্বরের ট্যুরের উত্তেজনায় ১২-১৫ দিন আগে থেকেই ফেসবুকে একটা গ্রুপচ্যাট খুলে শুরু হয়ে গেলো আমাদের আড্ডা। ট্যুর প্লানিংয়ের নামে দেখাও করতে শুরু করলাম আমরা প্রায় প্রতি বিকেল কিংবা সন্ধ্যায়। সেখানেও ২-৩ ঘন্টার মিটিংয়ে ট্যুরের প্ল্যানের বদলে জমিয়ে আড্ডা হতে লাগলো সবার। যেকোনো কাজের ভেতরেও আড্ডা দেবার জন্য বর্ণা, শাহাদাৎ, মিঠু আর আমিতো এক্সপার্ট আছি আগে থেকেই, এবারে দেখা গেলো জুনিয়র পাভেল আর রায়হানও এই কাজে বেশ সিদ্ধহস্ত! আড্ডা দেবার ফাঁকে ফাঁকেই অবশ্য কিছু কাজও করেছি আমরা। গাড়ি ঠিক করা, টুকটাক কেনাকাটাও সারা হয়ে গেলো নির্দিষ্ট দিনের আগেই।
এভাবে করে প্রস্তুতি নিতে নিতেই অবশেষে এলো মহা আকাঙ্খিত সেই দিন। প্ল্যান অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৬টায় রওয়ানা হবার কথা থাকলেও রওয়ানা হতে হতে বেজে গেলো প্রায় সোয়া ৭টা। গাড়িতে যাত্রী আমরা ১১জন বড় বাচ্চা আর ৩ বছরের ১ বাচ্চা। আর আছে ড্রাইভার ভাই। তাকে শুরুতেই বলে নেয়া হয়েছে যে প্রচুর হৈ-হুল্লোর হবে যাত্রাপথে। তাই কানে তুলো গুঁজে নিতে হবে তাকে। হৈ-হুল্লোর হলোও যে তেমনই।
সাধারণত দেখা যায়, কোথাও গেলে দুষ্টুমি করে বেড়ায় ছোটরা আর তুলনামূলক বড়রা থাকে একটু গম্ভীর। কিন্তু আমাদের গুলিয়াখালী ট্যুরে ঘটলো ঠিক উল্টোটা। একজনের সাথে স্ত্রী আর অন্যজনের সাথে বান্ধবী থাকার কারনেই কিনা কে জানে জুনিয়র দু’জনই ঘুরলো শান্ত হয়ে! আর দিনের শুরু থেকেই আমরা তথাকথিত বড়রা রূপান্তরিত হলাম বাচ্চাতে।
সকাল সোয়া ৮টার দিকে সোনারগাঁওয়ের এক পেট্রোল পাম্পে পৌঁছে তবে থামলো আমাদের গাড়ি সকালের নাস্তার জন্য। গাড়িরওতো নাস্তা দরকার। ৩০ মিনিটের চা-নাস্তার বিরতি শেষে যাত্রা শুরু হলো আবার। রসমালাইয়ের লোভে এবারের স্টপেজ কুমিল্লা শহরের মাঝখানের, আসল মাতৃভান্ডার। ঢাকা ছাড়বার আগে শীতের সকালের আমেজ নিতে গাড়িতে হালকা রোমান্টিক মুডের গান চললেও এবারে শুরু হলো আসল ফূর্তির আমেজ। যেতে যেতে বড় বাচ্চাদের একটানা গল্প, আড্ডা, গান আর হৈ-হুল্লোড়ের তোড়ে দু’দফা ভেঙে গেলো পিচ্চি আহানের ঘুম।
কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় মোড়ের আসল মাতৃভান্ডারের রসমালাই আর চা-চিপস সাথে নিয়ে আবার শুরু হলো যাত্রা। এবারে মীরসরাইয়ের মহামায়া লেকের আগে আর থামাথামি নেই কোথাও। তাই বলেতো আর থেমে নেই আমাদের আনন্দ! প্রিয় সব বন্ধুর সঙ্গ আর পথের দু’পাশের মনোমুগ্ধকর গাঢ় সবুজ দৃশ্য। আর কি লাগে তখন! মাঝেমাঝেই যদিও শুকনো ধূলোর ঝড় ওঠে রাস্তায়। তবু সবুজ প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্যকে ম্লান করতে পারেনা ধূলোর সে ঝড় একরত্তিও। গন্তব্যের চাইতে এই পথ চলাই যে টেনেছে আমাকে চিরকাল! অজান্তেই গুণগুনিয়ে উঠি,
‘এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হতো…’
কেমন হতো যদি ছুটতে থাকা যেতো এমনই করে আজীবন? বাউন্ডুলে সব জীবনদর্শন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
দেখতে দেখতে সকাল ফুড়িয়ে প্রায় দুপুর। আর কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী ছাড়িয়ে চলে এলো চট্টগ্রাম। বেলা ১১টা ৪০মিনিটে পৌঁছালাম আমরা মীরসরাইয়ের মহামায়া ইকোপার্কে। জনপ্রতি ২০ টাকা করে টিকেট আর কেটে ঢুকলাম আমরা এগারো জন। ওহ, বারোজনতো। আহান বাবুওতো আছে। দলের সবচাইতে শান্ত বাচ্চা যে সে-ই ছিলো। তার তুলনায় বাকি সবই যে আমরা দস্যি!
যখন আমরা পার্কে ঢুকলাম, পুরো পার্ক ছিলো তখন নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়ানো। মানুষ ছিলো অল্প কিছু। যারা জাগাতে চায়নি ঘুমন্ত এই প্রকৃতিকে। নিস্তব্ধতার সেই চাদর ফুড়ে উল্লাসে ছুটোছুটি করতে শুরু করলাম আমরা দঙ্গল ক’জনে। নিস্তব্ধ প্রকৃতিও ভালোবেসে জায়গা করে দিলো আমাদের উল্লাসের জন্য।
মাথার উপরে ঝাউবনের ঘন ছায়া, হরেকরকম গাছের বাহার, ছোট ছোট সাদামাটির টিলা আর বাঁধাই করা খাড়া পথ। মাঝে মাঝে আছে বসার জন্য বাঁধাই করা বেঞ্চ। খানিকটা এগুতেই একদিকে বিশাল লেক মহামায়ার। আর অন্যদিকে খাড়া টিলা। টিলার ওপাশে গভীর খাদ। টিলার ওপর থেকে লেকের দিকে তাকালেই হলো! সম্মোহন করে দেয় প্রকৃতি তার নিস্তব্ধতায়। নামের মতোই মায়ার মোহনজালে বেঁধে ফেলে সে পথিকের নজর।
নিথর জলের মহামায়া লেকে ঘুরে বেড়াবার জন্য বোট আছে। আর এডভেঞ্চারপ্রিয়দের জন্য আছে কায়াকিংয়ের সুযোগ। বিশাল অথচ নিথর জলের বুকে ভেসে বেড়াবার এই আনন্দ আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই তা। মহামায়ার মায়াবী দীঘি ভ্রমণপিয়াসীর অপেক্ষায় গুণে প্রহর।
এদিকে মহামায়ার মায়াজাল কাটিয়ে এগুতে হবে যে গুলিয়াখালীর দিকেও…
One thought on “ভ্রমণপিয়াসীর অপেক্ষায় থাকে নিথর জলের লেক মহামায়া”
-
Pingback: আমাদের শত হুল্লোড়েও ভাঙলোনা গুলিয়াখালীর নিস্তব্ধতা | পর্যটনিয়া
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.