ছয়চিরী দীঘিরপাড়ে
Tweet
জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ওপর দিব্যি হেঁটে যাচ্ছেন জলজ্যান্ত মানুষ। লম্ফ-ঝম্প করছেন বলিচ্ছেদের ওপর। জিহ্বায় লোহার শলাকা ভেদ করে ঘুরছেন এদিক-সেদিক। কেউ আবার পিঠে গেঁথে দেওয়া বড়শির সাহায্যে ২৫-৩০ ফুট উঁচু চড়ক গাছে ঝুলছেন এবং চক্রাকারে ঘুরছেন অনবরত। অনেকে আবার বলিচ্ছেদ-ত্রিশূল হাতে উদ্দাম নেচে চলেছেন শিব-কালীর বেশে। দর্শনার্থীরা ঘিরে রেখেছেন তাদের। প্রত্যেকের চোখে বিস্ময়। তারপরও শত শত পুণ্যার্থী মুহুর্মুহু উলুধ্বনি আর ঢাক-কাসর-শাঁখের শব্দে মুখরিত করে তুলেছে গোটা এলাকা।
বন্ধুরা এই দৃশ্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ছয়চিরী দীঘিরপাড়ে ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজায়।
যা দেখবেন
কয়েক হাজার মানুষ অপলক তাকিয়ে ৩০ ফুট উচ্চতার কাঠের দণ্ডের দিকে। তিনজন মানুষ শূন্যে ঘুরছে একটি রশিতে ঝুলে। দড়িটি বাঁধা ওই মানুষগুলোর পিঠের চামড়ার সঙ্গে গাঁথা বড় দুটি বড়শির সঙ্গে। চলছে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, বাজছে ঢাকঢোল। বড়শিতে ঝুলে থাকা তিনজন তাঁদের সঙ্গে থাকা ফুল-জল, আবির, বাতাসা, নকুলদানা ইত্যাদি ছিটিয়ে দিচ্ছেন অগণিত ভক্ত-দর্শকের দিকে। কিছু পরে দেখতে পাবেন সন্ন্যাসীরা ২৫-৩০ ফুট উঁচু চড়ক গাছে দ্রুত গতিতে ঘুরছেন। আর ভক্তদের উদ্দেশে কলা-বাতাসা-শসা ছুড়ে দিতে লাগলেন। সন্ন্যাসীর ছোড়া এসব জিনিস হাতে পাওয়ার জন্য ভক্তদের মধ্যে পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। অনেকেরই বিশ্বাস, এসবে থাকে দৈবশক্তি। ঘোরার পাঠ সাঙ্গ করে সন্ন্যাসীকে একসময় চড়ক থেকে নামিয়ে আনা হলো। অনেক ভক্ত গিয়ে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করছে মনোবাঞ্ছা পূরণের নিমিত্তে ।
যা যা হয়
পূজার কয়েকদিন আগে থেকে ভক্তরা শিব-গৌরি সাজে নেচে গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে। এদিনগুলোতে তারা সন্নাসব্রত ও উপবাস পালন করে। এ সময়ে স্থানীয় শ্মশানগুলোতে হিন্দুরা নানা পূজা-অর্চনাও করে থাকে। রহিমপুর ইউনিয়নে বিশাল জায়গাজুড়ে ছয়চিরী দীঘি। এ দীঘির চারপাশেই বসে এ পূজার আয়োজন। নৃত্য করার জন্য এখানে কলা গাছ, বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় মণ্ডলী। উৎসবের আগের দিন রাত থেকেই এখানে শুরু হয় নানান আনুষ্ঠানিকতা। মন্ত্র পড়ে গভীর রাতে জ্বলন্ত আগুনের ওপর কালী সেজে নৃত্য করে। একে বলে ‘কালীনাচ’। অন্য ভক্তরা এ সময়ে নৃত্যের তালে তালে বাজায় ঢোল। নারীরা করে উলুধ্বনি। কালীনাচ শেষে প্রভাতে পূজারীরা পূজা দিয়ে চড়ক গাছকে নিমন্ত্রণ জানায়। আগের বছরের পূজা শেষে ছয়চিরী দীঘিতে ডুবিয়ে রাখা চড়ক গাছকে তুলে আনা হয়। এ গাছের দীঘিরপাড়ে গর্ত খুড়ে খাড়া করে বসানো হয় এ চড়ক গাছ। একশ ফুট উঁচু এ চড়কগাছে চারটি ধাপে বাধা হয় মোটা বাঁশ। বাঁশের মাথায় বেধে দেওয়া হয় লম্বা মোটা রশি। ছয়চিরি দিঘির পূর্ব পাশে একটি, উত্তর পাশে একটি ও দক্ষিণ পাশে দুটি করে মোট চারটি চড়ক গাছ বসানো হয়।
কীভাবে যাবেন
প্রথমে ঢাকা থেকে রেল কিংবা সড়ক পথে আসতে হবে শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে মাইক্রো বাস কিংবা অটো রিকশা নিয়ে যেতে হবে কমলগঞ্জের রহিমপুর। ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাস যায় শ্রীমঙ্গল। ভাড়া সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, দুপুর ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টায় ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ থেকে ৭৬৫ টাকা। পারাবত ও জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি ভানুগাছ স্টেশনে থামে। কমলগঞ্জের রেল স্টেশনই ভানুগাছে। এ দুটি ট্রেনে এসে কমলগঞ্জে নেমে সহজেই যাওয়া যাবে রহিমপুরে।