নতুন যাত্রী ছাউনি সত্বেও কমছে না যত্রতত্র বাস স্টপিজ
Tweet
আপনার আমার ভ্রমণ বলেন আর যাত্রা বলেন সুন্দর আরামদায়ক হতে হলে রাস্তার সার্বিক পরিস্থিতিও ভাল থাকতে হবে। এটি কিভাবে তা জানতে হলে আমাদের ঢাকার রাস্তাঘাট দেখলেই বুঝা যাবে। এক্ষেত্রে যেমন রামপুরা যেতে খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় ঢাকা মহানগর পুলিশ বা সিটি কর্পোরেশন থেকে বাস স্টপেজ নির্মাণ করা হয়নি। অথচ কাকরাইল বা বাসাবো হয়ে আসা সকল গণপরিবহন এখানে থামছে। ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠা-নামার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। ব্যস্ত সময়ে বাসগুলো রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানোর কারণে গাড়িজট ট্রেন লাইন পর্যন্ত আসে। ট্রেন আসার আগে বেল বাজতে থাকলে যাত্রীদের মধ্যে দেখা দেয় আতঙ্ক। আবার যাত্রীরা নিজেদের সুবিধামতো যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে বাস থামাচ্ছেন। থামছে গাড়ি। দিব্যি উঠে যাচ্ছেন! এরকম চিত্র প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়। কিন্তু এই সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশ তো আছে। অথচ কেন এমন হচ্ছে? তাহলে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তেমনি নাগরিক হিসেবে সবার দায়-দায়িত্ব নিয়ে ভাবা জরুরী। ইচ্ছে হলো, আর হাত ওঠে গেল সড়কে। এভাবে গাড়ি থামানোর প্রবণতা কমানো না গেলে ট্রাফিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা কষ্টসাধ্য বলছে নগর পরিকল্পনাবিদ থেকে শুরু করে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা।
কাকরাইল-শান্তিনগর নগরীর ব্যস্ততম এলাকার একটি। গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি পয়েন্টের উভয় পাশের কোন স্থানে নেই বাস স্টপেজের সাইনবোর্ড, নির্মাণ হয়নি যাত্রী ছাউনি। অথচ রাস্তার উভয়পাশে যে কেউ ইচ্ছা করলেই যে কোন সময় বাসে উঠতে পারছেন। সড়কের মাঝখানে এলোমেলোভাবে গাড়ি থামানোর চিত্র নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমনি মালিবাগ মোড়, মৌচাক, ওয়্যারলেস গেট, মগবাজার, সাতরাস্তা, নাবিস্কো, তিব্বত, মহাখালী, কাঁচাবাজার, বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে শুরু করে কাওলা পর্যন্ত যেতে কতগুলো নির্ধারিত বাস স্টপেজ আছে তা বলা একেবারেই কঠিন। কিন্তু এসব স্থান থেকে বাসে ওঠা মোটেও কঠিন নয়। শুধু সদিচ্ছা নিয়ে যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করলেই সব সমস্যার একেবারেই সমাধান।
আবার টঙ্গী ব্রিজ পার হলেই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সীমানা শুরু। আব্দুল্লাহপুর থেকে রাজলক্ষ্মী, বিমানবন্দর, এয়ারপোর্ট, খিলক্ষেত পর্যন্ত আসতে যতগুলো নির্ধারিত স্পট আছে এর চেয়ে তিনগুণ স্থানে বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলতে দেখা যায়। বিশ^রোডের উড়াল সড়কের সামনে থেকে মালিবাগ রেল গেট পর্যন্ত যে কোন স্থান থেকে বাসে ওঠা সম্ভব। দৃশ্য দেখলে মনে হবে পুরো সড়কটি যেন বাস স্টপেজের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সড়কটি এমনিই প্রশস্ত কম। এরপর মালিবাগ থেকে কুড়িল উড়াল সড়ক পর্যন্ত সব ধরনের যানবাহন চলে। তাই গাড়ির চাপ রাতদিন প্রায় সমান। বড় সমস্যা হলো ইচ্ছেমতো গাড়ি থামানো ও যাত্রী তোলার কারণে যানজট ও দুর্ভোগের মাত্রা বাড়ে।
রাজধানীর ১৩০ পয়েন্টে বাস থামার স্থান নির্ধারণ করা হলেও সড়কের চিত্র ভিন্ন। খুব কম বাসই আছে নির্ধারিত স্থানে থামে। যে কেউ হাত উঁচু বা ইশারা করলেই বাসে ওঠা যায়। সড়কে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও যত্রতত্র পথচারী পারাপার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। শুধু নিজেদের সুবিধামতো চলাচল করতে রাজধানীর অনেক স্থানে সড়ক দ্বীপের কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলা হয়েছে। কেটে দেয়া হয়েছে স্টিলের রেলিংও। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়ে অনেকে বাসে ওঠেন। যাত্রী নিরাপত্তায় বিমানবন্দর সড়কে রোড ডিভাইডারের ওপর দেয়া হচ্ছে স্টিলের বেড়া। এই বিবেচনায় পথচারীদের বেপরোয়া আচরণও বন্ধ হয়নি। পুলিশ বলছে, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করায় মামলা ও জরিমানায় সঙ্কটের সমাধান হবে না। এজন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক সভার আয়োজন করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় পথসভা, সচেতনতামূলক পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ কার্যক্রম চলছে।
ইতোমধ্যে সড়কের বাঁ পাশের লেনে হলুদ রং দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। মাঝখানে লেখা রয়েছে বাস থামবে। কোথাও বাংলা কোথাও ইংরেজীতে লেখা। আর ফুটপাথ ঘেঁষে রয়েছে ‘বাস থামবে’ লেখা সংবলিত সাইনবোর্ড। সঙ্গে আধুনিক যাত্রী ছাউনি। ডিএমপির পক্ষ থেকে বাস থামানোর স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (সিএএসই) শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে আধুনিক মানের বসার স্থান নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কের এখন এমনই চিত্র। মূলত পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এই উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবতা হলো অন্তত পঞ্চাশের বেশি পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামে না। চালকের ইচ্ছামতো এখনও বাস চলাচল করে খোদ রাজধানীতে। যেখানে ইচ্ছা থামানো, যাত্রী ওঠানো, দুই বাসের রেষারেষি এখনও সড়কের নিয়মিত চিত্র। ফলে সড়ক দুর্ঘটনাও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই হোটেল রেডিসনের সামনে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশের প্রতিটি স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। দেশব্যাপী নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি ব্যাপক মাত্রা ছড়ায়। এই ঘটনায় নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই হস্তক্ষেপ করেছিলেন। নিরাপদ সড়কের জন্য দেয়া হয়েছিল ২৩ দফা নির্দেশনা। কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। কাগজে-কলমে সেই নির্দেশ বাস্তবায়নে কিছুদিন তোড়জোড় দেখা গেলেও সড়ক দুর্ঘটনা রোধ দেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে।
আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাজধানীতে ১৩০ বাস স্টপেজ নির্মাণ করতে বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সে অনুযায়ী ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা স্থানগুলোতে দুই সিটি কর্পোরেশন বাস স্টপেজ নির্মাণও করে। কিন্তু সেসব স্টপেজে গাড়ি দাঁড়াতে এবং যাত্রী ওঠানামা করতে দেখা যায় না।
সিটি কর্পোরেশন বিষয়টি জানিয়ে পুলিশ, পরিবহন মালিক সমিতি ও বিআরটিএকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর পরিবহন মালিক ও চালকদের আইন পালনে বাধ্য করতে পুলিশকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাস স্টপেজ নির্মিত হলেও সেখানে গাড়ি থামা নিশ্চিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে কোন ভূমিকা নেই। ফলে চালকের স্বেচ্ছাচারিতা বাড়ছে। সোমবার রাজধানীর বাসাবো, খিলগাঁও, মালিবাগ, মতিঝিল, খিলক্ষেত, রেডিসন হোটেলের সামনে, মহাখালীসহ বিভিন্ন স্পটে নির্ধারিত স্থানে বাস না থামতে দেখা গেছে। এসব স্থানে বাস থামানোর জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে কোন তৎপরতাও দেখা যায়নি। চালক যেমন বাধ্য নয় তেমনি চালককে জোর করে বাধ্য করাও হচ্ছে না।
এসব বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আমরা নির্দেশ দিয়েছি, নির্ধারিত স্থান ছাড়া যাত্রী ওঠানামা না করতে। চুক্তি বা টার্গেটভিত্তিক কোন যান চালানো যাবে না। চালানোর সময় দরজা বন্ধ রাখতে হবে। প্রতিমাসে চালক ও হেলপারদের সঙ্গে মালিকদের মতবিনিময় করতে হবে, যারা এসব করবে না আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এর আগে অনেক চালক, মালিক ও হেলপারকে পুলিশে দেয়া হয়েছে। অনেকের সাংগঠনিক নিবন্ধন বাতিল করেছি। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের সমস্যা অল্প সময়ে শেষ করা যাবে না। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ’১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পৃথক দু’টি চিঠি দেন। ট্রাফিক বিভাগ থেকে নগরীতে বাস স্টপেজ নির্মাণের জন্য দুই সিটি কর্পোরেশনকে ১৪০ স্থান চিহ্নিত করে দেয়ার বিষয়টি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে দক্ষিণে ৭০ এবং উত্তর সিটিতে ৭০ স্থান রয়েছে।
বাস স্টপেজ নির্মাণের পাশাপাশি ৩৮ স্থানে যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ২৮ দক্ষিণ সিটিতে এবং দশটি উত্তরে। আরও ১২ যাত্রী ছাউনি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ডিএসসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব খাদেম বলেন, ‘বাস স্টপেজ নির্মাণের জন্য পুলিশ আমাদের ৭০ স্থানের তালিকা দিয়েছে। প্রতিটি স্থানেই বাস স্টপেজ নির্মাণ করে দিয়েছি। দুই সিটিতে ৩৮ যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা করা হয়েছে। এগুলো যাত্রীবান্ধব। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমরা বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করে দিলেও কোন পরিবহনই সেই নিয়ম মানছে না।
রাজধানীর ১৩০ পয়েন্টে বাস থামার স্থান নির্ধারণ করা হলেও সড়কের চিত্র ভিন্ন। খুব কম বাসই আছে নির্ধারিত স্থানে থামে। আর এটি করা গেলে ঢাকার রাস্তার যাতায়াত ভাল হবে। সেই সাথে ঢাকার প্রতি বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ বাড়ানো সম্ভব হবে।