করোনাকালে পর্যটন ভাবনা
Tweet
অনেকের ধারণা, পর্যটনের কাজ শেষ। অনেকে মনে করেন, পর্যটন আবার ঘুরে দাঁড়াবে। আবার অনেকের কোন ধারণাই নেই, আছে বিস্তর হাপিত্যেশ। তবে যার যেটাই থাকুক, পর্যটন যে এখন মহা সংকটে এটা নির্জলা সত্য। বিশ্ব দানব করোনা তাকে প্রথমেই দলিত মথিত করে ফেলেছে। এমনিতেই পর্যটন সব দুর্যোগ-দুর্বিপাকে থাকে প্রথম ভিক্টিম। আর এবারতো কোন বিশেষ দেশ, অঞ্চল, মহাদেশ নয় গোটা দুনিয়া জুড়ে এই মহাযজ্ঞ। তার সাথে এবার শুধু মাল নয় জানই বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ। তাই পর্যটনের দূরবস্থা সহযেই অনুমেয়।
পর্যটনের বিশ্ব মুরুব্বী ‘জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা’ বা ইউ এন ডাবলু টি ও (UNWTO) বলছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের সব আন্তর্জাতিক পর্যটক গন্তব্যের শতকরা ৯৬ টি সম্পুর্ন বন্ধ হয়ে গেছে। কেন না আকাশে উড়ছেনা বিমান, চলছেনা ট্রেন-বাস, খুলছেনা হোটেল-রেস্তোরাঁ আর বিনোদন কেন্দ্রগুলো। অনেক বিমান সংস্থা ইতোমধ্যে দেউলিয়া হয়ে ক্রেতা খুজছে। চাকুরী হারাচ্ছে লাখ-লাখ মানুষ আর লাটে উঠছে হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। যেমনটি বেসরকারী সংস্থা ‘ডাবলু টি টি সি’ (WTTC) মার্চ মাসে বলেছে এই শিল্পে চাকুরী হারাবেন ৫০ মিলিয়ন মানুষ। আবার এই এপ্রিলে এসে বলছে এদের সংখ্যা হবে ৭৫ মিলিয়ন।
তাহলে সত্যিই কি পর্যটনের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে? আরে না, এটা কখনো হবেনা এবং হবার নয়। আমার যা মনে হয়, এই পর্যটনই সবার আগে ঘুরে দাঁড়াবে। বলবেন কেন, কোন যুক্তিতে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যটনের কোন বিকাশই ঘটেনি, অন্তত একশত বছরে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই যখন মানুষ আত্মীয়-স্বজনের খুঁজে, চাকুরীর সন্ধানে, ব্যবসার প্রয়োজনে ছুটলো বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তখনই পর্যটনের ভাগ্য ফিরে গেলো। আর যায় কৈ, বিমান চলাচলে এবং হালকা গাড়ির ব্যবহারে আসলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সাথে যোগ হলো নানা কিসিমের সেবা আর বাড়তে থাকলো সেবা প্রদানকারীর সংখ্যা। যা তাকে উল্কার মত উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে, একেবারে ব্যবসা থেকে শিল্পে পরিণত করা পর্যন্ত।
তারপরের গল্প নাইবা বললাম। কারণ সে এখন বিশ্বের এক নম্বর শিল্প। যেখানে শুধু ট্রিলিয়ন ডলারের খেলাই নয়, সেরা চাকুরীদাতার সাথে সাথে দারিদ্র দূরশরবতও এখন এই পর্যটন। তাছাড়া এখন পর্যন্ত যত দুর্যোগ দুর্বিপাকে সে পড়েছে সব কয়টিতেই খুব দ্রুত তার ট্র্যকে ফিরে এসেছে। আবার ফিরে পেয়েছে তার গতি শুধু সামনে চলার নয়, প্রবৃদ্ধির হারকেও বৃদ্ধি করার জন্য। তাই, বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন ইউ এন ডাবলু টি ও এর সেক্রেটারী জেনারেল ‘জুরবা পলোলিকাশভিলি’; বলেছেন, “No sector brings people together like tourism.Tourism has shown many time its power to recover”. তাই বি বি সি-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, যে শিল্পটির বিশ্বাসযোগ্যতা সবার মাঝে এবং দ্রুত চাকুরী সৃষ্টিতে সবার উপরে, তাকে পুনরুদ্ধারের ব্যাপারটিকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে।
অন্যদিকে ডাবলু টি টি সি এর প্রেসিডেন্ট ও সি ই ও ‘গ্লোরিয়া গুয়েভারা’ একইভাবে বলেছেন, “Travel and tourism is a critical sector to the global economy, accounting for one in four of all new jobs worldwide and contributing 10.3% to GDP”. যেজন্য তারা দুটি সংস্থাই গোটা বিশ্বকে ডাক দিয়েছে যাতে সবাই একসাথে পর্যটন পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসে। ডাক দিয়েছে জি-২০ এর পর্যটন মন্ত্রীদের ২৪ এপ্রিল, ২০২০ একটি অতিজরুরী সভায় মিলিত হওয়ার জন্য। এজন্য ডাবলু টি টি সি চার দফা প্রস্তাবও প্রকাশ করেছে। মনে রাখতে হবে জি-২০ ভূক্ত দেশগুলো শুধু পৃথিবীর রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক শক্তিধরই নয় এই পর্যটন শিল্পটাও প্রায় পুরোটাই তাদের দখলে। তাই গরজটাও তাদের অনেক বেশি যাতে এই সোনার হাঁস তথা শিল্পের কোন বিনাশ না ঘটে এবং আবার তার শক্তিমত্তা ফিরে পায়।
এদিকে ইউ এন ডাবলু টি ও এই করোনা তাণ্ডব মোকাবেলা এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য একটি আপদকালীন কমিটি গঠন করেছে। যেখানে ডাবলু এইচ ও (WHO) এবং পর্যটন সম্পৃক্ত সরকারী-বেসরকারী আন্তর্জাতিক সব বড় বড় সংস্থাগুলো রয়েছে। তারসাথে বিভিন্ন সহযোগী সদস্য দেশের পর্যটন মন্ত্রী, অন্যান্য বিভাগ এবং বেসরকারী খাতসহ সবার সাথে অবিরাম ডায়লগ চালাচ্ছে। তাদের কথা হচ্ছে, করোনার জন্য যেমনি ‘টেস্ট এন্ড টেস্ট’ তেমনি পর্যটনের জন্যও এই মুহুর্তে ‘ডায়লগ এন্ড ডায়লগ’ এর কোন বিকল্প নেই। এজন্য প্রতিটি দেশের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে যা করতে বলেছে তা হলো, “Political recognition and cooperation accorss ministries, involving the public and private sectors”. কেননা সংস্থাটি মনে করে, এই খাতের সব বড় বড় প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য চাই, একত্রিত হওয়া।
অবশ্য সংস্থাটি পর্যটনকে বাঁচানোর জন্য এর পুনরুদ্ধার কাজে হাত দেয়ার পাশাপাশি চাকুরীগুলো বাঁচানোরও তাগিদ দিয়েছে। আবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পর্যটনের আগে অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক পর্যটন শুরু করার ব্যাপারটি সময় সাপেক্ষ বটে। সব মিলিয়ে যা মনে হচ্ছে তাতে করোনার তাণ্ডবে যতই ঝাঁঝ থাকুক আর যতই দীর্ঘায়িত হোক পর্যটন তার কার্যক্রম আবার শুরু করার সব প্রস্তুতি নিয়েই রাখছে। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের কি হবে বা হতে যাচ্ছে তা একটি বিরাট জিজ্ঞাসা। কারণ, এই মুহুর্তে সরকার তার এজেন্ডায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বাঁচানো এবং কৃষিকে সামাল দেয়ার পাশাপাশি বৃহৎ শিল্প যেগুলো অর্থনীতির চালিকা শক্তি সেগুলোকে অগ্রাধিকারে রাখবে। সেক্ষেত্রে করণীয় কি হবে তা নির্ধারণে ইউ এন ডাবলু টি ও এর নির্দেশ মোতাবেক ডায়লগের কোন বিকল্প নেই।
অবশ্য এমন কোন উদ্যোগ বাংলাদেশে আপাতত দেখা যাচ্ছেনা। যদিও প্রণোদনার উন্মাদনা অনেককেই কেন জানি অন্ধ বানিয়ে ফেলছে। অথচ এর কতটুকু পর্যটনের জন্য বাস্তব সম্মত তা ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনায় না নিয়ে শুধু উত্তাপ ছড়ানো হচ্ছে। এতে আবেগ থাকলেও বেগ থাকছেনা, শুধু শুধু লোভ দেখানো হচ্ছে। এমনকি অনেকে নেতা হওয়ার সুযোগও নিচ্ছেন বা নিতে চাচ্ছেন। যা একেবারেই সাময়িক এবং গৌণ। তারচেয়ে বাস্তবতার আলোকে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য বড় ভুমিকা রাখতে হবে সরকারকে। তবে, সবই ব্যর্থ হবে যদি সরকার তার আমলাদের লাগাম টেনে ধরতে না পারে। তেমনি বেসরকারী খাতকেও শেষ সুযোগ হিসেবে তার ঐক্যের ব্যাপারটি কাজে লাগাতে হবে। কারণ, একসাথে এক সূরে আওয়াজ তুলতে না পারলে কাজের কাজ কিছুই হবেনা। আবার মনে রাখতে হবে শুধু আমাদের স্বার্থ দেখলে হবেনা, পর্যটনেরও স্বার্থ দেখতে হবে। তাই এমন ফর্মূলা বের করতে হবে যাতে শিল্প এবং শিল্প সম্পৃক্ত সবাই বাঁচতে পারে। কারণ, পর্যটন না বাঁচলে শুধু আমাদের ব্যবসা বাঁচিয়ে রেখে কি আর হবে। তাই, সাধু সাবধান।
জামিউল আহমেদ
পর্যটন ব্যক্তিত্ব ও বিশেষজ্ঞ