পর্যটন আমাদের জীবনরেখা

Share on Facebook

করোনাকালের প্রথম ২ মাসে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে পর্যটকদের সংখ্যা ৯৯% হ্রাস পেয়েছে। Weekend Economy পুরো বসে গেছে। ফলে কাজ হারিয়েছেন অনেক পর্যটনকর্মী, আয় কমেছে কর্মী ও উদ্যোক্তাদের এবং বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। জীবনধারা পরিবর্তিত হতে চলেছে পর্যটনের উপর প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও আবেশিতভাবে নির্ভরশীল সব ধরণের মানুষের। এ থেকে প্রথমবারের মতো সকলেই অনুভব করতে শিখলো যে, পর্যটন আমাদের জীবনরেখা। পর্যটনের অনুপস্থিতিতে আমাদের জীবনে অনেক বড় ধাক্কা লেগেছে। ব্যবসায়, শিক্ষা, উৎপাদন সব কিছু থমকে গেছে। জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার গবেষণামতে, পৃথিবীতে ধর্মীয় পর্যটকদের সংখ্যা প্রায় ৭০%। কেবল হজ ও ওমরাহর মতো ধর্মীয় পর্যটনের অনুপস্থিতিতে সৌদি আরবের অর্থনীতি যেভাবে ভেঙ্গে পড়েছে তা বলাই বাহুল্য। এই অল্প সময়ের মধ্যে তারা মূল্য সংযোজন কর বাড়িয়ে ৩ গুন। বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমায় লক্ষ লক্ষ মানুষ এ বছর আর আসবে না। লক্ষ মানুষের একজনও হয়তো যোগ দিবে না লাঙ্গলবন্দের পূ্ণ্যস্নান কিংবা মন্দিরগুলির নানান আয়োজনে। এতে আমাদের অর্থনীতির কী অবস্থা দাঁড়াবে তা বছর শেষে সরকারি কোষাগারের হিসেব দেখলে বুঝা যাবে। আগে পর্যটনকে আমরা এভাবে বুঝার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি নাই। আমাদের ধারণা ছিলো পর্যটন ধনীদের কাজ এবং একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বড় বিনিয়োগ ও বড় স্থাপনার দরকার। কিন্তু করোনা শিক্ষা দিলো যে, পর্যটনের অবদান সব মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। আর একে বাঁচিয়ে রাখতে হয় পর্যটনশিক্ষা, পরিবেশরক্ষা ও পর্যটকদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে। ইতোমধ্যে জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মহাসচিব জুরাব পলিলিকাশভিলি বলেছেন যে, আস্থা এখন পর্যটনের নতুন মুদ্রা। অর্থাৎ পর্যটকদের মধ্যে গন্তব্যে ফেরাতে হলে আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। আস্থা এক ধরণের সামাজিক পুঁজি, যা নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকে। এখন তা প্রকৃত পুঁজির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পর্যটনকে বাঁচাবে – কী বিচিত্র শিক্ষাই না পাচ্ছি আমরা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নাজুক পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এগিয়ে এসে পর্যটন দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় পর্যটন নামক জীবনরেখার পতন হবে যা পৃথিবীর মানুষের আরেক দফা বিপর্যয়কে নিশ্চিত করবে।

করোনা ভাইরাস ও পর্যটন:
করোনা সামাজিকভাবে দ্রুত বিস্তারণশীল একটি ফ্লু ভাইরাস, এর কোন চিকিৎসা নাই। তবে আশার কথা যে, এটি মারণ ভাইরাস নয়। বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে জানিয়েছেন যে, একজন মানুষ অন্তত ৭ বিলিয়ন ভাইরাসে আক্রান্ত না হলে তার দেহে রোগের লক্ষণ প্রতীয়মান হয় না। অর্থাৎ ২-৪ বিলিয়ন ভাইরাস নিয়ে ঘুরে বেড়ালে কেউই বুঝবে না যে কারুর শরীরে এই ভাইরাস আছে। এর সুবিধা হলো করোনা কারো দেহে থাকলেই যে তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যাবেন এমনটি নয়। তবে অসুবিধা হলো তিনি যে অন্য কাউকে আক্রান্ত হতে সহযোগিতা করছেন তা নিজে বা অন্য কেউ বুঝতেই পারবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে যে, করোনার প্রভাব আগামী ৫ বছর পর্যন্ত থাকবে এবং পৃথিবীকে সম্ভবত কখনোই করোনামুক্ত করা যাবে না। এই তথ্যকে মাথায় রেখে পর্যটন গন্তব্যে প্রবেশের পূর্বে পর্যটকদের সর্বনিম্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। এটি কঠিন বা অসম্ভব বলে মনে হলেও হয়তো সুরক্ষার জন্য করতে হবে। কথা এখানেই শেষ নয়। এমনও হতে পারে, বর্তমান বাসের ডিজাইন পাল্টে ফেলে প্রত্যেকের বসার আসনের উপর একটি খাঁচা বসিয়ে দিয়ে খাঁচাবন্দি করা হতে পারে মানুষকে করোনামুক্ত রাখার জন্য।

আশার কথা, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের ২ গুণী মানুষ ড. সমীর সাহা ও তাঁর মেয়ে ড. সেজুঁতি সাহা যৌথভাবে গত সপ্তাহে করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন করেছেন। এই উদ্ভাবন আমাদের দেশে করোনার স্ট্রেইনগুলিকে নির্ধারণ করে তা প্রতিরোধ করায় বিশেষ অবদান রাখবে। অধিকন্তু করোনা আক্রমণের গতিবিধি অনুসরণের ক্ষেত্রেও এই গবেষণা বিশেষ সহায়ক হবে। সমীর-সেজুঁতির এই উদ্ভাবন মানবজাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যোগাবে। ফলে দ্রæততম সময়ের মধ্যে হয়তো আমরা পর্যটন উদ্ধার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবো।

করোনায় পর্যটনের অবস্থা:
করোনা পৃথিবীতে আগামী ৫ (পাঁচ) বছর দাঁপিয়ে বেড়াবে বিধায় সর্বাগ্রে অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে ভিন্নরূপে ঢেলে সাজানোর কোন বিকল্প নাই। স্থানীয় মানুষের চাহিদা বিবেচনায় তাদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রেখে পর্যটন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য নিচের পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা উচিত:

ক. অনিরাপদ উৎসস্থল থেকে নিরাপদ গন্তব্যের গমনাগমন নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।
খ. নিরাপদ উৎসস্থলের সাথে নিরাপদ গন্তব্যের মানুষের গমনাগমনকে উৎসাহিত করতে হবে।
গ. বিদেশ থেকে আগত পর্যটকদেরকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে নিরাপদ গন্তব্যে প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, এতে বিদেশি পর্যটকদের আগমন বেশ কমে যেতে পারে।
ঘ. করোনা চিহ্নিত সকল মানুষকে ‘করোনা সনদ’ ইস্যু করে তাকে পরবর্তীতে মনিটারিং করতে হবে।

এই কর্মকান্ড অন্তত বছরখানেক সময় চালিয়ে যেতে হবে। অতপর বৈশ্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বিদেশি পর্যটকদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। একইভাবে, বহির্মুখী পর্যটকদের জন্য গন্তব্য দেশের নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে হবে। পর্যটকরা দেশে কিংবা বিদেশে ভ্রমণের সময় গন্তব্যের শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে যা নিজেকে এবং অন্যকে নিরাপদে রাখতে সহযোগিতা করবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসির করণীয়:
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশে এখন ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যটনে উচ্চশিক্ষা দান করছে। এরমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৭টি, বাকী ১৭টি প্রাইভেট। এছাড়াও রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এই ২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১ সাল থেকে পর্যটনে উচ্চাশিক্ষার সূচনা করবে। পরিতাপের বিষয় যে, ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ই কলেজের মতো পর্যটনে কোর্সভিত্তিক ডিগ্রি দিচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অনায়াসে ডিগ্রি প্রদান করছে বটে, কিন্তু ঐ ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষার্থীরা তেমন কোন কাজে লাগাতে পারবে না। কেননা কোর্সের বিষয়বস্তু এবং পাঠদান উভয়ই একজন শিক্ষার্থীকে পর্যটনে শিক্ষিত করার পক্ষে অপ্রতুল। ফলে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তার বিনিময়ে প্রাপ্ত ডিগ্রি দিয়ে জাতীয় জীবনে কোন উপকারে আসবে না। অনেক আগ্রহ নিয়ে যে সকল শিক্ষার্থী পর্যটনে ভর্তি হয়েছে – তারা সহসাই হতাশ হবে। পর্যটনশিল্প এদেরকে কোন কাজে লাগাতে পারবো না। তাই অবিলম্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যাগুলিকে পাঠ্যক্রম ও পাঠদানে সংস্কারের জন্য নিচের পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা উচিত।

ক. সকল বিশ^বিদ্যালয়ের ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রির পাঠ্যক্রম বাজার চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে প্রণয়ন করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ বিজনেস ফ্যাকাল্টির অধীন খোলার জন্য বিজনেসের কোর কোর্স বলে অহেতুক ১৩-১৬টি কোর্সে পাঠদান করা হয়। ফলে পর্যটনের প্রয়োজনীয় কোর্সের ঘাটতি থেকে যায়। এই ভয়াবহ সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসে পর্যটনের কোর্স পাঠ্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন অনুষদের আদলে নতুন করে ‘পর্যটন অনুষদ’ চালু করে এই বিভাগকে আলাদা করে দিতে হবে। পাঠ্যক্রমে পর্যটনের শিক্ষার্থীদের জন্য ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্সে ১ বছর ব্যবহারিক পাঠ্যক্রম যুক্ত করা আবশ্যক।
খ. মাস্টার্স ডিগ্রির ক্ষেত্রে আবশ্যিকভিত্তিকে থিসিস রিসার্চ যুক্ত করতে হবে।
গ. পর্যটনের শিক্ষার্থীদের কর্মস্থল কেবলই হোটেল – এইসব ভুল ধারণা প্রদান থেকে বিরত থেকে তাদের বিশাল কর্মক্ষেত্র সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা দিতে হবে।
ঘ. বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাথে শিল্পোদ্যাক্তাদের কোন সংযুক্তি না থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের ইটার্ণশীপে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটছে। এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর হস্তক্ষেপ জরুরি।
ঙ. পর্যটন যেহেতু বহুমুখী পাঠ্যক্রমের সমন্বয়ে তৈরি। তাই এই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পর্যটনের গ্র্যাজুয়েট ছাড়াও ফরেস্ট্রি, কৃষি, রসায়ন, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি গ্র্যাজুয়েট নিয়োগ দিতে হবে। সাবারাগামুয়া ইউনিভার্সিটি অব শ্রীলঙ্কা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যারা এই নিয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের ডিগ্রিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্য করেছে।

উপরের পদক্ষেপগুলি গ্রহণে ইউজিসিকে আদেশ দানসহ তা বাস্তবায়নে মনিটরিং করতে হবে। এছাড়া ইউজিসিকে পর্যটন বিভাগের জন্য এক্রিডিটেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতির ও গ্রেডিং ব্যবস্থার মধ্যে সমতা আনতে হবে। এইসব না করলে ভবিষ্যতে এইদেশে পর্যটনশিক্ষা অকার্যকর হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য যে, ইউজিসি যতœবান হলে আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে যথাযথভাবে গড়ে তুলতে পারবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা চূড়ান্ত বিবেচনায় পর্যটন ত্যাগ করবে এবং পর্যটনকে জীবনরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।

সরকারের করণীয়:
করোনাকালে এবং করোনাউত্তরকালে টেকসই নয় এমন অনেক কাজ সমাজ থেকে বিলুপ্ত হবে। কিন্তু থেকে যাবে পর্যটন। কারণ এর প্রয়োজনীয়তা অনাদিকাল পর্যন্ত থাকবে। কেবল অবয়ব ও উপযোগিতা পাল্টাবে মাত্র। তাই সরকারের দায়িত্ব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পর্যটন উদ্ধার ও উদ্ভাবনের জন্য ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া। আমাদের দেশে পর্যটনসম্পদের ইতিবৃত্ত জেনে তা ব্যবহারের পথে এগুতে হবে। পর্যটনের গবেষক, সুশীল সমাজ এবং শিল্প মালিকদেরকে এক কাতারে এনে সরকারকে স্বল্পমেয়াদে নিচের পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়ন করতে হবে:

ক. নিরাপদ উৎসস্থল থেকে নিরাপদ গন্তব্যে ভ্রমণ চালু করতে হবে। তবে অনিরাপদ উৎসস্থল থেকে কেউ নিরাপদ গন্তব্যে যেতে চাইলে তাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। অতপর অনিরাপদ উৎসস্থলগুলি নিরাপদ হলে পর্যায়ক্রমে যুক্ত করতে হবে। এতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক আত্মরক্ষার পথ খুঁজে পাবে।
খ. মার্কেটিংয়ের চেয়ে গন্তব্য বিনির্মাণে অধিকতর মনযোগী হতে হবে।
গ. বাংলাদেশের সকল ডেসটিনেশন ম্যানেজমেন্ট সংগঠনগুলিতে কার্যপরিচালনায় সহযোগিতা করতে হবে।
ঘ. স্থানীয় পর্যটকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষার আস্থা ফিরিয়ে আনার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঙ. প্রডাক্ট লাইন তৈরিতে প্রত্যক্ষভাবে কারিগরি সহায়তা প্রদান করতে হবে।
চ. স্টেকহোল্ডার ও পর্যটকদেরকে নানাবিধ নিয়মিত ও অনিয়মিত প্রশিক্ষণ দান অব্যাহত রাখতে হবে।
ছ. বিদেশি পর্যটকদের জন্য আগমনী স্থানে করোনা পরিস্থিতি পরীক্ষা ও পর্যালোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জ. পর্যটনকে জীবনরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও অনুশীলনের জন্য ‘গ্রীণ জোন ট্রাভেলিং পলিসি’ প্রণয়ন করতে হবে।

বেসরকারি খাতের করণীয়:
পর্যটনের বেসরকারি খাত কেবলই মানি মেকিং মেশিনের মতো সর্বোচ্চ লাভের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করনে পারে না। জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার বিশ্বব্যাপী পালনীয় পর্যটন নৈতিকতা অনুসরণ করে সব ধরণের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য পর্যটনসম্পদের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং পর্যটন কর্মীদেরকে প্রশিক্ষিত করা বেসরকারি খাতের অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব। পর্যটনের উন্নয়নের জন্য তাদেরকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলির সাথে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

পর্যটনকে জাতীয় জীবনে জীবনরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের পাশাপাশি পর্যটনের বেসরকারি খাতসমূহকে কার্যকরভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউজ, রেস্টুরেন্টসহ অন্যান্য সেবাদানকারী যেমন গাইড, ট্যুরিস্ট কোচ, নৌকা, লঞ্চ, আকাশযান ইত্যাদিকে বাণিজ্যিক কার্য পরিচালনার পাশাপাশি গবেষণায় অর্থ ব্যয় করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদেরকে ইন্টার্ণশীপের জন্য আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাতে হবে। অধিকন্তু, পর্যটন উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য সংস্থা যেমন ব্যাংক, ট্যুরিস্ট পুলিশ, পর্যটন লেখক সংঘ, পর্যটন সাংবাদিক ফোরাম, এনজিও এদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি এদেশে পর্যটনের একটি সুশীল সমাজ গড়ে তুলতে হবে। কেননা, সুশীল সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা দিয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রে একটি চেতনা তৈরি করে। তাঁদের এই অবদান পর্যটনকে জীবনধারায় যুক্ত করার জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে পর্যটন কুটনীতি অনুশীলনের বিষয়েও নজর দিতে হবে। কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালনে বেসরকারি পর্যটন উদ্যোক্তাদের রয়েছে বিশাল নৈতিক দায়। এসকল করণীয়গুলি পালন করলেই দেশে পর্যটনকে জীবনরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পর্যটনকে জীবনরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে হয়তো আমাদের আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়কে স্বাগত জানাতে হবে।

উপসংহার
পৃথিবী এখন অনাকাঙ্খিত স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করছে। তাই মানুষ দৃঢ়ভাবে অর্থনৈতিক আত্মরক্ষা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অনুসন্ধান করছে। বিপর্যয়ের অনেকগুলি উপাদানের মধ্যে পর্যটন অন্যতম এবং পর্যটনের উপর আসা আঘাত অনেক গভীর। জানুয়ারি-মার্চ ২০২০ ত্রৈমাসে পৃথিবীর পর্যটন ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারিয়েছে। তাই অর্থনৈতিক দায় কমানোর জন্য আমাদেরকে নিরাপদ উৎসস্থল থেকে নিরাপদ গন্তব্যে ভ্রমণ চালু করতে হবে। তা না হলে আরো অধিক সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৯৮% পর্যটন কর্মী সাময়িকভাবে কাজ হারিয়েছে। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে এদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মীকে কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনা। এতদোদ্দেশ্যে, গন্তব্যগুলিকে সুরক্ষিত করা, নিরাপদ সেবাদান নিশ্চিত করা এবং পর্যটকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন প্রধান কাজ। আগামী শীতের আগেই সকলের যৌথ প্রচেষ্টায় এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, অন্যথায় সংকট আরো ঘনীভূত হবে এবং ক্রমপুঞ্জিভূত ক্ষতি ও হতাশা আমাদেরকে গ্রাস করবে। পর্যটনকে জীবনরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্থিরচিত্তে প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয়গুলি বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে একাট্টা হয়ে এর উন্নয়নে উৎসর্গ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে আমাদের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় চিন্তা বাস্তবায়নের নামই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা কাজে লাগিয়েই আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

মোখলেছুর রহমান
আহবায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট এবং সভাপতি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন।

Leave a Reply