লিজের চক্করে বিমান, সংসদীয় কমিটির নির্দেশনা উপেক্ষা
Tweet
সংসদীয় কমিটির নির্দেশনা পাশ কাটিয়ে ফের উড়োজাহাজ লিজের পক্রিয়া শুরু করেছে বিমান। বিদ্যমান সক্ষমতা অব্যবহৃত রেখে আরও দুটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিমান।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বর্তমান বহরে উড়োজাহাজ রয়েছে ১৩টি। লম্বা দূরত্ব অর্থাৎ একটানা ১৬ঘণ্টার বেশি উড়তে সক্ষম এরকম উড়োজাহাজ আছে মোট ছয়টি, এর মধ্যে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ চারটি আর বাকি দুইটি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার। এছাড়া আঞ্চলিক/নিকটবর্তী আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য রয়েছে চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ, এর দুটি লিজ নেয়া হয়েছে জিই ক্যাপিটাল এভিয়েশন সার্ভিসেস থেকে। অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য রয়েছে তিনটি ড্যাস-৮কিউ৪০০ উড়োজাহাজ, এর ২টি স্মার্ট এভিয়েশন এবং একটি নরডিক এভিয়েশন ক্যাপিটাল(এনএসি)থেকে দীর্ঘমেয়াদি ড্রাই লিজ চুক্তিতে বহরে যুক্ত করা হয়েছে।
২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর চারটি উড়োজাহাজ যুক্ত হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে। এরপর বহরে আরও দুটি বোয়িং ৭৮৭ ‘ড্রিমলাইনার’ যুক্ত হয় গত বছর। আগামী সেপ্টেম্বরে আবারও আসছে বোয়িং থেকে কেনা আরও দুটি ‘ড্রিমলাইনার’। বিমান বহরে নতুন প্রজন্মের এসব উড়োজাহাজ যুক্ত করার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইউরোপ-আমেরিকার মতো লম্বা দূরত্বের ফ্লাইট চালু করা। কিন্তু বিমানের সংখ্যা বাড়লেও আন্তর্জাতিক বা লম্বা দূরত্বের রুট বাড়ছে না। বর্তমানে বিমানের রুট ম্যাপে বড় দূরত্ব বলতে একমাত্র ঢাকা-লন্ডন রুটটি রয়েছে। ৫২টি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থাকা সত্বেও মাত্র ১৫টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান। বহুবার আশার কথা জানালেও এখনো চালু করা যায়নি ঢাকা-নিউইয়র্ক, ঢাকা-টরন্টোর মতো লম্বা রুটের ফ্লাইট। ফলে দীর্ঘ দূরত্বে উড্ডয়নে সক্ষম এসব উড়োজাহাজ দিয়ে স্বল্প ও মাঝারি দূরত্বের ফ্লাইট পরিচালনা বিমানকে ধারাবাহিক ক্যাপাসিটি লসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এছাড়া বর্তমানে বিমানের আন্তর্জাতিক রুট কেবল মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ই সীমাবদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যে কুয়েত, দাম্মাম, দোহা, রিয়াদ, জেদ্দা, আবুধাবি, দুবাই ও মাস্কাটে ফ্লাইট রয়েছে বিমানের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুরে ফ্লাইট চালাচ্ছে বিমান। এছাড়া স্বল্প দূরত্বে কলকাতা, ইয়াঙ্গুন ও কাঠমান্ডুতে ফ্লাইট রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থাটির। এই প্রেক্ষিতে লিজ নিতে যাওয়া দুটি ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হলে লম্বা দূরত্বের একটি রুটের জন্য বিমান বহরে থাকবে আটটি উড়োজাহাজ। যদিও ঢাকা-লন্ডন ব্যতীত লম্বা দূরত্বের কোনো ফ্লাইট না থাকায় উড়োজাহাজগুলোর পূর্ণ সক্ষমতাই ব্যবহৃত হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, লিজের চক্করে পরে সাড়ে তিন বছরে ৩০৫কোটি টাকা ক্ষতি গুণেছে বিমাণ বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ২০১৪ সালের মার্চে এবং মে মাসে মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজের মাধ্যমে ওই দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ বিমান বহরে যুক্ত হয়। যুক্ত হবার পর থেকেই উড়োজাহাজ দুটির ক্রটি দেখা দেয়। এক বছর ফ্লাইট পরিচালনার পর একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে মিশর ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আরেকটি ইঞ্জিন আনা হয়। ২০১৫এর ডিসম্বরে ভাড়ায় আনা ইঞ্জিনটিও নষ্ট হয়ে যায়। ইঞ্জিন মেরামত করতে যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। চুক্তির দুর্বলতার কারণে কারণে লিজ দাতা ও মেরামতকারী দুই প্রতিষ্ঠানকেই অর্থ দিতে হয়েছে বিমানকে।
ওই বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এক প্রতিবেদনে জানায়, দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ ভাড়া করার ক্ষেত্রে চুক্তিটি ছিল আত্মঘাতী। কোনো খোঁজখবর না করেই লিজ নেওয়া হয়েছিল। উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের সক্ষমতা যাচাইয়েও ব্যর্থতা ছিল।
সংসদীয় উপকমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে আরও জানায়, কারিগরি কমিটি উড়োজাহাজ দুটি সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর নিয়েছে বলে তদন্তে প্রতীয়মান হয়নি। এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে এবং বিমান পরিচালনায় লোকসানের পরিমান কমাতে ২০১৭ সালে লিজ প্রথা বন্ধ করে নতুন উড়োজাহাজ ক্রয়ের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা প্রদান করে সংসদীয় কমিটি।
সংসদীয় কমিটির নির্দেশনা উপেক্ষা করেই নতুন করে দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। চলতি জানুয়ারিতেই কুয়েতভিত্তিক এভিয়েশন লিজ অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানি (এএলএএফসিও)থেকে দীর্ঘমেয়াদে ড্রাই লিজে নেয়া উড়োজাহাজ দুটি বিমান বহরে যুক্ত হবে। এর বাইরে আরও দুটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ লিজ নিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র (আরএফপি) আহ্বান করেছে বিমান। জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২০জানুয়ারি নির্ধারণ করে দরপত্রের শর্তে বলা হয়েছে, উড়োজাহাজ দুটি অবশ্যই ওয়াইড বডি এবং ৪০০ আসনের বেশি হতে হবে। ২০১৯ সালের মে মাসে পাঁচ বছরের জন্য ড্রাই লিজে বহরে যুক্ত করা হবে এ দুটি উড়োজাহাজ।
এই প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিমান রেকর্ড ২৬ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে। যাত্রী পরিবহনে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সামনে রেখে ২০৩০ সাল নাগাদ বহরের উড়োজাহাজ সংখ্যা ৩০টি করার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি জানুয়ারিতে দুটি ৭৩৭ এবং আগামী মে মাসে দুটি ৭৭৭ বহরে যুক্ত হবে।
তিনি আর জানান, চলতি বছরই গুয়াংজু, মদিনা, কলম্বো ও মালে রুটে ফ্লাইট চালু করা হবে। লোকসানে থাকা রুটগুলো বন্ধ করে দিয়ে লাভজনক রুটগুলোয় ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। আগামী হজ ফ্লাইটকে সামনে রেখে ৭৭৭ উড়োজাহাজ দুটি লিজ নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ক্যাটাগরি উন্নয়ন হলে নিউইয়র্ক ও টরন্টো রুটের ফ্লাইটে এসব উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হবে। খুব দ্রুত এসব বাস্তবায়িত হবে জানালেও ঠিক কবে নাগাদ এসব কার্যকর হবে তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।