ডাক্তার বা ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন জ্বালিয়ে দিয়ে আমি নেমে পড়লাম পর্যটনের পথে

Share on Facebook

‘বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ’ কথাটি নিরেট কথার কথা নয়। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য তার বাহু প্রসারিত করছে বিভিন্ন শিল্পে। এমনই একটি শিল্প পর্যটন। খুব নীরবে কিন্তু দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে পর্যটন শিল্প। এই শিল্পের যেমন অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনই কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জনের জন্য তাই পরিকল্পিত পথচলার প্রয়োজনীয়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পর্যটন শিল্প যে তার পরিধি বিশাল হতে বিশালতর করার পথে নীরবে হেটে চলেছে এর পেছনে রয়েছে কয়েকজন পর্যটন ও পর্যটনশিল্পমনস্ক মানুষের অবদান। জামিউল আহমেদ এমনই একজন পর্যটন ব্যক্তিত্ব। পর্যটনকে কেন্দ্র করেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের চার দশক। জনাব জামিউল আহমেদ বর্তমানে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তার মূল পরিচয় হলো তিনি বাংলাদেশের পর্যটন বিষয়ক প্রধানতম লেখক ও গবেষক। এছাড়া তিনি বেসরকারি সফল উদ্যোক্তা, সংগঠক এবং পরামর্শক। পর্যটনের চলমান চালচিত্র ও সম্ভাবনা নিয়ে জনাব জামিউল আহমেদের সাথে কথা বলেছেন পর্যটনিয়ার সম্পাদক আবু রায়হান সরকার।

পর্যটনিয়াঃ শুভ বিকেল। কেমন আছেন?

জামিউলঃ শুভ বিকেল। আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

পর্যটনিয়া: আজ থেকে চার দশক আগে আপনি পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তখন স্বাধীনতা অর্জনের পরে একদিকে দেশ গঠনের কাজ চলছে অন্যদিকে পর্যটনের ধারনাও নতুন। সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পর্যটনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, প্রত্যাশা করেছিলেন, তা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে?

জামিউলঃ স্বাধীনতা অর্জনের পরে তরুণ চোখে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তাতে অদম্য ইচ্ছার সাথে আবেগও মিশে ছিলো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাস্তবতা শিখিয়েছে অনেককিছু। স্বপ্নের সবকিছু তো আর সত্য হয়না। তবে, প্রচণ্ড আশাবাদী ছিলাম যে বাংলাদেশ পর্যটনে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। আশার সমান ‍দূরত্বে হয়তো যায়নি, তবে ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে পর্যটন থেমে নাই। এই থেমে না থাকার কারণেই শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন যতদূর এগিয়েছে তা বেশ ভালোই বলতে হবে। পর্যটনে বাংলাদেশ আরও অগ্রসর হবে, এটা ভাবতে এখনো অনেক সাহস পাই, কারণ, পর্যটন থেমে নেই। তরুণ প্রজন্মও এগিয়ে এসে হাল ধরছে।

পর্যটনিয়াঃ পর্যটনের সাথে আপনার সম্মৃক্ত হওয়ার গল্পটা শুনতে চাই।  

জামিউলঃ ছোটবেলা থেকে ভ্রমণের দিকে বিশেষ ঝোঁক ছিল। ঘোরাঘুরি আমার ভালো লাগতো।  সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম। কখনো বন্ধুবান্ধবসহ দল বেঁধে ঘুরতে যেতাম, দল না পেলে একাই বেড়িয়ে পড়তাম। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমার দুইবন্ধু ট্রাভেল এজেন্সীর ব্যবসা করতো। তখনকার দিনে ভ্রমণ কর্মকাণ্ড বলতে ঐ ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোই ছিল ভরসা। সেই অর্থে কোনো ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানও ছিল না। মূলত এই দুইবন্ধুর হাত ধরেই পর্যটনে সম্পৃক্ত হওয়া।

পর্যটনিয়া: পর্যটনেই আপনার পেশা হবে কখনো ভেবেছেন? 

জামিউল: আমার বন্ধুরাও বলতো বন্ধু, এখানে আসো আমাদের সাথে কিছু কাজ-কর্ম করো। আমি অবশ্য কোনো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতাম না। নিতান্ত ভালো লাগা থেকেই ওদের সাথে কাজ করতাম। ওদেরও উপকার হতো, পড়ালেখার বাইরে আমিও ভালো লাগার কাজটা করার সুযোগ পেতাম। এভাবেই শুরু। আসলে পর্যটনের সাথে আমি এভাবে জড়িয়ে যাবো তা ভাবিনি। তারমানে পর্যটনই যে আমার পেশা হবে সেটা তখন ভাবি নাই।

পর্যটনিয়া: আপনি তো একসময় চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন- 

জামিউল: পর্যটনের কাজটা একসময় আমার সখের ব্যাপার ছিল। তারপর ধীরে ধীরে পর্যটনের সাথে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম যে আর বিচ্ছিন্ন হতে পারলাম না। হ্যাঁ দেশ স্বাধীনের পরপরই চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ালেখার সুযোগ পেয়েও যেকোনো কারণেই হোক আর পড়া হলো না। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষে আইন বিষয়েও পড়ালেখা করলাম, ব্যারিস্টার হওয়ার পথে অনেক দূর চলে গিয়েও ব্যারিষ্টার হতে পারলাম না শুধু এই পর্যটনেরই কারণে।

পর্যটনিয়া: বিষয়টা যদি বিস্তারিত বলতেন-

জামিউলঃ ঐ যে বললাম দুইবন্ধু ট্র্যাভেল এজেন্সির ব্যবসা করতো। তখনকার দিনে ট্র্যাভেল বা ভ্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ-কর্ম ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোই করতো। ওদের সাথে কাজ করতে করতে একদিন ওরা আমাকে এনএইচটিটিআইতে পাঠালো একটা কোর্স করার জন্য। তখন এনএইচটিটিআই এ কোনো কোর্স করতে গেলে কোনো না কোনো ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যম হয়ে যেতে হতো। সরাসরি ভর্তির কোনো সুযোগ ছিল না। সেখানে কোর্স করাতে এসেছিলেন ইউএনডিপির একজন ট্র্যাভেল এক্সপার্ট, তার নাম ইতোরে আমোতা। তিনি ইতালিয়ান নাগরিক এবং সেদেশের জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন। এই ভদ্রলোকের কথার যাদুতে পর্যটনগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। ঘোরাঘুরি আমার নিজেরও ভালো লাগতো আর উনিও দেখালেন পর্যটনের মাধ্যমে দেশ সেবার নতুন পথ। ডাক্তার বা ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন জ্বালিয়ে দিয়ে আমি নেমে পড়লাম পর্যটনের পথে।

পর্যটনিয়া: ক্রিমিনোলজির উপরেও আপনি স্কলারশিপ পেয়েছিলেন, তাই না? 

জামিউল: ক্রিমিনোলজির উপরে আমি স্কলারশিপ পেয়েছিলাম দুইটা; একটা আমেরিকায় আরেকটা অস্ট্রেলিয়ায়। কিছুটা পারিবারিক আর কিছুটা এই পর্যটনের কারণে কোনো স্কলারশিপই গ্রহণ করলাম না। গল্পের বিস্তারিত বলার জন্য একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। আমি যে এনএইচটিটিআই অর্থাৎ ন্যাশনাল হোটেল এন্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’র কথা বললাম তখনকার দিনে সেটার নাম ছিল টিটিআই (ট্যুরিজম ট্রেনিং ইন্সস্টিটিউট)। ইউএনডিপিপি এবং আইএলওর সহযোগিতায় তখন টিটিআই পরিচালিত হতো। এই সময় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন তাদের নিজ উদ্যোগে ইতোরে আমোতাকে নিয়ে এসেছিল। আমিও ভাবলাম উনার মতো একজন বিশ্বব্যক্তিত্বের অধীনে একটা কোর্স করে দেখি। অবশ্য ঐ সময় চাইলেই যে কেউ সেখানে ভর্তি হতে পারতো না। একটা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ওখানে চান্স পেতে হতো। আমিও লিখিত পরীক্ষা আর মৌখিক পরীক্ষা দিয়েই সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই প্রশিক্ষণ করাতে গিয়ে উনি পর্যটনকে এমনভাবে মগজে ঢুকিয়ে দিলেন যে পর্যটন যেন একেবারে রক্তের সাথেই মিশে গেল। পর্যটনের বাইরে আমি আর কিছুই চিন্তা করতে পারলাম না। এভাবে একটা একটা করে সবগুলো সুযোগ দূরে ঠেলে দিয়ে আমি পর্যটনের মধ্যেই নিমজ্জিত হলাম।

 

সাক্ষাৎকারের পরবর্তী পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

Leave a Reply