ফুকেট বা বালিদ্বীপ কক্সবাজারের কাছে পাত্তাই পাবে না
Tweet
‘বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ’ কথাটি নিরেট কথার কথা নয়। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য তার বাহু প্রসারিত করছে বিভিন্ন শিল্পে। এমনই একটি শিল্প পর্যটন। খুব নীরবে কিন্তু দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে পর্যটন শিল্প। এই শিল্পের যেমন অপার সম্ভাবনা রয়েছে, রয়েছে টেকসই সমৃদ্ধি তেমন প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। পরিকল্পিত পথচলার প্রয়োজনীয়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পর্যটনের চলমান চালচিত্র সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে জনাব জামিউল আহমেদের সাথে কথা বলেছেন পর্যটনিয়ার সম্পাদক আবু রায়হান সরকার। দীর্ঘ কথোপকথনের আজকে চতুর্থ ও শেষ পর্ব।
পর্যটনিয়াঃ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য করণীয় কী?
জামিউলঃ সরকার প্রধানের সরাসরি নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেরই পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয় নাই, ভবিষ্যতেও হবে না। সুতরাং বাংলাদেশও সরকার প্রধানের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতৃত্ব দরকার। সঠিক ও সূদরপ্রসারী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, যথাযথভাবে অর্থায়ন, প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন, পর্যটন পণ্য চিহ্নিতকরণ, সেবার মান নিয়ন্ত্রণ, হিসাব সংরক্ষণ, মান সম্পন্ন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন গবেষণা ইত্যাদি নিশ্চিত করা গেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে অনেক ভালো করবে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে গবেষণার কোনো বিকল্প নাই। বেসরকারি উদ্যেক্তা ও বিনিয়োগকারীদের কিছু সুযোগসুবিধা দিতে হবে। এছাড়াও যদি কোনো বেসরকারি বিনিয়োগকারী যেমন কেউ হয়তো ৩/৪/৫ তারকা মানের হোটেল বানাতে চায় বা কেউ হয়তো নতুন এয়ারলাইনস নামাতে চায় বা কেউ হয়তো ক্রুজ শিপ বানাতে চায় বা ট্যুরিস্ট কোচ কিনতে চায় মোটকথা পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত কোনো উদ্যক্তা বা বিনিয়োগকারীর যদি কোনো আর্থিক সহায়তার দরকার হয় সরকার তাঁদেরকে সহজ শর্তে সেই সহায়তা প্রদান করুক। তাহলেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যগের সমন্বয়ে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন হবে দ্রুত।
পর্যটনিয়াঃ বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে হলে কি কি করতে হবে?
জামিউলঃ বিদেশী পর্যটক আকর্ষন করার জন্য দুটো বিষয়ে সমান গুরুত্ব দিতে হবে- প্রথমত: পর্যটন গন্তব্যগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে নিরাপত্তাও। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের পর্যটনকে ব্রান্ডিং করে ম্যাসিভ ম্যার্কেটিংয়ে যেতে হবে। মার্কেটিং শ্যুড বি প্রোডাক্ট বেইজড এন্ড টার্গেট ওরিয়েন্টেড। বর্তমান সময়ে মার্কেটিং খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পর্যটন গন্তব্যগুলোর ভিডিও ক্লিপস, লিফলেট ফ্লাইয়ার বা ছোট ছোট ডকুমেন্টারী তৈরী ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। এছাড়াও টিভি এডভার্টাইজিং এবং বিদেশি প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রচার প্রচারণা চালানো যেতে পারে। বিদেশি পর্যটক আকর্ষন করার কাজটা পর্যটন করপোরেশন বা কোনো এজেন্সির মাধ্যমেও ইফেক্টিভ এন্ড এফিশিয়েন্ট ওয়েতে করে নেয়া যেতে পারে। সরকারের স্বদিচ্ছা থাকলে বিদেশি পর্যটক আকর্ষন করা এই যুগে খুউব সহজ ব্যাপার।
পর্যটনিয়াঃ বিদেশী পর্যটকদেরকে সেবা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত অবস্থায় কি বাংলাদেশের আছে?
জামিউলঃ পর্যাপ্ত অবস্থা বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?
পর্যটনিয়াঃ পর্যাপ্ত অবস্থা বলতে বিদেশী পর্যটক আসার মত যথেষ্ট ফ্লাইট, বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে বিভিন্ন ডেসটিনেশনে নিয়ে সেবা দেয়ার মত যথেষ্ট গাইড, আভ্যন্তরীণ চলাচলের জন্য যথেষ্ট পর্যটন যানবাহন, রাত্রী যাপনের মতো যথেষ্ট হোটেল, খাওয়া-দাওয়া করার মতো যথেষ্ট রেস্টুরেন্ট আর একটু নাইট লাইফ ইত্যাদি।
জামিউলঃ আগেই বললাম না যে পর্যটন অবকাঠামো বেসরকারি খাতের লোকেরাই গড়ে তুলবে, এই বিষয়ে কোনো সংশয় নাই। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তো প্রতিদিনই অনেক ফ্লাইট যাওয়া আসা করছে বিধায় আপাতত এয়ার ট্রান্সপোর্ট নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে না। তাছাড়া আমাদের বড় বড় যে পর্যটন গন্তব্যগুলো আছে যেমনঃ কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সিলেট ইত্যাদি এগুলোতে কিন্তু যথেষ্ট আবাসন সুবিধা গড়ে উঠেছে বা উঠছে। মানের দিক থেকেও অনেক উন্নত। এসবের মধ্যে এমন অনেক হোটেল বা রিসোর্ট আছে যেগুলো ৩ থেকে ৫ তারকা মানের। এই সমস্ত হোটেল ও রিসোর্টগুলোর অকুপেন্সি রেট তো প্রতিদিনই হান্ড্রেড পার্সেন্ট নয়, সুতরাং আবাসন সমস্যাও আপাতত নাই। গাইডের অভাবও বাংলাদেশে তেমন একটা নাই তবে, দক্ষ ও একাধিক ভাষা জানা গাইডের অভাব আছে তা মানতে হবেই। তবে এটাও ঠিক যে, পর্যটনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে এখনো তেমন কোনো নাইট লাইফ গড়ে ওঠে নাই। এখানে পর্যটকদের যেহেতু রাতে কিছুই করার থাকে না তাই তারা বোর ফিল করে। এইদিকটায় উন্নতি করার অবকাশ আছে। যথেষ্ট মনোযোগের সাথে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের যে কোনো নাইট লাইফ নাই এটা একটা অনেক বড় মাইনাস পয়েন্ট আমাদের পর্যটনের জন্য। আর অন্যসব সমস্যা যেমন আবাসন সমস্যা বা পরিবহণ সমস্যা বা গাইড সমস্যা এগুলো বেসরকারি উদ্যোক্তরা নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনেই সমাধান করে ফেলবে এই বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নাই। তবে নাইট লাইফ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা আর দেশ বিদেশে প্রচার প্রচারণায় সকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
পর্যটনিয়াঃ আমাদের অভ্যন্তরীন পর্যটক নিয়ে কিছু বলেন। পর্যটন মৌসুমে আমাদের দেশিয় পর্যটকের চাপই ডেসটিনেশনগুলো নিতে পারে না।
জামিউলঃ দেশিয় পর্যটকের চাপ সামলাতে না পারলে বিদেশী পর্যটক আনবো কেন? বিষয়টা খেয়াল করেছেন কি না, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর পঁচিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ পর্যটক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে যায়। পর্যটক তো স্বাধীন। কেউ বিদেশ ভ্রমণে যেতে চাইলে আপনি তাকে বাধা দিতে পারবেন না। তাহলে বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে যতটাকা বাইরে খরচ হয় এই টাকাটা আমাদের অর্থনীতি থেকে চলে যাচ্ছে। যেহেতু বিরাট একটি অংকের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে সেহেতু আমাদের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্যে হলেও একটা বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ঢুকাতে হবে। আর এই বিদেশী মুদ্রা বাংলাদেশে ঢুকানোর জন্য বিদেশ থেকে আরো বেশি বেশি পর্যটক নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ ব্যালান্স করার জন্য হলেও বিদেশী পর্যটক আনতে হবে। পাশাপাশি অভ্যন্তুরীণ পর্যটনের প্রভূত উন্নয়ন করতে হবে, সেবার খাত বাড়াতে হবে যাতে বিদেশ ভ্রমণের কাঙ্ক্ষিত কিছু সেবা দেশেই পেতে পারে একজন পর্যটক। এর ফলে যদি বেদেশ ভ্রমণের হার কিছু কমে আসবে তাহলেও দেশের অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্প উপকৃত হবে।
পর্যটনিয়াঃ আমাদের দেশ কেমন করে অভ্যন্তরীন পর্যটকের সাথে বিদেশী পর্যটকের চাপ সামলাবে?
জামিউল: প্রসংগটা খুব ইন্টারেস্টিং। একটু বিস্তারিত না বললে ধারণা পরিষ্কার হবে না। আমাদের একটা ডেসটিনেশনের নামই বলি, কক্সবাজার। কক্সবাজার বিশ্বের অখণ্ড ও বালুময় দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। যার দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। র্দীঘতম এই সমুদ্র সৈকতটি শুধুমাত্র কলাতলী, লাবনী বা সুগন্ধা পয়েন্টেই বন্দি থাকবে কেন? চিন্তা করে দেখেন বিশ্বের দীর্ঘতম অখণ্ড ও বালুময় সমুদ্র সৈকত অথচ আমরা সেটাকে কাজে লাগাতে পারছি না। আমরা আমাদের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কাজে লাগানোর সামর্থ্য অর্জন করতে পারছি না অনেকটা পরিকল্পনা ও গবেষণার অভাবে। পর্যটন উন্নয়নের স্বার্থেই আমাদের যথেষ্ট গবেষণা কাজ করতে হবে। আমরা যদি আমাদের কক্সবাজারকে পরিকল্পনামাফিক সাজাতে পারি তাহলে থাইল্যান্ডের ফুকেট বা ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপ কক্সবাজারের কাছে পাত্তাই পাবে না। ফুকেট বা বালি পর্যটন থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে তারচেয়েও আমরা বেশী অর্জন করতে পারতাম। অন্যান্য ডেসটিনেশনগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলাম। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও এখানে অনেক পর্যটন গন্তব্য আছে। এই গন্তব্যগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। তাহলেই আমরা দেশিয় পর্যটকের সমান বা তারচেয়েও বেশি পর্যটক ধারণ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারবো। আমাদের সামর্থ্য আছে, সামর্থটাকে শুধু কাজে লাগাতে হবে।
পর্যটনিয়াঃ পর্যটনিয়াকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
জামিউলঃ পর্যটনিয়ার পাঠক ও আপনাকে ধন্যবাদ।