কায়াক তৈরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
Tweet
বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় একটি অ্যাডভেঞ্চারের নাম হচ্ছে কায়াকিং। তবে বর্তমানে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষগুলো কায়াককে যে ভাবে বিনোদনের জন্যে ব্যবহার করছেন, কায়াক কিন্তু এই বিনোদনের জন্যে তৈরি হয়নি। ইতিহাসের শুরুর দিকে মানুষ জীবন বাঁচানোর হাতিয়ার হিসেবে কায়াক তৈরি করেন। মানুষ সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করা এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্যেই কায়াক তৈরি করেন।
এখন থেকে প্রায় ৪০০০-৫০০০ বছর পূর্বে আর্টিক উত্তর আমেরিকার ইনুইট এবং
অ্যালিউট নামে দুইটি উপজাতি প্রথম কায়াক তৈরি করে এবং ব্যবহার করে। তারা
মূলত কায়াক তৈরি করে তাদের চারপাশে যে ধরনের জিনিস পেয়েছেন তা দিয়ে। এগুলোর
মধ্যে রয়েছে পশুর চামড়া, হাড় এবং কাঠ। ‘কায়াক’ শব্দটি এসেছে
গ্রীনল্যান্ডের শব্দ ‘qajaq’ বা ‘কাজাক’ থেকে যার মানে হল ‘hunter boat’
বা ‘শিকারী নৌকা’।
তবে ইতিহাসে দেখা যায় বেশির ভাগ কায়াকই তৈরি করত সামুদ্রিক শিলের চামড়া
থেকে। সাধারণত দুই ধরণের কায়াক পাওয়া যেত। একটি তৈরি হত ড্রিফট উড বা যে
কাঠগুলো পানিতে ভেসে থাকে সে ধরণের কাঠ দিয়ে। দ্বিতীয়টি তৈরি করা হত তিমির
হাড় দিয়ে। তবে দুই ধরণের কায়াককেই পশুর চামড়া দিয়ে কাভারিং করা হত। তারা
বর্তমান সময়ের কায়াক তৈরির কারিগরদের চেয়ে কম বুদ্ধিমান ছিলেন না। পানি
যাতে না ডুকতে পারে তার জন্যে তারা তিমির চর্বি ব্যবহার করত। শিল ব্লাডার
বা শিলের থলিতে বাতাস ডুকিয়ে তা নির্দিস্ট জায়গায় বসিয়ে দিয়ে কায়াকটিকে আরো
বিনোদন উপযোগী করে গড়ে তোলা হত। তবে শিল দিয়ে তৈরি কায়াকগুলো দেখতে বেশি
সুন্দর হলেও এইগুলো টেকসই ছিল না।
পরবর্তী সময়ে ১৮০০ সাল নাগাদ ইউরোপে একটি ফেব্রিক কভার ফ্রেম বোট হিসেবে
কায়াক যাত্রা শুরু করে। উত্তর এবং দক্ষিণ ইউরোপ কায়াককে বেশ জনপ্রিয় করে
তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকার দাবিদার। তারা বরফাবৃত নদীগুলোতে কায়াকিং
করত। এতে তাদের নিজেরদের বিনোদন হত এবং খেলাধুলা করার আরেকটা মাধ্যমও সামনে
আসে।
১৯৩১ সালে বরফ পানি ছাড়া শুধু প্রবাহমান পানিতে প্রথম কায়াকিং করে
রেকর্ড করেন জার্মানের অ্যাডলফ অ্যান্ডারলে। তিনি কোন রকম কোন ভয়-ভীতিকে
পাত্তা না দিয়ে স্রোতের সাথে পাড়ি দেন কায়াক নিয়ে। তারপর থেকেই
আন্তর্জাতিকভাবে নদীর বিপদসীমা মাপার পদ্ধতি ব্যবহার করা শুরু হয় এবং তা
এখন পর্যন্ত চালু আছে। কায়াকিং করার পূর্বে রেকি করে নির্ধারণ করা হয় কোন
কোন জায়গাগুলো বেশি বিপজ্জনক।
বিনোদনমূলক ভাবে কায়াককে ব্রিটেনে জনপ্রিয় করে তোলেন জন ম্যাকগ্রিগর।
তিনি উনিশশতকের দিকে ‘দ্য রব রয়’ নামে একটি ক্যানো তৈরি করেন। যেটা দিয়ে
তিনি ইউরোপের বিভিন্ন নদী ও হ্রদ অনুসন্ধান করে বের করেন। পরবর্তীতে তিনি
‘এ থাউজেন্ট মাইলস ইন দ্য রব রয় ক্যানো’ নামে একটি বই লেখেন। এই বইটি তার
অ্যাডভেঞ্চারের একটি নথি হিসেবে কাজ করেন। এই বইটি থেকেই মানুষ ক্যানো বা
কায়াক সম্পর্কে জানতে পারে। এবং ইউরোপে আরো বেশি জনপ্রিয়তা পায়। তিনি এই
বইতে তার সাহসিকতার ছাপ রেখে যান।
জন ম্যাকগ্রিগরের হাত ধরেই কায়াকিং একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসেবে
বিশ্বের কাছে পরিচিতি পায়। তিনি ‘ক্যানো ক্লাব’ নামে একটি ক্লাব তৈরি করেন
যেটা ১৯২৪ সালে প্যারিসের ৮ম অলিম্পিয়াডে প্রদর্শনী খেলা হিসেবে কায়াকিংকে
সবার সামনে তুলে ধরার জন্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তারপরে আর পিছনে
তাকাতে হয়নি। ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকে একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলা
হিসেবে বিশ্বের দরবারে হাজির হয়। এবং সে খেলাতেও মেডেল দেওয়া হয় বা
পুরস্কার প্রদান করা হয়।
আধুনিক কায়াক তৈরি করা শুরু হয় ১৯৫০ সাল থেকে। ১৯৫০ সালে প্রথম ফাইবার
গ্লাস দ্বারা নির্মিত কায়াক আসে বাজারে। তারপর ১৯৮৪ সালে প্রথম প্লাস্টিক
দিয়ে তৈরি কায়াক আসে বাজারে। ধীরে ধীরে কায়াক তৈরির আধুনিক সরঞ্জামগুলোও
মানুষ পেতে শুরু করে। এখন কায়াক শুধু খেলাধুলার সামগ্রি তা নয় একটা সখের
বস্তু হয়েও দাঁড়িয়েছে। ২০০০ সালের দিকে পিজন নদীতে সবচেয়ে বেশি কায়াকিং এবং
র্যাফটিং করা হয়। কারণ এই নদীটি কায়াকিংয়ের জন্যে খুব বেশি নির্ভরযোগ্য।
আন্তর্জাতিক পরিমাপক এই নদীকে রেকি করে দেখেছেন এটার প্রবাহ বা স্রোত
কায়াকিংয়ের জন্য উপযুক্ত।
আজকাল কায়াক বেশ নিরাপদ এবং জনপ্রিয় বিনোদন। এখন অনেকেই কায়াক কেনার
ক্ষমতা রাখেন। যেটা পূর্বে সম্ভব ছিল না। কায়াক তৈরি করার জন্য এখন আধুনিক
সব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। এখন যাতে টেকসই হয় সেদিকে অনেক বেশি নজর দেওয়া
হয়। এখন বিভিন্ন রকম রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় ওয়াটার প্রুফিংয়ের জন্যে।
চাইলে যে কেউ একা একা সারা বিশ্ব দেখতে পারবে। আবার যারা পানিতে
অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালবাসেন তাদের জন্যে তো কায়াক একসেরের উপর সোয়া সের।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও এখন কায়াকিং বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
অনেকে এখন এই অ্যাডভেঞ্চারটার প্রতি তাদের ভাললাগা প্রকাশ করেছেন।
কাপ্তাই কায়াকিং ক্লাব বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া মহামায়া
লেকেও কায়াকিং হচ্ছে। অ্যাডভেঞ্চারের দিক থেকে এই ছোট্ট দেশটাও পিছে নেই।
মানুষ পাল্লা দিয়ে পৃথিবীকে অতিক্রম করার চেষ্টা করছে। পৃথিবীটা অনেক
সুন্দর আর এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ শুধু নিজের সত্তাকে
খুঁজে বেড়ায়। তাই প্রকৃতিই হল একটা নির্ভর যোগ্য জায়গা যেখানে মানুষ সবচেয়ে
বেশি নিরাপদ। তাই প্রকৃতির কাছে যাই এবং প্রকৃতিকে ভালবাসি।