সুন্দরবনের ভিতরে স্থায়ী ফাঁড়ি স্থাপন করতে চায় র্যাব
Tweet
সুন্দরবন এলাকায় বনদস্যু দমন, জেলেদের সুরক্ষা ও বন্য প্রাণী রক্ষায় বনের ভিতরে স্থায়ী ফাঁড়ি স্থাপন করতে চায় র্যাব। চারটি এলাকায় এসব স্থাপনা তৈরি করতে ১২ একর জমি চেয়েছে তারা। তবে এই প্রস্তাবের ব্যাপারে বন বিভাগ আপত্তি জানিয়ে বলেছে, সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের ফলে বনদস্যুদের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ফলে সুন্দরবনে র্যাবের ফাঁড়ি স্থাপনের দরকার নেই।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের পক্ষ থেকে সুন্দরবনের কটকা, সুপতি, দুবলার চর ও মুন্সিগঞ্জে ফাঁড়ি স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে কটকা সুন্দরবনের বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা ও জাতিসংঘের শিল্প, বিজ্ঞান ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা। এ ছাড়া কটকা, সুপতি ও মুন্সিগঞ্জ সুন্দরবনের বাঘের অন্যতম বসতি এলাকা। বন আইন অনুযায়ী, সুন্দরবনের ভেতরে কোনো ধরনের স্থাপনা তৈরী করা নিষেধ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মহসিন চৌধুরী বলেন, ‘র্যাবকে সুন্দরবনে ১২ একর জমি বরাদ্দ দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। এ ধরনের অনেক প্রস্তাব আমাদের কাছে আসে। যাচাই-বাছাই ও গুরুত্ব বুঝে আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, র্যাব সুন্দরবন রক্ষায় বনদস্যু দমনে কী ভূমিকা রেখেছে, তা দেশের মানুষ জানে। বনের মধ্যে স্থাপনা থাকলে বনদস্যুরাও ভয় পাবে আর র্যাবের পক্ষে অভিযান পরিচালনা করা সহজ হবে। এভাবে বনের মধ্যে অভিযান করে অনেক সময় ফাঁড়িতে ফেরা কঠিন হয়ে যায়।
কিন্তু সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য ও বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য এলাকায় স্থাপনা করার ক্ষেত্রে আইনি বাধার পাশাপাশি ইউনেসকোর পক্ষ থেকেও আপত্তি আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুফতি মাহমুদ বলেন, ‘আমরা তো বন ও বন্য প্রাণীদের রক্ষার জন্যই কাজ করব। এতে বনের লাভ হবে। আমাদের প্রস্তাব মেনে নিয়ে জমি বরাদ্দ দিলে তা সুন্দরবন তথা দেশের জন্য উপকার হবে।’
র্যাবের ওই প্রস্তাব পাওয়ার পর বন বিভাগের খুলনা সার্কেল, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ ও পশ্চিম বন বিভাগ থেকে মতামত চাওয়া হয়। এ তিনটি কার্যালয় সুন্দরবনে র্যাবের ফাঁড়ি স্থাপনের প্রয়োজন নেই বলে মতামত দিয়েছে।
বন বিভাগের খুলনা সার্কেল বলেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন বেড়িবাঁধে র্যাব-৬-এর একটি অস্থায়ী ফাঁড়ি রয়েছে। সেখান থেকে সফলভাবে বনদস্যু দমনে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। খুলনা সার্কেল ওই ফাঁড়িটি পার্শ্ববর্তী সরকারি কোনো খাসজমিতে স্থায়ীভাবে স্থাপনের সুপারিশ করেছে।
খুলনা সার্কেল আরও বলেছে, র্যাব প্রস্তাবিত কটকার পূর্ব পাশে ককিলমনিতে ২০১০ সাল থেকে কোস্টগার্ডের স্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। ফলে ওই এলাকা বনদস্যুদের হাত থেকে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত। সুপতি ও দুবলার চরেও কোস্টগার্ডের স্থাপনা রয়েছে। ফলে ওই এলাকাগুলোতে নতুন করে র্যাবের স্থাপনা করার দরকার নেই।
সুন্দরবনের ভেতরে ক্যাম্প স্থাপনের জন্য কোনো ফাঁকা ভূমি নেই বলে জানিয়েছে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ। এখানে নতুন করে তিন একর করে জমিতে র্যাব ফাঁড়ি স্থাপন করলে বনের বিপুলসংখ্যক গাছপালা কাটতে হবে, যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ বলেছে, কটকা, মুন্সিগঞ্জ, সুপতি ও দুবলার চর এলাকায় দুষ্কৃতকারীদের অনুপ্রবেশ তেমন দেখা যায় না। ইতিমধ্যে ১৪টি বনদস্যু বাহিনীর প্রধানসহ মোট ১৫২ জন বনদস্যু বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তা ছাড়া র্যাবের অভিযানে এ পর্যন্ত ১০৯ জন বনদস্যু নিহত হয়েছে। বর্তমানে বন অপরাধ শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
র্যাবের ফাঁড়ি স্থাপন না করে বন বিভাগে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ, আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ, দ্রুতগতিসম্পন্ন জলযান ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়ে সুপারিশ করেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, সুন্দরবন একটি জলাভূমি পরিবেষ্টিত বন। সেখানে স্থায়ী অবকাঠামো করার বিষয়ে আইনি বাধা রয়েছে। আর বনের বাইরে থেকে এত দিন অভিযান পরিচালনা করা গেলে তা ভবিষ্যতেও করা যাবে। এ জন্য বনের মধ্যে স্থায়ী অবকাঠামোর দরকার নেই। কেননা এতে বনের প্রতিবেশ-ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে।
র্যাবের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের বনদস্যু দমনে র্যাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বনদস্যুদের কারণে সেখানে জেলেদের মাছ ধরার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। জেলেদের অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে বনদস্যুরা জড়িত। এসব তৎপরতা বন্ধ করা এবং জেলেদের সুরক্ষার জন্য ওই চারটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় স্থায়ী স্থাপনা বা ফাঁড়ি থাকা প্রয়োজন।