পর্যটন বিষয়ে চীনের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং কিছু কথা

Share on Facebook

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দিনের চীন সফর শেষ করে ৬ জুলাই, ২০১৯ দেশে ফিরেছেন। নানা দিক থেকে এই সফরটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন না সফরকালীন সময়ে স্বাভাবিকভাবেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ আলোচনার পাশাপাশি বেশ কিছু বিষয়ে চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক বা এম ও ইঊ (MOU) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব সমঝোতা স্মারকের মধ্যে পর্যটনও রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি ভালো খবর। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার আগে কি আমরা অন্য একটি বিষয় মাথায় রেখেছি বা বিবেচনায় নিয়েছি। আর তা হচ্ছে চীনের সাথে ইতোমধ্যে এপ্রোভড ডেষ্টিনেশন ষ্টেটাস বা এ ডি এস (ADS) চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন করা এবং এটিকে কাজে লাগানোর বিষয়টি।

এ ডি এস হচ্ছে একটি স্কিম যা স্বাক্ষর করা এবং অনুমোদন পাওয়া ছাড়া বৈধভাবে চীন দেশ থেকে কোন পর্যটক অন্য কোন দেশে যেতে পারবেনা কিংবা নিয়ে আসাও যাবেনা। সৌভাগ্য আমাদের যে এটি আমরা বেশ কয়েক বছর আগে স্বাক্ষর করেছি এবং অনুমোদনও (২০০৭ সালে) পেয়েছি। অথচ আমেরিকার মত দেশও আমাদের পরে (২০০৮ সালে) তা করতে সক্ষম হয়েছে। আর এ সফলতার জন্য কাজ করেছে চীনের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক এবং সরকারী ও বেসরকারী খাতের ঐকান্তিক ও যৌথ প্রচেষ্টা। কারণ, ঐ সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগেই আমরা বার বার চীন সফরে গিয়েছি এবং আমাদের দাবীকে আরো জোরদার করার লক্ষে বেইজিং-এ অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের পরামর্শ ও সহযোগীতায় প্রথমবারের মত চীন দেশে পর্যটন মেলাসহ বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছি।

তবে, এই এ ডি এস প্রাপ্তির ব্যাপারে আমরা অনেক এগিয়ে গেলেও দূর্ভাগ্যক্রমে তা কাজে লাগিয়ে চীন দেশ থেকে পর্যটক নিয়ে আসতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কেন না এ ডি এস’র শর্ত মোতাবেক আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারিনি বলে তা কাজে না লেগে বরং মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অথচ এসব শর্ত পালন এমন কোন কঠিন কাজ নয়, শুধু উদ্যোগ নেয়া এবং কাজগুলো করে ফেললেই হয়ে যেত। তাছাড়া স্বার্থটা আমাদেরই বেশি কারণ, আমরাই চীন দেশ থেকে পর্যটক নিয়ে আসবো। যা কি না অন্যান্য এ ডি এস সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করে থাকে। যেমন আমেরিকার মত দেশ চীনের পর্যটকদেরকে তার দেশে নিয়ে যাবার স্বার্থে ভিসা প্রদান পদ্ধতি সহজ করেছে এবং তা টানা দশ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। আর করবেই না বা কেন যেহেতু কয়েক বছরের মধ্যেই এই চীন দেশ থিবীর সেরা পর্যটক সরবরাহকারী দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। কেন না ধারণা করা হচ্ছে ২০২৪ সাল নাগাদ চীন দেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণকারী পর্যটকের সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে।

 

তাহলে একবার ভেবে দেখুন আমরা কি সুযোগটা কাজে লাগাতে পারিনি বা পারছিনা। অথচ মনে হয় আমরা পর্যটনের উন্নয়ন চাই বলে বিদেশ থেকে পর্যটক নিয়ে আসার জন্য বেশ পেরেশানীর মধ্যে আছি। তা নাহলে আমরা এই এ ডি এস বলি আর এম ও ইউ বলি সেগুলো স্বাক্ষর করেও তা থেকে ফায়দা হাসিল করতে বা ক্যাশ করতে পারছিনা কেন? হ্যাঁ, এর মূল কারণ হচ্ছে দায়িত্বশীলতা ও জবাদিহিতা না থাকা এবং অন্যের উপর বেশি ভরসা করা। যা দেখে মনে হয় যেন ‘বিড়ালের গলায় কে ঘণ্টা বাঁধবে’, এই অবস্থা। এ প্রসঙ্গে যদি আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি তাহলে বলবো, আমি যখনই যেখানে সুযোগ পেয়েছি বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি এবং লিখেছিও। এমন কি এই গত মাসেও বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড’র গভর্ণিং বডির সভায় ভারত এবং চীনে পর্যটনের আরো বেশি বেশি প্রচারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রসঙ্গটি আসলে আমি এ ডি এস কী তা ব্যাখ্যার পাশাপাশি এটির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু তাতে কী, মনে হয় কে শুনবে কার কথা এবং কে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে তাই বলা মুশকিল।

 

কেন না, যদি আমরা আরো পিছন দিকে ফিরে তাকাই এবং লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো যখনই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরা কোন দেশ সফরে গিয়েছেন তখনই অন্যান্য বিষয়ের সাথে প্রায়ই পর্যটন বিষয়টি থেকেছে। ফলশ্রুতিতে এ পর্যন্ত বেশ কিছু দেশের সাথে পর্যটন শিল্পে পারষ্পরিক সহযোগীতার জন্য এরকম সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কেন না যুগের এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রয়োজনে এমনট হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ডি এস বলি আর সমঝোতা স্বারক বলি তা স্বাক্ষরের পর কাজে লাগাতে না পারলে এর কোন মূল্যই থাকেনা। আর তা কাজে লাগানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোর। কারণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের মাধ্যমে এই কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর তা স্বাভাবিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলে যায়। তারা সেটি প্রয়োজনীও ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবে তবে, যথারীতি এর অগ্রগতি এবং বাস্তবায়ন মনিটর করবে।

 

অথচ এসবের ঘাটতি আছে বলেই পর্যটন বিষয়ে এমন এ ডি এস চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মত বিষয়গুলো পরবর্তীতে ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে থাকে। খুব বেশি হলে হয়তো দু’একটি সভা অনুষ্টিত হয় তারপর আর খবর থাকেনা। কেন না এসব সভায় উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে অন্তত তাই বলা যায়। মোদ্দাকথা, এমনটি হচ্ছে বলেই এসব গুরত্বপূর্ণ বিষয়ের খবর কেবল শুনতেই ভালো লাগে বটে কিন্তু কোন ফল নিয়ে আসতে পারেনা। শুধু কি তাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোন একটি দেশে সফরে যাওয়ার আগে এসব বিষয় মনিটর করা এবং প্রয়োজনীয় ষ্টাডি করার কোন প্রয়োজন বোধ করা হয়না বলেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে আমরা এ ডি এস স্বাক্ষরের পর তা কাজে না লাগিয়ে এভাবে আবার পর্যটন বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করি। যদিও তা ভালো বৈ মন্দ কিছু নয় তবুও বলতে হয় এ যেন কিছু পাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করে তা কাজে না লাগিয়ে আবার সেই ব্যাপারে পারষ্পরিক সহযোগীতার জন্য একমত হওয়ার মত ব্যাপার। অতএব, বলা মুশকিল কিভাবে এবং কবে আমরা এসব অসঙ্গতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। তবে তা পারতেই হবে, নাহয় আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প বরাবরের মত তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সত্যিকার আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতাকে অন্তত আলিঙ্গনটুকুও করতে পারবেনা।

Leave a Reply