ইউরোপ ভ্রমণের খুঁটিনাটি

Share on Facebook

পর্যটনিয়াঃ ইউরোপের ভিসা পাওয়ার জন্য ব্যাংক ব্যালান্স কেমন থাকা
জরুরী?

সুমনঃ কেউ যদি ইউরোপ ভ্রমণে যেতে চায় তাহলে সাধারণভাবে ধরে নেয়া
হয় যে, সেখানে তিনি অন্তত দশ দিন থাকবেন। এটা একটা সাধারণ হিসাব।
এই দশদিনের প্রতিদিন তিনি অন্তত ২৫০ ইউরো খরচ করবেন, তাহলে দশ দিনে মোট ২৫০০ ইউরো বা প্রায় ২লাখ ৫০ হাজার টাকা
খরচ করবেন। এর বাইরে বিমান ভাড়া ধরা যাক মোটামুটি ১ লক্ষ টাকা। তাহলে আপনার ইউরোপ
ট্যুরের খরচ ধরে নিতে পারি জনপ্রতি সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো। সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ
হলে ব্যংক ব্যালান্স মোটামুটি ৫ লাখ দেখালেও হয়। কারণ আপনার জমানো ৫ লাখ টাকা না
থাকলে আপনি সাড়ে তিনলাখ টাকা খরচ করে ইউরোপ ভ্রমণে যাবেন না। তবে এখানে একটা বিষয়
খেয়াল রাখতে হবে এই জমানো ৫ লাখ টাকার সোর্সটা ঠিক মতো দেখাতে হবে।

পর্যটনিয়াঃ জমানো টাকার সোর্স বা উৎস বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন …

সুমনঃ জমানো টাকার সোর্স মানে আপনার মাসিক রোজগারের সাথে মাসিক ব্যায়ভারের
পার্থক্য। আপনি সারা মাসে যা রোজগার করেন তা থেকে যাবতীয় ব্যয় বহন করার পর যে টাকা
অবশিষ্ট থাকে সেটা আপনি জমা করেন। আপনার রোজগারের সাথে জমার পরিমাণ সংগতিপূর্ণ হতে
হবে। যেমন, ধরাযাক
আপনার মাসিক আয় হচ্ছে একলাখ টাকা। আপনার পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন বা চার জন। আরও
ধরে নিই, আপনি ভাড়া বাসায় থাকেন। এখন তাহলে সারা মাসে আপনার খরচ কতো হতে পারে? তিন চার সদস্যের পরিবার মানে কমপক্ষে দুই রুমের একটা বাসা
যার ভাড়া আনুমানিক বিশ হাজার টাকা। বাজার খরচ, স্কুল বা কলেজের খরচ ইত্যাদি সব ধরণের খরচ ধরে নিলাম আরও
প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। তারমানে আপনার মাসিক আয় এক লাখ টাকা হলে ব্যায় প্রায় ষাট
হাজার টাকা। তাহলে আপনি প্রতিমাসে জমাতে পারবেন সর্বোচ্চ চল্লিশ হাজার টাকা। এভাবে
৫ লাখ টাকা জমাতে আপনার মোট সময় লাগবে অন্তত একবছর। কিন্তু আপনি যদি দেখান যে, প্রতিমাসে একলাখ রোজগার করে আপনি ৬ মাসেই ৫ লাখ টাকা জমাতে
পেরেছেন তাহলে সেটা সমঞ্জস্যপূর্ণ হবে না এটা মোটামুটিভাবে বলাই যায়। এরকম কোনো
স্টেটমেন্ট এম্বেসিগুলো ফলস স্টেটমেন্ট হিসেবে কাউন্ট করে ফলে ভিসা পাওয়ার
সম্ভাবনা কমে যায়। এজন্য আপনার সোর্স অব সেভিংস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পর্যটনিয়াঃ ইউরোপ ভ্রমণের জন্য সাধারণত কতদিন আগে থেকে প্রসেসিং শুরু
করা দরকার?

সুমনঃ যেহেতু ভিসা প্রসেসিং কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তাই
প্রত্যাশিত ভ্রমণের তারিখের অন্তত দুই বা তিন মাস আগে ভিসা প্রসেসিং শুরু করা
ভালো। আবার ভ্রমণের তারিখ যত কাছাকাছি আসে বিমানের টিকেটের দামও তত বাড়ে। ভিসা
পাওয়ার আগে টিকেট ইস্যু করাটাও ঝুকিপূর্ণ। সুতরাং ঝুঁকি এড়ানোর জন্য ভিসা পাওয়ার
পর টিকেট ইস্যু করাই ভালো। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে অন্তত দুই-তিন মাস সময় হাতে
নিয়ে প্রসেসিং শুরু করা ভালো।

পর্যটনিয়াঃ বাংলাদেশিদের মধ্যে ইদানিং বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা বাড়ছে, নির্দিষ্ট করে বললে ইউরোপ বা অ্যামেরিকা ভ্রমণের প্রবণতা
বাড়ছে,
এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

সুমনঃ আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, ইউরোপ বা অ্যামেরিকা থেকে ট্যুরিস্ট আমাদের দেশে তেমন একটা
আসছে না কিন্তু আমাদের দেশ থেকে অনেকেই ইউরোপ বা অ্যামেরিকা ভ্রমণে যাচ্ছে কেন?

পর্যটনিয়াঃ ঠিক তাই……

সুমনঃ দেখুন বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ বা অ্যামেরিকা মহাদেশে ভ্রমণের
প্রবণতা বেড়েছে মূলত দুটো কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে মানুষের ভ্রমণ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য
বেড়েছে আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ইউরোপ অ্যামেরিকা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহও বেড়েছে।
আর্থিক সামর্থ্যের পাশাপাশি আগ্রহ কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার। যেমন ধরেন একজন
অ্যামেরিকান পর্যটকের বাংলাদেশ ভ্রমণ করার মতো সামর্থ্য আছে কিন্তু আগ্রহ নাই।
ভিনদেশী পর্যটকদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহ না থাকাটাই মূল কারণ বলে আমি মনে
করি। বাংলাদেশ যদি বিদেশী পর্যটক আনতে চায় তাহলে বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে আগ্রহ
তৈরী করার বিকল্প নাই। এখন দেখতে হবে এই আগ্রহ তৈরীর কাজটা সরকার কিভাবে করে।
এখানে সরকারী খাতের তুলনায় বেসরকারী খাতের তেমন কিছুই করার নাই বলতে গেলে। ইউরোপ
বা অ্যামেরিকা মহাদেশ দেখার আগ্রহ বাংলাদেশিদের মধ্যে কেমনে জন্ম নিলো? ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অনেক প্রবাসি বাস করে সেটা
তো অবশ্যই একটা কারণ। নিকট আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে যাওয়া যেমন একটা ফ্যাক্ট,
তেমনি পড়ালেখা করার জন্যও কিন্তু বিরাট একটা সংখ্যা প্রতিবছর বিভিন্ন মহাদেশে
যাচ্ছে। আবার চিকিৎসা করতেও আজকাল অনেকেই অ্যামেরিকা পর্যন্ত যাচ্ছেন। যাদের
এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশই দেখা হয়ে গেছে তারা এখন এশিয়ার বাইরের মহাদেশ ভ্রমণে
যেতে আগ্রহী থাকে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদিও বিশ্ব অর্থনীতির তুলনায় অনেক ছোট, তবুও ধীরে ধীরেতো অর্থনীতি বড় হচ্ছে। দেশে করপোরেট হাউজের
সংখ্যা বাড়ছে। এই কর্পোরেট হাউজগুলো তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন
ইনসেন্টিভ অফার করছে। এভাবে একটা বড় সংখ্যা ইউরোপ অ্যামেরিকা ভ্রমণে যাচ্ছে।

পর্যটনিয়াঃ এই বহির্গমন প্রবণতা আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সুমনঃ দেশের জনগণের বহির্গমন প্রবণতা মূল্যায়ন করতে গেলে আসলে
বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে করতে হবে। বহির্গমন প্রবণতা সাধারণ দৃষ্টিতে লস ফ্যাক্টর
হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বহির্গমন প্রবণতা মানেই হচ্ছে দেশের টাকা বাইরে
ড্রেন আউট হওয়া। পর্যটন শিল্প থেকে একটা দেশের অর্থনীতি যত রকম সুবিধা নিতে পারে তার
প্রায় নব্বই ভাগই নিতে পারে হোস্ট কান্ট্রি। কারণ আপনি যে দেশে যাবেন আপনার
কর্মকাণ্ডগুলো তো আসলে সেই দেশেই সম্পন্ন হবে। ফলে সেই দেশেরে অর্থনীতিও বড় হবে
আবার কর্মসংস্থানও বেড়ে যাবে। সুতরাং একথা বলাই যায় যে, বাংলাদেশী পর্যটকদের এই বহির্গমন প্রবণতা দেশের জন্য একটা
খারাপ দিক। আবার বহির্গমন প্রবণতারও কিছু ভালো দিক আছে। যেমন বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলো
তাদের কর্মীদের প্রডাক্টিভিটি (উৎপাদন ক্ষমতা) বাড়ানোর জন্য বিদেশ ভ্রমণের
ব্যবস্থা করে। এতে করে কর্মীগন নতুন পরিবেশের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়, নতুন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এইভাবে নতুন
গন্তব্য, নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন আবহাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো কর্মীদের মনোজগতে একটা
ধনাত্মক পরিবর্তন আনে যা দিন শেষে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে। আর
গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে বহির্গমন ঠেকানোর কোনো রাস্তাও নাই। পর্যটন শিল্প থেকে
ইতিবাচক সাড়া পেতে বাংলাদেশের উচিৎ আউট বাউন্ডে বাধা না দিয়ে ইন বাউন্ডে জোর
দেওয়া। ইন বাউন্ড পর্যটন কিভাবে বাড়ানো যায়, আদৌ বাড়ানো যায় কি-না বা বাড়ালেও কতোটুকু বাড়ানো
যুক্তিযুক্ত সেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করা।

পর্যটনিয়াঃ মূল্যবান সময় ও বক্তব্যের জন্য অনেকধন্যবাদ আপনাকে।

সুমনঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরও জানতে পড়ুন ইউরোপের ভিসা পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়

Leave a Reply