দিশেহারা অবস্থা পর্যটন শিল্পের
Tweet
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে এ খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা এ খাত হুমকির মধ্যে পড়বে হবে বলে আশঙ্কা তাদের ।
এই পরিস্থিতি পেরিয়ে উঠে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে রপ্তানি খাতের মতো আর্থিক প্রণোদনা চাইছে এই খাত সংশ্লিষ্টরাও। বাংলাদেশে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যটনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময় বলে বিবেচনা করা হয়।
পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে শুরু হওয়া নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটরদের বহু গ্রুপ ট্যুর বাতিল করতে হয়েছে। সকল হোটেল বুকিং ও অসংখ্য বিমানের ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
এই অবস্থায় পর্যটন শিল্পে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা মোকাবেলার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে ১৪ সদস্যের ‘পর্যটন শিল্পের সঙ্কট ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাবেদ আহমেদকে প্রধান করে কমিটিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ট্যুরিস্ট পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের সদস্য করা করা হয়েছে।
গত ২২ মার্চ কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে একটি সভা করা হয়।
ওই সভা থেকে পর্যটন শিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত সংশ্লিষ্টদের জন্য ‘উদ্দীপনা প্যাকেজ’ ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানোর পাশাপাশি, একটি ‘বিশেষ টাস্ক ফোর্স’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
এছাড়া পর্যটন শিল্পের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করা ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে তাদেরকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দেশে তিন থেকে পাঁচ তারকা মানের ৪৫টি হোটেল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, করোনাভাইরাসের আঘাতের কারণে তারা দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
সংগঠনটির সচিব মোহসিন হক হিমেল বলেন, “করোনাভাইরাসের অ্যাটাকের কারণে প্রথম দিক থেকেই ক্ষতি হচ্ছে এয়ারলাইন্স এবং হোটেল। আমাদের ৪৫টি হোটেলের সবগুলোই ফেব্রুয়ারি থেকে ক্ষতির সম্মুখীন। এই পর্যন্ত দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার লোকসানে পড়েছে এসব হোটেল।”
চলমান পরিস্থিতিরি কারণে আন্তর্জাতিক মানের এসব হোটেলের প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মীকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন অধিকাংশ হোটেল খালিই বলা যায়। হয়ত কোনো কোনো হোটেল ৫ থেকে ১০টি রুম বুকিং রয়েছে।”
এই লোকসান থেকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য হোটেলের কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনা চাওয়ার পাশাপাশি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত হোটেলের ইউটিলিটি বিল মওকুফ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের উপর কর মওকুফের দাবি জানানো হয়েছে বলে জানান মোহসিন হক হিমেল।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. রাফিউজ্জামান বলেন, “করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটররা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কারণ পর্যটনের ‘পিক সিজনে’ এই মহামারী আঘাত এসেছে। যে কারণে বিভিন্ন বিদেশের পর্যটকগণ তাদের বুকিং বাতিল করে দিয়েছে।”
চলমান পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা বন্ধ থাকায় ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা প্রদানের জন্য আমরা দাবি করেছি। এছাড়া অফিস ভাড়া হ্রাসের জন্য সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দাবি করছি। বিনা সুদ ও সহজ শর্তে ট্যুর অপারেটরদের ঋণের ব্যবস্থারও দাবি রয়েছে আমাদের।”
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মোহাম্মদ সাইফুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন আমরা সেক্টর ধরে ধরে ক্ষতির পরিমাণ তৈরি করছি। যেমন ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড, পর্যটন খাতের সাথে জড়িত ছোট ছোট ব্যবসায়ী, যানবাহন, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটনের সাথে জড়িত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। এসব ক্যাটাগরি অনুযায়ী একটা তালিকা তৈরি করছি।”
ট্যুর অপারেটর কয়েকটি সংগঠনকেও পর্যটন খাতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যারা প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যায় কি না। তাছাড়া যারা পর্যটন খাতে সরাসরি না হলেও অন্যভাবে জড়িত তাদেরকে জেলা প্রশাসক থেকে চাল বরাদ্দ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি।”
গত ২২ মার্চ কমিটির সদস্যদের সরাসরি সভার পর করোনাভাইরাসের ঝুঁকির কারণে এরপর থেকে তারা নিয়মিত ভার্চুয়ালি সভা করছেন বলে জানান পর্যটন শিল্পের সংকট ব্যবস্থাপনা কমিটি আহ্বায়ক ও ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও জাবেদ আহমেদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে সময়টাতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে এই সময়ে আমাদের টার্নওভার থাকত পাঁচ হাজার কোটি টাকা, এটা টাকার হিসেবে যা আমাদের এই সেক্টরে ক্ষতি হয়েছে। গ্রুপ বুকিং, হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে পর্যটন সংশ্লিষ্ট যেসব খাতে বুকিং ছিল এসব মিলে এই টাকা হয়। এখানে বিমানের হিসাব বাদেই পাঁচ হাজার কোটি টাকা হয়।”
কনোরাভাইরাসের চলমান পরিস্থিতি যদি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে পর্যটন খাতের ক্ষতি আরও বেড়ে এই শিল্প খাত হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
পর্যটন শিল্প খাতকে দেশের অর্থনীতির ‘ইনফরমাল’ খাত হিসেবে মূল্যায়ন করে সরকারের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেন, “ইনফরমান সেক্টরে কত মানুষ কাজ করে তা আপনি বুঝতে পারবেন না, তবে ডাইরেক্ট ও ইনডাইরেক্ট (এই খাত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে) মিলে অন্তত ২০ লাখ মানুষ পর্যটন শিল্প খাতের সাথে জড়িত।”
করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতির শিকার বিভিন্ন খাতে সরকারের প্রণোদনা যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের এই সেক্টরকে দাঁড় করাতে হলে এই ধরনের একটা প্রণোদনা আমরা চাই। কম সুদে ঋণ হতে পারে, অথবা অন্য কোনোভাবে কর মওকুফ করেও হতে পারে। সরকার যদি সাহায্য না করে এই লণ্ডভণ্ড হওয়া পর্যটন খাতকে তোলা সম্ভব হবে না।”