চলুন কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়
Tweet
জীবনে কখনো ভাবিনি কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় উঠতে পারব। গত ডিসেম্বর মাস থেকে কেওক্রাডংয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করি। সেই স্বপ্ন সত্যি করেছি এবারের বাংলা নববর্ষে। আমি অবাক এবং আমাকে যারা চেনে, সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও অবাক।
অবাক হবেই বা না কেন! আমার ওজন প্রায় দুই মণ। আছে বিশাল এক ভুঁড়ি। আর সামান্য হাঁটার ক্ষেত্রে চরম অলস আমি। বয়স ৩০-এর চেয়ে বেশি। সেই আমি প্রচণ্ড গরমে বগা লেক থেকে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে হেঁটে হেঁটে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় উঠতে পেরেছি। তার মানে আপনিও পারবেন কেওক্রাডং জয় করতে। এর জন্য প্রয়োজন শুধু একটিই জিনিস। তা হলো প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি।
এবার আসি কেওক্রাডংয়ের গল্পে। মার্চ মাস থেকে কেওক্রাডংয়ে যাওয়ার জন্য মাথাব্যথা শুরু হয়। কীভাবে যাই, কাদের সঙ্গে যাই? ফেসবুকে কেওক্রাডং লিখে সার্চ দিই।
এপ্রিল মাসে তিনটি ভ্রমণ দলের ইভেন্ট পাই। এর মধ্যে ট্যুর অ্যারাউন্ড বাংলাদেশ (টিএবি-ট্যাব) ভ্রমণ দলের ইভেন্ট ডিটেইলস পছন্দ হয়। খরচ ছিল সাধ্যের মধ্যে। এক রাত অপরূপ বগা লেকে থাকবে, আরেক রাত থাকবে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়।
ইভেন্ট কনফার্ম করার পর টুকটাক কিছু জিনিস কিনে ফেলি। এই যেমন : অ্যাংলেট, নি-ক্যাপ, ম্যাঙ্গো বার, ওরস্যালাইন, টর্চলাইট ইত্যাদি। অবশেষে ১২ এপ্রিল বুধবার রাতের বাসে করে আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত যাত্রা শুরু হয়। পুরো বাসটিই ছিল রিজার্ভ করা। আমরা ছিলাম ৩৬ জন।
বাসে আমার পাশেই বসেন সাংবাদিক হাসানুল বান্না ভাই। একই পেশার সহযাত্রী হওয়ায় তাঁর সঙ্গে গল্প চলতে থাকে। তবে বাদ যায়নি অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তাও। আয়োজক আল আমিন গাজী, জিম আহসান ও আবুতালেব ইসলাম শিশিরসহ অন্য যাত্রীরাও ছিলেন বেশ আমুদে ও অমায়িক। হাসতে হাসতে, গান গাইতে গাইতে বাসে সময় কাটছিল দ্রুত।
বৃহস্পতিবার সকালে বান্দরবান শহরে এসে পৌঁছায় বাস। তাজিংডং ক্যাফেতে করি সকালের নাশতা। এরপর মিনি বাসে করে রওনা দিই রুমা বাজারের উদ্দেশে।
কয়েকজন উঠলেন বাসের ছাদে। আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ ধরে চলছিল বাস। আমি দু চোখ ভরে দেখছিলাম পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য। এক মাস ধরে চলা মাথাব্যথাটা কমছিল আস্তে আস্তে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর পৌঁছাই রুমা বাজারে। সেখানে নামার পরপর আমাদের দুজন গাইড ধরিয়ে দিলেন স্থানীয় সেনাক্যাম্পের তথ্য ফরম। সেখানে একে একে সবাই লিখলাম নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর। এরপর হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই রুমা বাজারে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের টিলায় অবস্থিত সেনাক্যাম্পে।
সেখানে সবাই নাম সই করে উঠি চাঁদের গাড়িতে। আমাদের জন্য তিনটি গাড়ি ঠিক করা ছিল। কিছু দূর গিয়ে গাড়িগুলো থামে রুমা থানায়। সেখানে আবার সবার নাম, ঠিকানা লিখে সই করতে হয়। এরপর শুরু হয় ছুটে চলা।
কিছুদূর পর গিয়ে দেখি পাহাড় কেটে রাস্তা প্রশস্ত করার কাজ চলছে। দুই লেনের রাস্তা চলে যাবে একেবারে বগা লেক। দুই ঘণ্টা পর আমাদের গাড়ি পৌঁছায় বগা লেকের কমলাবাজার এলাকায়। সেখান থেকে পাহাড় বেয়ে ওঠার জন্য আয়োজকরা সবাইকে একটি করে চিকন বাঁশ কিনে দেন। এরপর শুরু হয় বগা লেকের চরম খাড়া পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার সবচেয়ে কঠিন পথ। কিছুক্ষণ ওপরে উঠেই হাঁপিয়ে পড়ি। এক হাজারের বেশি ফুট উচ্চতার পাহাড় দেখে ভাবছিলাম, এই পাহাড়ে কি এই জীবনে উঠতে পারব! পাশ থেকে একজন বলেই ফেললেন তিনি আর কাল সকালে কেওক্রাডং যাবেন না। কালকেও বগা লেক থাকবেন। টিএবির অ্যাডমিন জিম আহসান বলে উঠলেন, ‘নাক দিয়ে শ্বাস নেন, মুখ দিয়ে ছাড়েন। তাহলে কম হাঁপাবেন।’ পদ্ধতিটা কাজে দেয়।
দু-তিনবার যাত্রাবিরতি নিয়ে বগা লেকের পাহাড়ে যখন উঠি, তখন মনে হয় আমার চেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী আর কেউ ছিলেন না। কারণ দুটি। এক. উঁচু পাহাড়ে ওঠা।
দুই. পাহাড়ের মাঝে অপরূপ প্রাকৃতিক এক লেক দেখা। সাধারণ কারো কাছে মনে হতে পারে, এত কষ্ট করে কেউ পাহাড়ি পুকুর দেখতে আসে!
কিন্তু যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে, প্রকৃতিকে ভালোবাসে, স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টিকে দেখে তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় যাদের মন ভরে ওঠে তাদের কাছে বগা লেক সত্যিই বিস্ময়। বগা লেক গিয়ে আবারও সই করতে হয় সবাইকে, সেখানকার সেনাক্যাম্পে।
সই পর্ব শেষে চলে যাই আমাদের জন্য নির্ধারিত জিমোলিয়ানের কটেজে। আমাদের কটেজটি ছিল বগা লেকের একদম পাশে। জানালা খুললেই বগা লেক। বিশাল বারান্দা।
আমরা দ্রুত ব্যাগট্যাগ রেখে ছুটে যাই লেকের স্বচ্ছ, শীতল পানিতে গোসল করতে। আগে থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল যে আমরা কেউ লেকে সাঁতার কাটতে পারব না। গোসল করতে হবে তীরের খুব কাছাকাছি। লেকের পানিতে গোসল ছিল আমার জীবনের সেরা গোসল। গা ভেজাতেই ছোট ছোট মাছের ঝাঁক আসে পিঠের ওপর। বিনে পয়সা মিলছিল ফিশ স্পা!
গোসল শেষে জিমোলিয়ানের কটেজেই সারি দুপুরের খাবার। অনেকগুলো পদের মধ্যে পাহাড়ি মিষ্টিকুমড়ার তরকারি আর ছোট ছোট আমের আচারের স্বাদ ছিল অসাধারণ। ভরপেট খেয়ে অনেকে কটেজে শুয়ে পড়েন। আমারও চরম ভাতঘুম পায়। কিন্তু রোয়ান অ্যাটকিনসনের ‘মিস্টার বিনস হলিডে’ সিনেমার মিস্টার বিনের মতো ঘুম আটকে রাখি। নিজের মনকে বলি, এখানে তো ঘুমাতে আসিনি, এসেছি ঘুরতে, পাহাড় দেখতে, রূপসী বাংলা দেখতে।
এরপর বগা লেকের পাশে বসে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। সেই সঙ্গে চলে ছবি তোলা। সন্ধ্যা হলেই প্রায় সবাই কটেজের সামনে গোল হয়ে বসেন। শুরু হয় তুমুল গল্প, আড্ডা।
সংসার, সাংবাদিকতা, চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে এমন কোনো বিষয় নেই যে সেখানে আলোচনা হয়নি। এক পাশে চলতে থাকে আগুন জ্বালানো। শুরু হয় গান গাওয়ার পর্ব। আগুন নেভা শেষে জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে চলে মুরগি ঝলসানো। রাতে খাবার খেয়ে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যাই শুতে। কারণ কেওক্রাডংয়ের জন্য খুব ভোরে উঠতে হবে। আমাদের কটেজটি ছিল বিশাল। একাধিক খাট ছিল সেখানে। রাতে আমরা ২০-২২ জন ছিলাম। ঘুমানোর সময় হাসাহাসি করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই।
পরদিন ছিল বাংলা নববর্ষ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন মানে পয়লা বৈশাখ। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে নিই। নাশতা করে ৭টা ১০টা মিনিটে হাঁটা শুরু করি কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে। পিঠের পেছনে ছিল বিশাল একটি ব্যাগ। হাতে ধরার জন্য ছিল চিকন বাঁশ।
আমাদের সামনে একজন গাইড ছিলেন। আর পেছনে ছিলেন আরেকজন গাইড। তাঁরা জানালেন কেওক্রাডং যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। এর মাঝে আমরা কোথায় কোথায় বিরতি নেব তা জেনে নিলাম। শুরুতে পড়বে চিংড়ি ঝরনা। তারপর দার্জিলিংপাড়া।
সবাই একসঙ্গে হাঁটা শুরু করলেও কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যায় সবাই। আমিও একটি ছোট দলের সঙ্গে পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে থাকি।
মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে উঠছিলাম। কিন্তু পাহাড়ের রূপসুধার কাছে সেই কষ্ট কিছুই ছিল না। আমরা একটু একটু উঁচু পাহাড়ে উঠছিলাম, আর বলে উঠছিলাম ‘ওয়াও’। পাহাড়ের এই পথ কখনো ছিল চওড়া, কখনো সরু। একটু উনিশ-বিশ হলেই পড়তে হবে গভীর খাদে। মাঝেমধ্যে পড়ছিল উঁচু ঝোপ-ঝাড়।
পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা পৌঁছাই চিংড়ি ঝরনায়। উঁচু-উঁচু পাথর বেয়ে যেতে হয় সেখানে। ঝরনার পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিই। পানিও খাই কিছুটা।
কিছুক্ষণ পর আবার হাঁটা শুরু করি। কিন্তু এবার আমি আমার দলের খুব পেছনে পড়ে যাই। ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে হাঁটতে থাকি। সত্যি বলতে তখন খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমি ভাবছিলাম, পেছনের দলের জন্য অপেক্ষা করব কি না। আবার পাহাড়ি পথে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। হঠাৎ কোনো বন্য প্রাণী বা সন্ত্রাসী দল আক্রমণ করলে! তাই বুকে সাহস নিয়েই এগুতে থাকি। ১০ মিনিট পর সামনে একটি দলকে পাই। একটি উঁচু পাহাড়ের ওপর আমাদের কয়েকজন বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং এক পাহাড়ির বাগানের গাছের কলা কিনে খাচ্ছিলেন। জোড়া পাঁচ টাকা। আমিও এক জোড়া কলা খাওয়া শুরু করি। এর মধ্যে আমার গ্রুপটি সামনে হাঁটা শুরু করে। আমি বিশ্রাম নিতে থাকি। পরের গ্রুপ এলে তাদের সঙ্গে হাঁটা শুরু করি। কিছুদূর হাঁটার পর পাই বেশ খাড়া একটি লাল পাহাড়। সেই পাহাড় বেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হয়। একটা কদম ফেলি আর মনে হয় পেছনে কেউ টেনে ধরে নিচে নামিয়ে ফেলবে। ওই পাহাড়টি উঠতে দু-তিনবার বিরতি নিতে হয়।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর আবার একটি দোকান পাই। সেখানে শুধু পাহাড়ি কলা ও পেঁপে পাওয়া যায়। দোকানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি উঁচু এক পাহাড়ে। সেখান থেকে প্রথম কেওক্রাডংয়ের চূড়া দেখা যায়। এরপর হাঁটার গতি বেড়ে যায়। কথা বলতে বলতে কখন যে বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও উঁচুতে অবস্থিত (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত) গ্রাম দার্জিলিংপাড়ায় চলে এসেছি, টেরই পাইনি। পাড়াটি খুবই সুন্দর, সাজানো-গোছানো। এই পাড়ায় যদি নিজের একটি বাড়ি থাকত! দার্জিলিংপাড়ায় আমরা গোসলের পর্ব সেরে নিই। পাড়ার লোকজন ঝরনার পানি সংগ্রহ করে তা মোটর দিয়ে পাইপের মাধ্যমে টেনে আনেন। আমরা ঝরনার সেই শীতল পানিতে গোসল করে সমস্ত গ্লানি ভুলে গেলাম।
দার্জিলিংপাড়া থেকে প্রায় এক হাজার ১০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত কেওক্রাডং। পাড়া থেকেই দেখা যাচ্ছিল সেটি। হেঁটে গেলে সময় লাগবে আধা ঘণ্টার কিছু বেশি।
দার্জিলিংপাড়া থেকে কেওক্রাডংয়ে ওঠার পথটি বেশ সুন্দর। খাড়া পাহাড় থেকে নিচে তাকাতেই গা ছমছম করছিল। ওই পথটুকু উঠতে দুবার কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিই।
হাঁটতে হাঁটতে বেলা প্রায় সাড়ে ১২টায় পৌঁছাই কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়। সরকারি হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩ হাজার ১৭২ ফুট। মনে মনে বলি, আমি পেরেছি, পেরেছি কেওক্রাডং জয় করতে।
সেখানে কেওক্রাডং পাহাড়ের জমির মালিক লালা বমের কটেজে হাত-মুখ ধুয়ে নিই। এ সময় শুনলাম চূড়ায় থাকা সেনাক্যাম্পে জুমার নামাজ হবে। ওজু করে চলে যাই জুমার নামাজ পড়তে। আমার জীবনের সেরা জুমার নামাজ সেটি।
নামাজের পর খেয়েদেয়ে দেশের পঞ্চম সর্বোচ্চ চূড়া কেওক্রাডংয়ের ছাউনির নিচে শুরু হয় তুমুল আড্ডা। ফাঁকে ফাঁকে ছবি তোলা। বিকেলে গিয়ে বসি পাশে হেলিপ্যাডে।
সেখান থেকে নাকি অনেক সুন্দর সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ। সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে কালো মেঘে পশ্চিমের আকাশ ঢেকে যায়। তারপরও খুব ভালো কেটে যায় সন্ধ্যাটা। হেলিপ্যাডের একেক পাশে একেক রকম সৌন্দর্য। রাত হলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ আমাদের ঘিরে ফেলে। পুরো শরীরকে ছুয়ে দিয়ে চলে যায় অন্যত্র। এরপর রাতটাও চরম গল্প আর আড্ডায় কেটে যায়।
পরদিন ১৫ এপ্রিল, শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে ভেবেছিলাম কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় বসে সূর্যোদয় দেখব। কিন্তু আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় সেই সৌভাগ্য হয়নি। আমরা নাশতা করে বগা লেকের উদ্দেশে রওনা দিই। এখন বেশির ভাগ পাহাড় বেয়ে নামতে হবে, আর হাঁটতে হবে। ১০ মিনিটে দার্জিলিংপাড়ায় চলে যাই। নামার সময় খুব সাবধানে থাকি। কারণ আগেই শুনে এসেছিলাম, কেওক্রাডং থেকে নামার অসতর্কতার কারণে অনেকে দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হন।
চিংড়ি ঝরনা পার হয়ে বগা লেক যাওয়ার পথে ঘটে ভয়ংকর ঘটনা। ছোট একটি গ্রুপের সামনে ছিলাম আমি। হাতে ছিল সেই চিকন বাঁশ। আমার সামনে দিয়ে চলে যায় সবুজ রঙের চিকন একটি সাপ, লাউয়ের ডগা বা গ্রিন ভাইপার স্নেক। আমি সাপ, সাপ বলে চিৎকার করতে থাকি। পেছন থেকে একজন এসে বাঁশ দিয়ে সেটি মেরে ফেলেন। তারপর বলতে থাকেন, তাঁদের বাড়ি নরসিংদীতে, তাঁরা নিয়মিত বিষধর গোখরা মেরে থাকেন। এই সাপ তো মারা কোনো ব্যাপারই না!
এরপর আমি আর ভয়ে গ্রুপের সামনে থাকিনি। কেওক্রাডং থেকে প্রায় দুই ঘণ্টায় নিরাপদে নেমে আসি বগা লেকে। এসেই আরেক দফা লেকের পানিতে গোসল সেরে নিই। বগা লেকের খাড়া পাহাড় থেকে সাবধানে নেমে আসি কমলাবাজার। সেখান থেকে আবার উঠি চাঁদের গাড়িতে।
পাহাড়ে চলছিল বৈসাবি উৎসব। শনিবার ছিল পানিখেলার দিন। আমাদের আগেই বলা হয়েছিল ব্যাগ, মোবাইল, ক্যামেরা ঢেকে রাখার জন্য। পথে আমাদের নাকি পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেবেন পাহাড়িরা। হলোও তাই। চাঁদের গাড়িতে করে রুমা বাজার যাওয়ার পথে একটি পাড়ায় দুই তরুণী আমাদের তিন গাড়ির সবাইকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেন। রুমা বাজার থেকে আবার উঠি বাসে। পথে আরেক দফা বাস একটি পাড়ায় থামলে মোটরযুক্ত পাইপে পানি টেনে আমাদের ভিজিয়ে দেওয়া হয়। দুপুরে এসে পৌঁছাই বান্দরবান শহরে। রাতে ঢাকার বাস। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমরা একটি হোটেলের চারটি রুমে ফ্রেশ হয়ে নিই। এরপর তাজিংডং ক্যাফেতে দুপুরের খাবার খাই।
হোটেলের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর দেখি পাহাড়ি ও বাঙালিরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে জিপ, চাঁদের গাড়ি, মিনি ট্রাক ও ইজিবাইক ভাড়া করে শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
আর রাস্তার পাশে থাকা লোকজনকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমাদের গ্রুপের বেশ কয়েকজন ছেলেও এরপর পানিখেলা শুরু করেন। একটু বিকেল হলে চলে যাই বান্দরবান শহরের রাজার মাঠে পানিখেলার মূল উৎসব- ‘মাহা সাংগ্রাইং পোয়েঃ’তে। সেখানে মারমাদের নাচ, গানের পাশাপাশি চলছিল পানিখেলা। ওই খেলায় শুধু তালিকাভুক্ত মারমা তরুণ-তরুণীরা অংশ নেন। আমরাসহ বাকিরা মঞ্চের পেছনে পানিখেলায় মেতে উঠি। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে হোটেলের রুমে চলে যাই। ফ্রেশ হয়ে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে ফেলি। এরপর খাওয়াদাওয়া শেষ করে রাতের বাসে রওনা দিই ঢাকার উদ্দেশে। আমি এক ঘুমে পৌঁছে যাই ঢাকায়। শেষ হয় স্মরণীয় এক যাত্রার।
কীভাবে যাবেন : কেওক্রাডং যেতে হলে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে বান্দরবান। ঢাকা থেকে বা চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে বান্দরবান শহরে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে ননএসি বাসের ভাড়া ৬২০ টাকা। এরপর বান্দরবান শহর থেকে মিনিবাস, চাঁদের গাড়ি, জিপ বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যেতে হবে রুমা বাজার। জনপ্রতি বাসভাড়া ১০০ টাকা। চাঁদের গাড়ি বা জিপ রিজার্ভ ভাড়া করলে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ পড়বে। নিয়ম অনুযায়ী রুমা বাজার থেকে পাহাড়ে কোথাও বেড়াতে যেতে হলে আপনাকে গাইড নিতে হবে, দিনপ্রতি গাইড সার্ভিস চার্জ ৬০০ টাকা। বাজারে গাইড সমিতি আছে। তাদের কাছে গেলেই গাইড পাবেন। সাধারণত দুভাবে লোকজন রুমা বাজার থেকে বগা লেক যায়। এক. চাঁদের গাড়ি/জিপগাড়িতে করে বগা লেক বা বগা লেকের কাছাকাছি কমলাবাজার পর্যন্ত, দুই. ঝিরিপথে হেঁটে।
চাঁদের গাড়ির ভাড়া আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। যারা প্রথমবারের মতো কেওক্রাডং যাচ্ছেন, তাঁদের বগা লেক গিয়ে রাতে থাকা ভালো। গাইডই আপনার জন্য কটেজ ঠিক করে দেবে। ভাড়া জনপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। বিভিন্ন কটেজ আছে সেখানে, একতলা-দোতলা। কেওক্রাডংয়ে থাকতে চাইলে সেখানকার মালিক লালা বমের কটেজেও থাকতে পারেন। খাওয়ার ব্যবস্থা দুটি স্থানেই আছে। খাবার জনপ্রতি তাঁরা নেন ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা।