সরকারী কার্যকর পদক্ষেপ ছিল বলে ইলিশের বাম্পার উৎপাদন
Tweet
চলতি শীত মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে জেলেদের জালে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ইলিশ ধরা পড়ছে। ইলিশের আকার বড় হওয়ায় বিস্মিত জেলে ও ব্যবসায়ীরা। তবে ইলিশ গবেষকরা বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন। জেলে ও মাছ ব্যাবসায়ীরা বলছেন, বিগত বিশ বছরেও এমন সময় এতো দেখা পাওয়া যায়নি। হোটেল-মোটেল গুলোতে গেলেই দেখা যাবে হরেক রকম ইলিশের রান্না।
এবার শীত মৌসুমে ইলিশ বেশি পাওয়ার পক্ষে বেশ কয়েকটি যুক্তি দিয়েছেন ইলিশ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা এবং জাটকা নিধন বন্ধে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপ কার্যকর হওয়ায় ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী শীত মৌসুমগুলোতেও এভাবে ইলিশ পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা।
এ সময় বাড়তি ইলিশের চাপে বেশ সরগরম চাঁদপুরের পাইকারি মাছের বাজার। প্রতিদিনই শত শত মণ ইলিশ মিলছে শহরের বড়স্টেশন মাছঘাটে। কিন্তু দাম নিম্নমুখী হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা আছে। তাঁরা বলছেন, এখন যে পরিমাণ ইলিশ মিলছে, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। মৎস্যবিজ্ঞানীদেরও একই মত।
মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য মতে, এ বছরের জানুয়ারিতে বিভাগের ছয় জেলার স্থানীয় নদ-নদীতে ১৯ হাজার ৫৯১ মেট্রিক টন ইলিশ পাওয়া গেছে। এর আগে সর্বাধিক পরিমাণ ইলিশ পাওয়া গিয়েছিল ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ২০ হাজার ৩৪৭ মেট্রিক টন। মাঝের তিন বছর যথাক্রমে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ১২ হাজার ২০ মেট্রিক টন, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ৯ হাজার ৬৫৭ মেট্রিক টন এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ১৭ হাজার ৬৯২ মেট্রিক টন ইলিশ পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগে। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীর নদ-নদীতে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, একোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের প্রভাষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, সাগরে ইলিশ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে। তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও ইলিশের গতি-প্রকৃতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। শীতে নদীতে ইলিশ বেশি পাওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে।
ইলিশের আকার বিষয়ে মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ইলিশ সারা বছর ডিম ছাড়লেও ৮০ শতাংশ ইলিশ ডিম ছাড়ে আশ্বিনের পূর্ণিমায়। সে সময় (অক্টোবর মাস) ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে মা ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়ে। এ মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিনই ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় জাটকা (১০ ইঞ্চির কম) ধরায় আট মাসের নিষেধাজ্ঞা। জাটকা মাঝারি আকারের ইলিশে পরিণত হওয়ার মধ্যেই অভয়াশ্রমগুলোতে ১ মার্চ থেকে দুই মাস মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়।
চাঁদপুরে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান চলতি শীত মৌসুমে বেশি ইলিশ পাওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘২০০৫ সাল থেকে জাটকা নিধন এবং ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ইলিশ ধরা বন্ধ রয়েছে। এতে করে আমাদের সাগর এখন ইলিশে পরিপূর্ণ।’
শীতে পাওয়া ইলিশের স্বাদ প্রসঙ্গে ড. আনিছুর রহমান বলেন, ইলিশের চলার গতি ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার। এক দিনে তারা ৭২ থেকে ৭৪ কিলোমিটার সামনের দিকে ছুটতে পারে। এ গতিতে গভীর সাগর থেকে পদ্মা-মেঘনা কিম্বা তার আশপাশের নদ-নদীতে পৌঁছতে একটি ইলিশের দুই-তিন দিন সময় লেগে যায়। ফলে ক্লান্ত ইলিশের শারীরিক গঠনও চুপসে যায়। আবার সাগরের লোনা পানি থেকে নদীর মিঠা পানিতে পৌঁছে তার খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটে। মিঠা পানিতে অন্তত ১৫ দিন থাকতে পারলে ইলিশের স্বাদে পরিবর্তন হয়।
এ অবস্থায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে ইলিশ রপ্তানির তাগিদ দিয়েছেন চাঁদপুরের ব্যবসায়ীরা। একই মত চাঁদপুরে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমানের। তিনি বলেছেন, এখন শুধু শীতেই নয়, বছরজুড়ে ইলিশ পাওয়া যাবে। এরই মধ্যে ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ প্রথম স্থান অধিকার করেছে।