পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান
Tweet
আগের দিন জয়গা ও ফুন্টশোলিং ঘুরাঘুরির পর, পর দিন সকালে শুরু হলো আমাদের থিম্পু যাত্রা।
পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে সোনালী সূর্য। শিশির কণায় আলোকচ্ছটায় সুরভিত সুবাসিত ফুন্টশোলিংকেন্দ্রের জাংটাপেলেরি মন্দিরে ভোরের প্রার্থনা শেষ করে ঘরে ফিরেছে ধর্মপ্রাণ ভূটানীরা। যাত্রার সব আয়োজন শেষ করে থিম্পুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো আমাদেরও। গতকালের সমুজীপ এবং গাইড কাম ড্রাইভার কিংগা প্রস্তুত। কিংগা নম্র ও মার্জিত এক ভদ্রলোক। বলাবাহুল্য, শুধু কিংগা নয় ভূটানীরা সবাই অত্যন্ত ভদ্র ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মানুষ মানূষকে ঠকাতে পারে তা তারা জানে না। বরং মানুষকে সর্বাধিক সম্মান করতে হয়, ধারনাই লালন করে তারা। যা কিনা ভূটান ভ্রমন থেকে অর্জিত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষনীয় বিষয়।
শহর থেকে
অনতিদূরে উচু পাহাড়। কিংগার সুদক্ষ ড্রাইভিংয়ে ঢালু পাহাড়ী পথ বেয়ে আমরা সহজেই উঠে
পড়লাম পাহাড়ের চূড়ায়। গাড়ি ব্রেক, সাইট সিয়িং। চূড়া থেকে দেখা যায় পাহাড়ের
পাদদেশ। সকালের সোনালী রোদে সোনার রঙে রঞ্জিত ফুন্টশোলিং শহর। গতকাল দেখা সুউচ্চ
দালানগুলো আজ আমাদের থেকে কত নীচুতে। সাদা রঙের দালান গুলো দেখে মনে হচ্ছে, হেমন্তের
সকালে আবহমান বাংলার কোনো এক শুকিয়ে যাওয়া ঝিলের মাঝে চিকচাক জলের নালি, ছোট মাছ শিকার
করতে নিরিখে চেয়ে রয়েছে সেথায় ধবল বকের সারি। পাহাড়ের চূড়ায় সজ্জিত কারাবন্দি মঠ
কতই না কারুকার্য খচিত ইট কাঠের বাড়ি, প্রাচীন বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষ ধারণকারী
কাঠামো, নান্দনিক স্তুপ, প্রার্থনা ড্রাম,
প্রার্থনা পতাকা,
দেবতাদের মূর্তি
চমকপ্রদ রঙের প্রদর্শন, অবিশ্বাস্যভাবে অলংকিত ও প্রাণবন্ত করেছে মঠটিকে। যা বিশ্বাসীদের
যোগসূত্র তৈরি করতে পারে আধ্যাত্নিক পরিবেশের সাথে। শেষ হল দর্শন আর ফটোসেশন। শুরু
হল পূনরায় যাত্রা।
নতুন কিছু দেখার আনন্দে আত্মহারা আমরা প্রফুল্ল ছিলাম। গল্প-আড্ডা চলছিল বেশ, কিংগা কিছু বোঝে-কিছু বোঝে না, তবুও তাল মিলানোয় জুড়ি ছিলো না তার। এমনই সময় আকষ্মিক এক ঘটনা। মেঘের এক খন্ড ধরলো গাড়ির মুন্ডু, ভিজলো গাড়ির গা, কাপলো আমাদের হাত পা। পুলকিত শিহরণে আনন্দ না আতংক বুঝতে বোধ হয় সময় লাগল আমাদের। ততক্ষনে আমরা হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের গা ঘেষে বয়ে যাওয়া জিগজাগ ঢালু-সরু পথ অতিক্রম করছি। পাহাড়ের উপর পাহাড়, তার উপরে ঘন অরন্য, তার ফাঁকে ফাঁকে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ, মেঘের উপর চকমকে রুপালী আলোকরশ্মি। রূপালী সে প্রকৃতি অল্পতেই হয়ে যায় প্রাণের প্রেয়সী। কি অপরূপ প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য! হার মানায় কবির কল্পনাকেও। এতক্ষনে বুঝতে সহজ হলো, কেন ভূটানকে অক্সিজেনের দেশ বলা হয়!
পাহাড়ের বুকের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু সে পথ থেকে নিচে তাকাতেই পিলে চমকে যায়, পথের কিনার থেকে নিচে তাকালে দেখা যায় হাজার হাজার ফুট গভীর গিরিপথ। দূর্ঘটনা ঘটলে গাড়িটি নিচে পড়তে যেমন সময় লাগবে, তেমনই গাড়ির ধ্বংসস্তুপ উদ্ধার করাও হবে দুঃসাধ্য। এমন পথে চলতে সুস্থ্য যেকোনো মানুষেরই ভয় হবে। একারণেই ভূটান ভ্রমন দুঃসাহসিক হয়। পাহাড়ী গ্রাম, গিরিপথ, অরণ্য, নদী, ঝর্ণা কখনো পাথুরে পাহাড়ের নান্দনিক দৃশ্য দেখতে যেন চোখের পলক পড়ে না। চোখ ভরলে মন ভরে না। মন ভরলে চোখ ভরে না। তবে পেট ভরার ব্যবস্থা মোটামুটি ভালোই আছে সেখানে। মোটেল কিংবা বিস্কিট চানাচুর বা ফলমূলের দোকান রয়েছে পথের ধারে। আমাদেরও সুযোগ হল। যে মেয়েটির দোকানে আমাদের যাত্রা বিরতি হয়েছিল, তার নাম সোনাম। অল্পতেই গড়ে উঠেছিল অনেক বেশি সখ্যতা। উজ্জল-উচ্ছল, প্রাঞ্জল মিষ্টি মেয়েটি যেন অপেক্ষায় ছিল আমাদের বরণ করে নেবার জন্য। আমাদেরকে পাওয়ার পরে কতইনা তার উল্লাস। হাসি-ঠাট্টা, গল্প-আড্ডায় পানি পান আর চুইন গাম আতিথেয়তায় যাত্রার ক্লান্তি দূরীভূত হল সবার।
পাহাড়ি সে পথ, সে অরণ্য, সাথে আসেনি আমাদের। কিন্তু ঝর্নার সুরে সুর মিলিয়ে লাবণ্যময় পাহাড়ী সেই মেয়েটির অকৃত্রিম হাসি ফেলে আসতে পারিনি কেউ। আজও গেঁথে রয়েছে সে সবার হৃদয়ের মানস্পটে। সোনাম পর্ব শেষ করে আমরা পৌছে গেলাম ভূটানের রাজধানী থিম্পু।
২ thoughts on “পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
ধন্যবাদ সুমন ভাই