পর্যটন কুটনীতির প্রয়োজনীয়তা
Tweet
কুটনীতি মানে একটি দেশের প্রতিনিধি কর্তৃক অন্য একটি দেশের সাথে পেশা (Profession), কার্যক্রম (Activity) ও দক্ষতা (Skilll)-র মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা করা। সামাজিক সচেতনতা ও আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা অন্য রাষ্ট্রে নিজ দেশের পক্ষে এইসব আচরণ করে থাকেন। এর প্রধানতম উদ্দেশ্য নিজ দেশের রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করা ও অর্থনৈতিক অর্জন ধরে রাখা। বড় ও প্রভাবশালী দেশগুলি একভাবে এবং ছোট ও দূর্বল দেশগুলি অন্যভাবে কুটনৈতিক কার্যাবলি পরিচালনা করে। প্রত্যেক দেশ তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা অনুযায়ী কুটনৈতিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।
গ্রীক শব্দ Diploma থেকে Diplomate বা বাংলায় কুটনীতি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ দ্বিগুণ উৎসাহ। তাই কুটনীতির মাধ্যমে নিজ রাষ্ট্রের পক্ষে বাড়তি অর্জনের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৬৪৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম এই শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করা হয়। আধুনিক রাষ্ট্রে কুটনীতি হলো রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের এমন নীতি ও কর্মকান্ড যা অন্য রাষ্ট্রের সাথে বহিঃস্থ সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে নিজ দেশের বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়ন এবং বহিঃর্দেশে নিজ রাষ্ট্রের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষা করা।
কুটনীতির প্রকারভেদ:
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুটনীতি অনুশীলনের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হয়। অনুশীলনের ভিত্তিতে একে নিচের ৮ (আট) শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়-
ক) রাজনৈতিক কুটনীতি (Political Diplomacy): এই ধরণের কুটনীতির প্রধান বিষয় হলো উভয় দেশের মধ্যে ভিন্নমত নিয়ে সন্ধি স্থাপন কৌশল। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্য্যে যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে এই কুটনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তা সমাধানের সাধারণ রেওয়াজ পরিলক্ষিত হয়। যেমন ভারত ও বাংলাদেশের তিস্তার পানি বন্টন বিষয়ে সমস্যায় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি আলোচনা করে তা নিষ্পতি করেন।
খ) গানবোট কুটনীতি (Gunboat Diplomacy): শক্তি প্রদর্শন করাই এই ধরণের কুটনীতির প্রধান লক্ষ্য। সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়ন করা হয় এই কুটনীতিতে। যেমন ইরান ও আমেরিকা উভয় দেশই নিজ নিজ রাষ্ট্রের পক্ষে শক্তি সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে চায়।
গ) ডলার কুটনীতি (Dollar Diplomacy): কখনো এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে ঋণ বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা দিয়ে বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়ন করতে চায়। অর্থাৎ আর্থিক দায়ে জড়িয়ে ফেলার এক ধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এই কুটনীতিতে। যেমন বাংলাদেশকে অনেক ক্ষেত্রে জাপান, ভারত, চীন ইত্যাদি দেশ সহজ শর্তে বড় বড় ঋণদান করে।
ঘ) লোক-কুটনীতি (Public Diplomacy): কুটনীতিক ও রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে অন্য দেশকে প্রভাবিত করার রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডকে লোক-কুটনীতি বলে অভিহিত করা হয়। নিজ রাষ্ট্রের ন্যায্যতা দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতি অন্য রাষ্ট্রকে আকৃষ্ট করার জন্য এই ধরণের কুটনীতি সমধিক প্রচলিত। বিশেষত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্য দিয়ে এই কুটনীতির অনুশীলন করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের মানুষের ভাষা, খাদ্য, পোষাক ও মনস্তত্ত¡গত যে মিল তা সীমান্ত দিয়ে ভাগ করা হলেও লোক-কুটনীতি দিয়ে বজায় রাখা হয়।
ঙ) সাধারণের কুটনীতি (Peoples’ Diplomacy): উভয় দেশের মানুষের মধ্যে ঐতিহাসিক যোগযোগ, পারস্পরিক জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিনিময় এই কুটনীতির মূল বিষয়। যেমন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার মুক্তিযুদ্ধকালী সহযোগিতার ঐতিহাসিক সম্পর্ক সাধারণের কুটনীতির মাধ্যমে চির ভাস্বর থাকবে।
চ) মধ্যস্থতাকারী কুটনীতি (Intermediary Diplomacy): দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য যখন তৃতীয় কোন দেশ হস্তক্ষেপ করে তখন তাকে মধ্যস্থতাকারী কুটনীতি বলে। যেমন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার কোন সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে।
ছ) অর্থনৈতিক কুটনীতি (Economic Diplomacy): আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক লড়াই ও সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ধরে রাখা আধুনিক কুটনীতির সবচেয়ে বড় দিক। পণ্য ও সেবার আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ ইত্যাদির জন্য কুটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বৈদেশিক নীতির প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কুটনৈতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে একটি দেশ বিশ^ পরিমন্ডলে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় তার নিজস্ব অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে এক দেশ অন্য দেশের সাথে লাভজনক অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাদি বজায় রাখে। আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একটি দেশকে নিজ দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অর্থনৈতিক কুটনীতির অনুশীলনের বিকল্প নাই। যেমন বাংলাদেশকে এক দেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে হয় এবং অন্য দেশে কোন কোন উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করতে হয়। এই উদ্দেশ্যে তাকে বিভিন্ন দেশের সাথে বিভিন্ন মাত্রায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়।
জ) ডিজিটাল কুটনীতি (Digital Diplomacy): কুটনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য ইন্টারনেট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এর প্রধান লক্ষ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বøগ বা অন্য কোন ডিজিটাল মিডিয়াকে কুটনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবহার করা হয়। বৈদেশিক নীতি প্রচার করে নিজ স্বার্থ রক্ষার অথবা কোন অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে ইতিবাচক প্রচারণার জন্য ডিজিটাল মিডিয়াকে কাজে লাগানো হয়। যেমন একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কখনো কোন জরুরি বার্তা দেওয়ার জন্য ট্যুইট ম্যাসেজ পাঠান বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার্তা দেন।
পর্যটন কুটনীতির ধারণা:
উপর্যুক্ত শ্রেণিবিন্যাসে পর্যটন কুটনীতি অনুপস্থিত। কেননা এই কুটনীতি নবীণ এবং অসংগঠিত উপায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে মজার বিষয় এই যে, বিশেষজ্ঞগণ ইতোমধ্যে এর শক্তিশালী অবয়ব লক্ষ্য করতে শুরু করেছেন।
সমাজ, সংগঠন ও আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় পর্যটনের উচ্চতর কুটনৈতিক প্রয়োগ দৃশ্যমান হচ্ছে। এই ধরণের কুটনৈতিক চালে অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের অনুশীলন উৎকীর্ণ। রাষ্ট্র পরিচালনায় কুটনীতির যে কটি নতুন ও ব্যবহারির রূপ পরিলক্ষিত হয়, পর্যটন কুটনীতি এদের মধ্যে নতুন। আগামী দিনে পেশাদার ও রাজনৈতিক কুটনীতিক সবাইকে হয়তো পর্যটন কুটনীতির অনুশীলন করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি চীন অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে যে সফলতা দেখাচ্ছে তার পিছনে রয়েছে পর্যটন কুটনীতির অনুপুঙ্খ অনুশীলন। এ কথা চীনের কুটনীতিকগণ এবং রাজনীতিবিদগণ অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করছেন। তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য বাংলাদেশের পর্যটন কুটনীতির অনুশীলন অপরিহার্য।
শিক্ষাবিদদের দৃষ্টিতে সাংস্কৃতিক কুটনীতির Match-brand-ই পর্যটন কুটনীতি। পর্যটন ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক আন্তঃক্রিয়া বাড়ায় এবং মানুষকে নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্টতর করে। অর্থাৎ পর্যটন দুটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে স্থিতিশীলতা আনে। অর্থাৎ পর্যটনের এমন একটি বুনিয়াদী শক্তি রয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে একতা, সহমর্মিতা, আস্থা ইত্যাদি বৃদ্ধি পায় ফলে সাংস্কৃতিক জীবনের গুণগত উন্নতি হয়। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এই ধরণের পরিবর্তন বিশেষ সুনামের সাথে গুরুত্ব পাচ্ছে, যা কেবল পর্যটন দিয়েই অর্জন করা সম্ভব। আধুনিক পৃথিবীতে আত্মমর্যাদাশীল, সভ্য ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হলে পর্যটনের অবদানকে অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। তাই লোক-কুটনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে পর্যটনকে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাস্তবে পর্যটন কুটনীতি নিজ দেশীয় এবং ভিনদেশীয় মানুষকে অর্থনতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক কারণে কাছে টেনে আনছে। এই কুটনীতির অবদানকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
পর্যটন কুটনীতি দ্বিমুখী। নিচে তা উল্লেখ করা হলো-
ক) কুটনৈতিক পর্যটন (Diplomatic Toruism): রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রকৃত লাভের জন্য একটি দেশ যখন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমন্ডলে পর্যটন কার্যক্রমকে তুলে ধরে, তখন তাকে কুটনৈতিক পর্যটন বলে। যেমন চীনা নববর্ষে লক্ষ লক্ষ চীনা নাগরিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে বেরোয় এবং কালারফুল চীনা নৃত্যগীত পরিবেশন করে। তাদের এই পরিবেশনা অন্য দেশের মানুষকে চীন ভ্রমণে উৎসাহিত করে।
খ) পর্যটনীয় কুটনীতি (Touristic Diplomacy): পর্যটনের উন্নয়নের জন্য কুটনৈতিক কার্যক্রমকে যখন ব্যবহার করা হয়, তখন তাকে পর্যটনীয় কুটনীতি বলে। যেমন চীন থেকে প্রতœপর্যটকদেরকে বাংলাদেশে আকৃষ্ট করার জন্য যদি Archaeology-র শিক্ষক প্রফেসর ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানকে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে বিশেষ এটাচী করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পাঠানো যায়। তাহলে তিনি সেখানে গিয়ে ছাত্র, শিক্ষক ও Archaeological Resources পরিদর্শনে আগ্রহীদের কাছে বাংলাদেশের Archaeology-র বৈশিষ্ট্যাবলি তুলে ধরে একাডেমি ও প্রমোশনাল সেশান পরিচালনা করতে পারেন। পর্যটনীয় এই ধরণের কুটনীতি আমাদের মতো দেশগুলির জন্য বিশেষ সহায়ক।
পর্যটন কুটনীতির বৈশিষ্ট্য:
পর্যটন অনুশীলনের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করাই পর্যটন কুটনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাই একে অত্যন্ত মমতার সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনুশীলনের জন্য বিশেষজ্ঞগণ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কোন কোন গবেষক ট্যুরিস্ট গাইডকে মাইক্রো লেভেলে পর্যটনের কুটনীতিকের সাথে তুলনা করেছেন। কেননা, একজন ট্যুরিস্ট গাইড প্রদর্শনী ও বর্ণনার মাধ্যমে দেশি বা বিদেশি পর্যটকদেরকে দর্শনীয় বিষয়ে এবং স্বাগত জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা দিতে পারেন। গাইডের বর্ণনা সঠিক না হলে কিংবা ব্যাখ্যা একপেশে হলে তা পর্যটকদের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে ব্যাঘাত ঘটায় এবং পর্যটকদের মনে স্বাগত জনগোষ্ঠী বা গন্তব্য সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা জন্মাতে পারে, যা একজন বিদেশি পর্যটক নিজ দেশে ফিরে অন্যদের কাছে ভুল তথ্য প্রদান করবেন। তাই দেশে থেকেও একজন ট্যুরিস্ট গাইড বিদেশি পর্যটকদের কাছে কুটনীতিকের ভূমিকা পালন করতে পারেন। অন্যদিকে “পর্যটনের মাধ্যমে শান্তি” মতবাদের প্রবর্তক Dr. Louis D’Amore ১৯৮৮ সালে ভ্যানকুবার সম্মেলনে প্রত্যেক পর্যটককে একজন সম্ভাব্য শান্তির দূত বলে উল্লেখ করেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে গাইড হিসেবে কর্মরত পর্যটনের কুটনীতিককে উক্ত শান্তির দূতের জন্য যথাযথভাবে তৈরি করতে পারলে তিনি নিজ দেশের পক্ষে প্রকৃষ্ট কুটনীতিকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। পর্যটনের নীতি নির্ধারকগণ এইসব বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক সিদ্ধান্ত নিবেন এটি সকলের কাম্য। একটি ছোট্ট অবহেলা কিংবা উদাসীনতার জন্য কোনভাবেই যেন একজন পর্যটক ভুল তথ্য না পান, সে বিষয়ে রাষ্ট্রকে নজর দিতে হবে। পর্যটন কুটনীতি তাই সৃজনশীলতায় মোড়ানো রাষ্ট্রের এক নবতর বিধান।
পর্যটকদের ভ্রমণের প্রধানতম উদ্দেশ্য থাকে গন্তব্যস্থলের সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানা, বুঝা এবং নিজেদের সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে দেখা। বিশেষত একটি গন্তব্যের সাংস্কৃতিক সঞ্চয়গুলিকে প্রত্যেক পর্যটন তার নিজ জীবনের সত্য হিসেবে উদঘাটন করতে চান। ফলে পর্যটকদের সাধারণ দেখার চেয়ে তা থেকে কীভাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবেন, এ বিষয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং পর্যটন স্টেকহোল্ডারদেরকে বিশেষ মনযোগী থাকতে হয়। এভাবেই পর্যটকদেরকে অনুগত করে গড়ে তুলতে পারলে তিনি একই গন্তব্যে পুনরায় ভ্রমণে আসেন। পর্যটন কুটনীতির এটি অত্যন্ত বড় বিষয়। আবার পর্যটকদেরকে কোন উপজীব্য বিষয় দেখানোর পাশাপাশি তাকে হস্তশিল্প, কৃষি, রন্ধনরীতি ইত্যাদির সাথে হাতে কলমে পরিচিত করানো বিশেষ প্রয়োজনীয়। তাই গাইড, ট্যুর অপারেটন এদের সবাইকে আইটেনারারি প্রস্তুতকালে পর্যটনসম্পদগুলির ধরণ, ব্যবহার ও সংরক্ষণরীতি সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। তা না হলে পর্যটকদের মানসপটে তা স্মরণীয় স্মৃতি তৈরি করতে পারবে না এবং ভবিষ্যতে তাদেরকে পুনরায় একই গন্তব্যে আকৃষ্ট করা যাবে না।
পর্যটন কুটনীতির উপযোগিতা:
পর্যটন কুটনীতিতে বর্তমান সময়ে চীনের উদাহরণ প্রনিধানযোগ্য। ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যা এবং (২০১৯ সালে) ৯৯ ট্রিলিয়ন ইউয়ান জিডিপির এই দেশটি পর্যটন কুটনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চায়না ট্যুরিজম একাডেমির ২০১৯ সালের রিপোর্টে বলেছে যে, ২০১৮ সালে চীন থেকে ১৪৯.৭২ মিলিয়ন পর্যটক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গমন করে। উদ্দেশ্য ছিলো অন্য দেশে ভ্রমণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন যা বিদেশে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্প স্থাপনে সহায়তা করবে। এতে করে অন্য দেশে ডলার কুটনীতি, লোক-কুটনীতি, সাধারণের কুটনীতি, অর্থনৈতিক কুটনীতি এবং ডিজিটাল কুটনীতি বিষয়ে কার্যক্রম দক্ষতার সাথে পরিচালনা করবে। অর্থাৎ বহির্গামী পর্যটন পরিচালনার মাধ্যমে অন্য দেশে তাদের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সুদৃঢ় করার লক্ষ্যকে তারা যথাযথভাবে অর্জন করেছে। অন্যদিকে তাদের পণ্য, মেশিনারি, প্রযুক্তি এবং শিক্ষা গ্রহণের জন্য ২০১৮ সালে ১৪২.২ মিলিয়ন পর্যটক চীনে আগমন করেছে। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর সেরা ৫০০ কোম্পানির মধ্যে ১১৯টি এবং পৃথিবীর ১০টি বৃহত্তম কোম্পানির মধ্যে ৫টিই চীনা মালিকানাধীন। পর্যটন কুটনীতির মধ্য দিয়ে চীনের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং ব্যালেন্স অব ট্রেড সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই চীনের গানবোট কুটনীতির প্রয়োজন হয় না। চীনা জাতি সকল কুটনীতির সমন্বয়ে পর্যটন কুটনীতির চালে সেরা অবস্থানে নিজেদের স্থান তৈরি করে নিয়েছে। একই রকমভাবে তুরস্কও পর্যটন কুটনীতি প্রয়োগ করে তাদের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে।
পর্যটনের কিছু নিশ প্রডাক্ট (Niche Product) পর্যটন কুটনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। যেমন ইরানের উষ্ণ জলধারা, নেপালের হিমালয়ে মাউন্টেনিয়ারিং, সৌদি আরবের হজ, ভারতের আয়ুর্বেদিক পর্যটন, বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের কোরাল রিফ ইত্যাদি। পর্যটন কুটনীতিতে এই সকল উপাদানের শক্ত অবস্থান রয়েছে। তবে এ সকল সম্পদ যে দেশগুলিতে রয়েছে, সর্বাগ্রে তাদেরকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কুটনীতিতে নিজেদের সুদৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
পর্যটন কুটনীতিতে বাংলাদেশের করণীয়:
বাংলাদেশকে পর্যটনীয় কুটনীতি অর্থাৎ পর্যটনের উন্নয়নের জন্য কুটনৈতিক কার্যক্রমকে ব্যবহার করতে হবে। তবে এর পূর্বশর্ত হিসেবে রাজনৈতিক কুটনীতি ও সুশাসনে গভীরভাবে মনযোগী হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়। কুটনীতির এই ফ্রেমে দেশের সম্মানজনক অবস্থানকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দৃঢ়তার সাথে উপস্থাপন করতে হবে। তা না হলে গন্তব্য দেশ হিসেবে অন্যদেরকে গ্রহণ করানো যাবে না। কারণ দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদের পরিমাণ বেশি থাকলেও ইমেজ অত্যন্ত বড় বিষয় যা আমাদেরকে এগোতে দেয় না। এসব ঠিক করা গেলে পর্যটন কুটনীতি সফলতা পাবে এবং মানসম্মত পর্যটন সেবাকে নিশ্চিত করা যাবে। এ জন্য আমাদের বর্হিদেশীয় দূতাবাসগুলির কুটনীতিকদেরকে আরো পর্যটনে সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে হবে। পর্যটন সেবার ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানের জন্য আমাদেরকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। এই উদ্দেশ্যে আমলা, কুটনীতিক, পর্যটন শিক্ষাবিদ এবং স্টেকহোল্ডাদের সমন্বয়ে পর্যটন কুটনীতির নতুন রূপরেখা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। মনে রাখতে হবে, অন্য দেশের পর্যটন কুটনীতি অনুসরণ না করে আমাদের উপযোগী পর্যটন কুটনীতি গড়ে তোলা জরুরি। পাশাপাশি পর্যটন কুটনীতি বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার সূচনা করা দরকার। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সুযোগ অনুসন্ধানের জন্য পর্যটন কুটনীতি সর্বকনিষ্ট উপায় বটে। তবে এর গভীরতা ও প্রয়োগ অত্যন্ত অর্থবহ।
উপসংহার:
পর্যটন কুটনীতি পৃথিবীতে সর্বকনিষ্ট প্রায়োগিক কুটনীতি। তবে এর ব্যাপকতা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে অধিকতর প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষত করোনাকালীন এবং করোনা উত্তর সময়ে অর্থাৎ এখন থেকে অন্তত এক দশক পর্যন্ত পর্যটন কুটনীতি হবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে টেকসই উন্নয়নের প্রধান অস্ত্র। পৃথিবীকে আমরা যতই Global Village বলে মনে করছি, পর্যটন কুটনীতি ততই প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। এক রাষ্ট্রের উপর অন্য রাষ্ট্রের আধিপত্তের সময় বোধ করি শেষ হতে চলেছে করোনার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। এরপর যে পৃথিবী আমরা দেখবো ২০২৫ সালে, তাতে পর্যটন কুটনীতিই হয়তো প্রধানতম সৃজনশীল কুটনীতি হিসেবে প্রতিভাত হবে। আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের ভাষাও পাল্টে যাবে। যেখানে অর্থ ও মানবতা এক সারিতে এসে দাঁড়াবে, এমন আশা করার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি!
মোখলেছুর রহমান
আহবায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট এবং
সভাপতি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন