ঘুরে আসুন সুসং দূর্গাপুর থেকে
Tweet
বাংলাদেশের সীমান্তের শেষ মাথায় এবং ভারতের মেঘালয় বর্ডারের কাছাকাছি থাকা জনপদের নাম সুসং দূর্গাপুর। বাংলাদেশের যে কোনো নদী থেকে আলাদা সোমেশ্বরী নদী আর নীল জলের লাইমস্টোন লেকের কারণে প্রত্যেক বাংলাদেশী ভ্রমণকারীর বাকেট লিস্টে অবশ্যই থাকে নেত্রকোনার এই সুসং দূর্গাপুর। এটি মূলত গারো উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা। এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক দর্শনীয় স্থানের ভেতরে গারো পাহাড়, সাদা মাটির পাহাড়, লাইমস্টোন লেক ও সোমেশ্বরী নদী বেশি জনপ্রিয় ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে। এছাড়াও দেখার মতো আছে বিজয়পুর বর্ডার এবং বিজিবি ক্যাম্প, সুসং জমিদার বাড়ী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী, হাজং মাতা শহীদ রাশিমনি স্মৃতিসৌধ, কংশ নদী, আত্রাখালি নদী, টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি স্থান।
সোমেশ্বরী নদী–
সোমেশ্বরী নদী স্বচ্ছ পানি আর ধুধু বালুচরের জন্য বিখ্যাত। ভারতের
মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া
প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদীর। ৬৮৬ বঙ্গাব্দের
মাঘ মাসে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ অত্র অঞ্চলকে বাইশা গারো নামের এক
অত্যাচারী গারো শাসক এর হাত থেকে মুক্ত করে নেয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নামে
পরিচিতি পায়। মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার (পূর্ব নাম বঙ বাজার) হয়ে
বাংলাদেশের রাণীখং পাহাড়ের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আরও দূরে গিয়ে মিলেছে সে ধনু নদীর সাথে। সোমেশ্বরীর
মূলধারা তার উৎসস্থলে প্রায় বিলুপ্ত। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য কোন মৌসুমে পানি
প্রবাহ থাকে না। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়ীয়া ঢলে সোমেশ্বরী বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত
হয়ে নতুন গতিপথের সৃষ্টি করেছে। যা স্থানীয় ভাবে শিবগঞ্জ ঢালা নামে খ্যাত।
বর্তমানে এ ধারাটিই
সোমেশ্বরীর মূল স্রোতধারা। অপরূপ
সুন্দর এই নদীতে
গেলেই আপনি একই সাথে দেখতে পাবেন চর, কয়লা উত্তোলন
চিত্র, কাশবন, বন, ভারতীয় বর্ডার এবং মেঘে ঢাকা পাহাড় ইত্যাদি।
গারো পাহাড়-
গারো পাহাড় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো-খাসিয়া পর্বতমালার একটি অংশ। এর কিছু অংশ ভারতের আসাম রাজ্য ও বাংলাদেশের নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত। গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি প্রায় ৮০০০ বর্গ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক মনোরম সৌন্দর্যের আধার এই পাহাড়ে প্রচুর পরিমানে মুল্যবান শাল গাছ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। প্রকৃতি প্রায় ঝুলি উজাড় করে দিয়েছে এ গারো পাহাড়কে সাজাতে। বিচিত্র স্বাদের প্রকৃতির অলংকার যেন মানায় এই ভূস্বর্গকেই। পাহাড়-পর্বত, ছোট ছোট নদী, পাহাড়ী ঝরণা, শাল-গজারীসহ নানা প্রজাতির গাছ, সৌন্দর্য-মেশা উঁচুনীচু পথ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখার মজাই আলাদা। সবুজে সবুজে উদ্ভাসিত এই গারো পাহাড়। পাহাড়ের অসমতল উঁচুনীচু টিলার মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে ঝরণা। যার স্বচ্ছ জলরাশিতে ভেসে ওঠে আগন্তুকের প্রতিচ্ছবি। দু’পাহাড়ের মাঝে মাঝে সমতল ভূমি। সমতল ভূমিতে সবুজ শস্য ক্ষেত। পাহাড়ে পায়ে চলার দুর্গম পথে চলাচল করে পাহাড়ী মানুষ। কোথাও কোথাও টিলার ওপর দেখা যাবে ছোট ছোট কুড়ে ঘর। সবুজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ। এই এলাকায় বসবাস করে বিভিন্ন শ্রেণীর আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন। তার মধ্যে গারো, হাজং, কোচ, মুরং উল্লেখযোগ্য। এ সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা যুগ যুগ ধরে নিজ নিজ কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা লালন করে সৌন্দর্য ও সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। অধিকাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। কৃষি অর্থনীতি মূলত পাহাড়ের ঢালে বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি এবং নদী ও পাহাড়ী ঝরণা অববাহিকায় ধান চাষ হয়।
সাদা
মাটির পাহাড়–
দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে
কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া মৌজায় বিজয়পুরের শসার পাড় এবং
বহেরাতলী গ্রামে সাদা মাটি অবস্থিত। এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের
গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল
রঙের জলাধার গুলো দেখতে অত্যন্ত চমৎকার। বাংলাদেশের মধ্যে প্রকৃতির সম্পদ হিসেবে
সাদা মাটির অন্যতম বৃহৎ খনিজ অঞ্চল এটি। বিভিন্ন রংয়ের মাটি, পানি ও প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মনকে বিমোহিত করে। সাদা, গোলাপী, হলুদ, বেগুনি,
খয়েরী, নীলাভ সহ বিভিন্ন রংয়ের মাটির পাহাড়
চোখকে জুড়িয়ে দেয়। সাদামাটি এলাকার আশপাশ জুড়ে বেশ কয়েকটি আদিবাসী বসতি
রয়েছে তবে তারা সংখ্যায় অনেক কম। অধিবাসীদের অধিকাংশই বাঙালি মুসলমান।
রানীখং
গির্জা–
দুর্গাপুর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তর সীমান্তে
পাহাড়ের চূড়ায় রানীখং গির্জা অবস্থিত। এ পাহাড়ের চূড়া থেকে বিরিশিরির সৌন্দর্য যেন
অন্য মাত্রা পায়।
কংশ
নদী–
কংশ নদী ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত
হয়েছে। ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগের তুরার কাছে গারো পাহাড়ে এই নদীর
উৎপত্তি।
ক্ষুদ্র
নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি–
দুর্গাপুরের বাসস্ট্যান্ডের পাশেই অবস্থিত ক্ষুদ্র
নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি। এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার
নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে।
রাশিমণি স্মৃতিসৌধ-
দুর্গাপুর বাজার থেকে বিজয়পুর পাহাড়ে যাওয়ার পথে কামারখালী বাজারের পাশে বহেরাতলীতে অবস্থিত রাশিমণি স্মৃতিসৌধ। সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘বগাঝরা’ নামক গ্রামটি ছিল ব্রিটিশবিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে একটি। রাশিমণি সেই গ্রামের একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। ব্রিটিশ মহাজন ও জোতদারদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী।
টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধঃ
১৯৩৭-৫০ সালে তখনকার জমিদার বাড়ির ভাগ্নে কমরেড মণিসিংহের নেতৃত্বে জমিদারদেরই বিরুদ্ধে শুরু হয় টঙ্ক আন্দোলন।টংক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ। সুসং দুর্গাপুর এর এম.কে.সি.এম হাই স্কুলের পাশে গেলেই চোখে পড়বে এ স্মৃতিসৌধটি। মরহুম রাজনীতিবিদ জালাল উদ্দিন তালুকদারের দানকৃত জমিতে এ স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণিসিংহের মৃত্যু দিবসে এখানে পাঁচ দিনব্যাপী মণিসিংহ মেলা নামে লোকজ মেলা বসে।
আত্রাখালি নদী-
আত্রাখালি নদী সুসং দুর্গাপুর বাজারের উত্তর দিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
জমিদার বাড়ি-
একসময় দুর্গাপুর ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। ৩ হাজার ৩৫৯ বর্গমাইল এলাকা ও প্রায় সাড়ে ৯শ’ গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সুসং রাজ্যের রাজধানী ছিল এটি। বর্তমানে এটি নেত্রকোণার একটি উপজেলা। সোমেশ্বর পাঠক থেকে শুরু করে তার পরবর্তী বংশধররা প্রায় ৬৬৭ বছর শাসন করেন এ রাজ্য।
যাওয়ার উপায়-
ঢাকা থেকে সুসং দুর্গাপুরে যাওয়ার এবং ফেরার জন্য রয়েছে বাস সার্ভিস। ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সুসং দুর্গাপুরে উদ্দেশ্যে নাইট কোচ সহ দিনে ও রাতে বেশ কিছু বাস ছেড়ে যায়। ট্রেনেও যাওয়া যায় সেক্ষেত্রে বাকীপথটুকু বাসে যেতে হবে।
থাকার ব্যবস্থা-
এখানে বিভিন্ন মানের গেস্ট হাউস আছে। জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, ইয়ুম মেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন রেস্ট হাউজ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি গেস্টহাউজ রয়েছে। যেখানে রুম ভাড়া পড়বে ৮০০ টাকা। এ ছাড়া এখানে কিছু মধ্যমমানের হোটেল আছে। হোটেল গুলশান, হোটেল জবা, হোটেল সুসং, স্বর্ণাগেস্ট হাউজ, নদী-বাংলা গেস্ট হাউসে ২০০-৪৫০ টাকার মধ্যে থাকা যায়।