পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান
Tweet
পাহাড় থেকে পারো ফিরেই সোজা হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে কোন কথা না বলেই শুয়ে পড়লাম। ঘুম নয়, চোখ বন্ধ। কিছু সময় পর, দল বেঁধে সবাই রুমে ঢুকলো। ডাকছে আমাকে, কিন্তু আমি নিশ্চুপ। মুখে কথা নেই কোন।
মাহবুব ভাই শুধু করুন সুরে বলল, তোরা এখন ভাইকে ডাকিস না। ভূটানী কুত্তার তাড়া খেয়ে ভদ্রলোক বড় ক্লান্ত। পরে কথা হবে।
তারপর ভূটানী কুত্তা, গাকি, সোনাম, গার্লফেন্ড সবকিছুর মিক্সারে আমাকে গুলিয়ে চিয়ার্স করে সবাই পান করলো অমৃতের রস।
ভাবলাম, উল্লাস আনন্দের কেন্দ্র আমি। তাই আমার মৃত্যু এতো সহজে হওয়া উচিত নয়।
সবাই মিলে জোর করে কোলে তুলে নিয়ে গেল খাবার টেবিলে। আলু ভর্তা, ডাল, ডিম…আহ!
পাঁচ ফোড়নের গন্ধে মাতোয়ারা অবস্থা। হোটেলের রান্না নয়, তাদের মাল সামানায় রান্না বন্ধুদের। পাহাড়ে উঠার মতো বোকামী থেকে রক্ষা করে সকাল সকাল হোটেলে এসে পেট ভরে খাওয়ার মত উপযোগী করে ভালো রান্নার মতো মহৎ কাজটা করেছে তারা। টি-টুয়েন্টি ম্যাচের মত ধপাস ধপাস চার ছয় প্লেট শেষ।
আর হবে নাইবা কেন! সপ্তাহ জুড়ে কেউ ভাল খায় নাই।
খাওয়ার শেষে মিটিং।
অনেকের অনেক কথা সারারাতেও শেষ হবার মত নয়। কথা শেষ না হলেও কথার মাঝে বুঝলাম, আমি
আর মামুন ভাই-ই কেবল জিদ্দি ছিলাম টাইগার নেষ্ট জয় করবোই। বাকিরা পাহাড়ের কিছু দূর
উঠার পর ক্লান্ত এবং ফিরতি লোকদের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলো যে অবেলায় সেখানে ওঠা
সম্ভব নয়। আর কোনভাবে ওঠা সম্ভব হলেও বেলা থাকতে থাকতেই নামা সম্ভব নয়। তাই তারা
আর সামনে না এগিয়ে পিছু হটেছে স্বছন্দে। আর যেহেতু প্রতিকূল পরিবেশে দীর্ঘ সময়
অপেক্ষা করা কষ্টকর, তাই হোটেলে এসে আলু ভর্তা, ডাল, ডিম রান্নায় মত গুরুত্বপূর্ণ
কাজটি করেছে।
আর আমাদেরকে নিতে সোহেল ভাই কিন্তু ঠিকই যথাস্থানে পৌঁছেছে, শুধু যথা সময়ে নয়। গার্লফ্রেন্ডের তৈরী হতে কিছুটা সময় লেগেছিল, তাই আর কি! কি হয়েছে তাতে!
গার্লফ্রেন্ড বলে কথা। তারপরে সে না থাকলে ক্যামেরার দ্বিতীয় বাড়িটা বড় একটা দুর্ঘটনাও ঘটাতে পারতো!
বড় কথা হলো, কিংগার গার্লফ্রেন্ড হলেও সে আমাদের সবার ফ্রেন্ড। গত তিনবছর যাবত বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলায় ভূটানী পণ্যের নিজস্ব স্টল থাকে তার। বাংলাদেশের আতিথিয়তায় সে খুব সন্তুষ্ট। তাই সকল বাংলাদেশিই তার ফ্রেন্ড। বাংলাদেশ তার সেকেন্ড মাদারল্যান্ড। তাকে নিয়ে কারও কোন অভিযোগ থাকার কথা নয়। সবাই ভুল বুঝতে পারলো নিজের। আপোষ করতেও সময় লাগলো না তাই। মিটিং শেষে হাস্য বদনে, সবাই শোবার ঘরের যাত্রী। অবসন্ন-পরিশ্রান্ত শরীরে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেন খুলে খুলে কয়েক টুকরো! তাই হয়তো ঘুমও হলো কুম্ভকর্ণের ঘুম।
সকালে কাউকে ডাকতে হলো না আর। কারণ সেদিনই আমাদের ফেরার পালা। চার-চারটি ইমিগ্রেশন পার হতে হবে। তাই সময় অপচয়েরও সুযোগ নেই কোন। বিদায় পর্ব শেষে শুরু হল যাত্রা পর্ব। যাবার পথে ভূটানের নয়নাভিরাম যে সৌন্দর্য্য দেখেছিলাম, ফেরার পথেও সেই একই দৃশ্য দেখলাম আবার। সত্যিকার অর্থেই সৌন্দর্য্যের মায়াজাল এতোটাই মায়াভরা যে শতবার দেখলেও মিটবেনা এই দেখার ক্ষুধা।
ফুন্টশোলিং রাস্তায় মানুষের ভীড় অনেক। হঠাৎ করে এতো মানুষ ভুটানে! কৌতুহলবশত জানলাম, এটা মানুষের হাট। ফুন্টশোলিং সংলগ্ন ভারতের আশপাশ থেকে মানুষ প্রতিদিন সকালে ভীড় জমায় সেখানে। ভূটানীরা চুক্তির ভিক্তিতে কামলা হিসাবে নিয়ে যায় তাদেরকে। ভিসা বা পাসপোর্টের দরকার হয় না কোন। ন্যাশনাল আইডি কার্ড থাকলেই হয়।
যাক! ঢাকার রাস্তায়ও এমন একটি মানুষের হাট রয়েছে। সেখানে অবশ্য সবাই দেশি মানুষ। বিদেশি কেউ নয়। তারপরেও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের মিল খুঁজে পেলাম এই ক্ষেত্রে। ফুন্টশোলিং, জয়গা ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে চ্যাংড়াবান্ধার উদ্দেশ্যে শুরু হলো যাত্রা।
কিংগাকে টিপস দিয়ে, তাকে বাংলাদেশ ভ্রমনের নিমন্ত্রণ জানিয়ে, বিদায় নিয়ে চ্যাংড়াবান্ধায় আসলাম আসলাম আমরা যখন, দুপুর গড়িয়ে ততক্ষণে বিকেল। এদিকে হুলস্থুল অবস্থা তখন। ভূটান, দার্জিলিং, গ্যাংটক ফেরত বাংলাদেশিদের ভীড়ে, ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনের লোক বিহব্বল।
তাছাড়া তালপাতার ছাউনিতে গড়া ইমিগ্রেশন অফিসও যে এতো মানুষের ভার সহ্য করার মত নয়! তাই তারাও দ্রুত ছাড়তে পারলেই বাঁচে।
দেশের মাটিতে পোঁছালাম যখন,
তখন আমরা পাখা মেলা স্বাধীন পাখি যেন। যেথায় যাই, কোন বাঁধা নেই। মনের গভীরে
অনুভূত হলো স্বাধীনতার সুখ। সন্ধ্যা ৬টা তখন।
গাড়িতে আসতে সময় লাগবে ঘন্টাখানেক। তাই কাউন্টারে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ রেখে ফ্রেশ হলাম সবাই। বুড়ির হোটেলে খেলাম শুধু পেট ভরে নয়, পরাণ ভরেও। কাউন্টারের সামনের মাঠে দল বেঁধে বসে আছি সবাই। কিছুক্ষণ পর পর চায়ের অর্ডার, কারও হাতে সিগারেট, কেউবা মনের আনন্দে গেয়ে যাচ্ছে গান-
মিলন হবে কত দিনে,
আমার মনের মানুষের সনে
চাতক প্রায় অহর্নিশি
চেয়ে আছে কালো শশী
হবে বলে চরণদাসী
তা হয়না কপাল শুনে…
রাত্রি যখন ১২টা, তখনো আছি কাউন্টারের সামনেই। ঘন্টাখানেক আর শেষ হচ্ছে না। মেঘলা আকাশ, তাই জ্যোৎস্না থাকলেও চলছে আলো-আঁধারের খেলা।
ভূটানের মত প্রচন্ড শীত নেই। আছে মৃদুমন্দ বাতাস কেবল। মেয়েরা বিশ্রামে আছে কাউন্টারের ভিতরে। আমি একটু দূরে বসে আকাশে পানে চেয়ে আছি। রূপালী আলোর মাঝে কোণা ভাঙ্গা সোনালী চন্দ্র খন্ড যেন একদম নিশ্চল। ছুটে চলেছে শুধু মেঘমালা। আমাদের গাড়ি যখন চলবে, মামা তখন ঠিকই সচল হবে। মাহাবুব ভাই জোরে ডাক দিয়ে বললো, কিহে বৈরাগী! তুমি গাকি নাকি সোনামের কথা ভাবছো?
গাড়ির অপেক্ষায়
যন্ত্রণায় ভূগছি, নাকি বিষন্ন মনে, আকাশ পানে চেয়ে তাদের কথা ভাবছি, তা বুঝতে
পারলাম না। তাই তার ডাকে সাড়া দেওয়াও হল না। ভ্রমন শেষ করে স্মৃতিগুলো নিয়ে গল্প
লেখা শেষ করলাম যখন, ঠিক শেষের লাইনে এসে আমার মনে পড়লো, তখন আমি ভেবেছিলাম জন
বুরগস (John Burroughs) এর বিখ্যাত সেই উক্তি-
I go to nature
To be soothed and healed,
And to have my sense put in order.
উড়ে বেড়াই আর ঘুড়ে বেড়াই
খুঁজি ফিরি আমি প্রকৃতি,
সুস্থ্য আমি, শান্ত আমি
সাজিয়ে নেই অনুভূতি।
One thought on “পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান”
-
Pingback: পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান | পর্যটনিয়া
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.