দু’শো বছরের ঐতিহ্যের রাশমেলা দুবলার চরে
Tweet
সমুদ্রবিধৌত বাংলাদেশে
রয়েছে বিশ্বের একমাত্র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন। আর দুবলার চর বাংলাদেশ
অংশের সুন্দরবনের দক্ষিণে,
কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি
দ্বীপ। এটির অবস্থান মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের দক্ষিণে
সমুদ্রের কোলঘেঁষে। যা চর নামে হিন্দুধর্মের পূণ্যস্নান, রাসমেলা
এবং হরিণের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর।
দুবলারচর সুন্দরবনের
৪৫ এবং ৮ নম্বর কম্পার্টমেন্টে অবস্থিত। এই চরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, কোকিলমনি, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিলা,
অফিসকিলা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, মেহের আলির চর এবং শেলার চর নিয়ে দুবলার
চর গঠিত। দুবলার চর মূলত জেলে গ্রাম।
বর্ষা
মৌসুমের ইলিশ শিকারের পর বহু জেলে চার মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা,
সাতক্ষীরা থেকে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে সেখানে। মেহেরআলীর খাল,
আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেলা,
নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর ইত্যাদি এলাকায় জেলে পল্লী স্থাপিত হয়। এই চার মাস
তারা মাছকে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখান থেকে আহরিত শুঁটকি চট্টগ্রামের
আসাদগঞ্জের পাইকারী বাজারে মজুদ ও বিক্রয করা হয়। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের সদর
দপ্তর বাগেরহাট থেকে মাছ সংগ্রহের পূর্বানুমতিসাপেক্ষে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে
প্রবেশ করে থাকেন। দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর
বিএলসি বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল
(জ্বালানি কাঠ) কনজাম্পশন ইত্যাদি প্রক্রিয়া বন বিভাগকে রাজস্ব প্রদান করে মৎস্য
ব্যবসায়ীগণ সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান। এছাড়াও আহরিত শুঁটকি মাছ পরিমাপ করে নিয়ে
ফিরে আসার সময় মাছভেদে প্রদান করেন নির্ধারিত রাজস্ব।
ঠিক কবে থেকে জেলেরা এখানে
মৎস্য আহরণ করতে আসে কিংবা কবে থেকে এখানে রাশমেলা শুরু হয়, কারা এ চরের নাম দুবলারচর
রেখেছিল, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে রাশমেলা মনিপুরীদের
প্রধান উৎসব, এটি রাশলীলা নামেও পরিচিত। বিভিন্ন স্থানে
হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও এ উৎসব পালিত হয়। অগ্রহায়ণ মাসের রাশপূর্ণিমা তিথিতে সুন্দরবনের
দুবলারচর (এবার ১১ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত তিনদিনব্যাপী), মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ
এবং কুয়াকাটার কলাপাড়া সমুদ্রসৈকতে এ উৎসব পালিত হয়।
দুবলারচরের যে স্থানে
মেলাটি হয়, তার নাম আলোরকোল। এখানে মেলার তিনদিন আগে থেকে অনেক অস্থায়ী দোকানপাট বসে।
দোকানে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি, খেলনা, ফলমূল,
মাটি ও ঝিনুকের তৈরি বিভিন্ন অলঙ্কারাদি পাওয়া যায়। এখানে একটি
অস্থায়ী মন্দির তৈরি করা হয়, তাতেই চলে পূজা অর্চনা। বিকেল
থেকে শুরু হয় বাউল গান, কবিগান, কীর্ত্তন,
জারি, গাজিরগানসহ বিভিন্নরকম লোকানুষ্ঠান।
রাশ পূর্ণিমায় সারারাত অনুষ্ঠান দেখার পরে খুব ভোরে প্রথম জোয়ারে সবাই পুণ্যস্নান করতে সমুদ্রের পাড়ে আসে। ঢেউ ক্ষেপণের সময় মন্ত্রাদি উচ্চারণ করে ডাব, মিষ্টি, ফলমূল, জীবজন্তু উৎসর্গ করে। সন্তানাদি জন্মগ্রহণ না করলে পুণ্যস্নানের সময় পুণ্যার্থীরা সন্তান লাভের জন্য মানত করে এবং ডাব, আগরবাতি ও বাতাসা সামনে রেখে আঁচল পেতে বসে থাকে। তাদের ধারণা, ঢেউয়ের সাথে ডাবটি আঁচলে ধরা দিলে তারা সন্তান লাভ করবে। বিবাহযোগ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী পুরুষ পুণ্যস্নানের সময় বিবাহের জন্য মানত করে। কেউ কেউ পাপ মোচনের জন্য এখানে আসে এবং সমুদ্রের তরঙ্গ মেলায় মধ্যে ডুবে ঢেউয়ের পুণ্যস্নান করতে থাকে। অনেক পুণ্যার্থীর মতে, এই পবিত্র স্থানের মাধ্যমে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। মকরসংক্রান্তি অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষ দিন গঙ্গা সাগরের মেলা হয়, যার সঙ্গে এই মেলার কিছুটা সম্পর্ক আছে বলে অনেকে দুবলারচরকে পুণ্য স্থান বলে মনে করেন।
#রাশমেলা #দুবলারচর #সুন্দরবন #শুটকিপল্লী