হোটেল বাসন্তী নিবাস যে, শুধুই নারীদের
Tweet
আমরা সমাজে চলতে নারীদের অনেক সমস্যার কথা শুনি বা দেখি। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের একজন স্বেচ্ছাসেবী তরুণী তার স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। আত্মীয়-স্বজন না থাকায় একটি আবাসিক হোটেলে ওঠেন তারা। সেখানে গভীর রাতে হোটেলের ম্যানেজারসহ কয়েকজন হাজির ‘বিশেষ সুবিধা’ চাইতে। প্রায় দুই ঘণ্টার বাদানুবাদ শেষে বোঝাতে সক্ষম হন, তারা স্বামী-স্ত্রী।
রাজধানীর বুকে এমন ঘটনা একেবারে বিরল নয়। এই শহরে কত নারীকে কতভাবে যে হয়রানির শিকার হতে হয়, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। আর ঢাকার বাইরে থেকে আসলে তো কথাই নেই।
অথচ লেখাপড়া, চাকরিবাকরি, চিকিৎসাসহ নানা জরুরি কাজে প্রতিদিনই অসংখ্য নারীকে ঢাকায় আসতে হয়। রাজধানীতে অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন না থাকায় পয়সা খরচ করে উঠতে হয় হোটেলে। আর সেখানেই থেকে যায় নিরাপত্তা ঝুঁকি।
প্রায়ই উঠে আসে গণমাধ্যমে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের এমন সব সমস্যার কথা। এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ওই স্বেচ্ছাসেবীর ঘটনাটিই রেখাপাত করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশীলদের মনে। আর তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন, এই রাজধানীতে মেয়েদের জন্য নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করবেন তারা। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন চালু করতে যাচ্ছে শুধুই মেয়েদের জন্য একটি হোটেল। ‘বাসন্তী নিবাস’ নামের এই হোটেলটি একইসঙ্গে দেশের প্রথম ক্যাপসুল হোটেলও।
এক টাকায় আহার, পাঁচ টাকায় বাসন্তী স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ বিভিন্ন ধরনের জনবান্ধব কাজের মাধ্যমে এরই মধ্যে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন পরিচিত ও সমাদৃত হয়ে উঠেছে। ‘বাসন্তী নিবাস’ ও এরকম আরাকটি জনবান্ধব উদ্যোগ।
বাসন্তী নিবাসের ব্যবস্থাপক রাহিমা আখতার বলছিলেন, ঢাকায় সবার আত্মীয়-স্বজন থাকে না। আবার থাকলেও সেসব জায়গায় হয়তো থাকার ব্যবস্থা হয় না। তাই শুধুই মেয়েদের জন্য চালু থাকবে বাসন্তী নিবাস। এটি তাদের স্বেছাসেবা কার্যক্রমেরই অংশ।
প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাসেবী রাখিমা খাতুন জানালেন,
নতুন ধরনের এই নারী আবাস নিয়ে বিস্তারিত । বললেন, যেকোনো বয়সী নারী প্রতি রাত ৮৮০ টাকার বিনিময়ে বাসন্তী নিবাসে থাকতে পারবেন। তবে বিশেষ সুবিধা পাবেন ঢাকার বাইরে থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির পরীক্ষা দিতে আসা মেয়েরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছুরা ৭১ টাকায় পরীক্ষার আগের রাত ও পরীক্ষার দিনের রাত থাকার সুযোগ পাবেন এই হোটেলে। আর চাকরিপ্রার্থীরা একেক রাত ২৯৯ টাকায় থাকতে পারবেন।
রাখিমা খাতুন জানান, বাসন্তী নিবাসে থাকলে সকালের নাস্তা দেওয়া হবে বিনামূল্যে। তাতে থাকবে কফি, কলা ও বিস্কুট। সঙ্গে থাকছে ওয়াইফাই, ওয়াশিং মেশিনের সুবিধা।
বাসন্তী নিবাসে দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থাও আছে। তবে সেই খাবার কিনে খেতে হবে সেখানকার ভেন্ডিং মেশিন থেকে। এই দুই বেলার খাবারের দাম এখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে সর্বনিম্ন ৪০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১২০ টাকার মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। তারা বলছেন, পল্লবীতে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনেই প্রতিদিন এক টাকায় আহার কর্মসূচির জন্য রান্না করা হয়। সেটিই পাওয়া যাবে ভেন্ডিং মেশিনে।
খাবার ছাড়াও আরও দুইটি ভেন্ডিং মেশিন থাকবে বাসন্তী নিবাসে। এর মধ্যে একটিতে থাকবে স্যানিটারি ন্যাপকিন, অন্যটিতে বই।
আর দশটা হোটেলের মতো নয় হোটেল বাসন্তী নিবাস । এটিই বাংলাদেশের প্রথম ক্যাপসুল হোটেল। অর্থাৎ এই হোটেলের রুমগুলোতে প্রচলিত বেডের বদলে জায়গা করে নিয়েছে ছোট ছোট বাংক বেড, যেখানে থাকছে বিছানা, লাইট ও চার্জার পয়েন্ট। চারটি করে বাংক বেড রয়েছে একই ফ্রেমে। সঙ্গে লাগোয়া কাবার্ড। বিছানার নিচের দিকেও আলাদা লকার রয়েছে বড় ব্যাগ রাখার জন্য।
প্রায় ১৭০০ বর্গফুটের এই বাসন্তী নিবাসে মোট ৩৬টি বেড রয়েছে। সবার জন্য কমন বাথরুম। খাওয়ার জন্য রয়েছে ছোট্ট প্যান্ট্রি, যেখানে বসার ব্যবস্থা বেঞ্চ ও লম্বা টুল দিয়ে করা হয়েছে ।
বিদ্যানন্দের আরেক স্বেচ্ছাসেবী সিরাজাম মুনিরা জানালেন ক্যাপসুল কক্ষ বানানোর উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, আমরা মনে করছি, এখানে কেউ দীর্ঘমেয়াদে থাকার জন্য আসবেন না। ঢাকার বাইরে থেকে যেসব নারীরা আসবেন, যাদের ঢাকা শহরে থাকার কোনো জায়গা নেই, তাদেরই স্থান হবে এই হোটেলে। সে কারণে হোটেল রুমের প্রচলিত ধরনের বাইরে গিয়ে আমরা ক্যাপসুল ফরম্যাট বেছে নিয়েছি। তাছাড়া এতে অল্প জায়গায় বেশি মানুষের থাকার ব্যবস্থাও করা যাচ্ছে।
সিরাজাম মুনিরা জানান, স্বেচ্ছাসেবীদের নিজেদের উদ্যোগ ও ডোনেশন থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে বিদ্যানন্দের প্রধান কার্যালয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এই হোটেল। এখান থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই পরিচালিত হবে এটি।
বাসন্তী নিবাসে সিট বুকিং দেওয়া যাবে ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করে বা ফোন দিয়ে । এর জন্য অনলাইনে একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে হোটেলে এসেই জমা দিতে হবে অ্যাডমিট কার্ড, যা পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে ফেরত দেওয়া হবে। চাকরিপ্রার্থীদের জন্যও চাকরির পরীক্ষার প্রবেশপত্রের কপি জমা দেওয়ার পাশাপাশি মূল কপি দেখাতে হবে। আর সবাইকেই জাতীয় পরিচয়পত্র (যদি থাকে) দেখাতে হবে।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে উদ্বোধন করা হয় কেবল নারীদের জন্যই গড়ে তোলা ‘বাসন্তী নিবাস’।