পর্যটন শ্রমিক ও মে দিবসের দায়
Tweet
আজ ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহিদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। এই ঘটনাকে স্মরণ করেই ১৮৯০ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৮০টি দেশে এই দিনটি সরকারি ছুটির দিন।
বাংলাদেশে অন্যান্য শ্রমিকদের মতো গত ২ দশকের বেশি সময় ধরে পর্যটন শ্রমিকদেরও উন্মেষ ঘটেছে এবং সাড়ে ১৮ লক্ষ প্রত্যক্ষ শ্রমিকসহ এদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। কিন্তু এরা অসংগঠিত, এদের কোন শ্রমিক সংগঠন নাই, কেউ এদের জন্য মুখ খুলে না, সংকটে, দুর্দিনে কিংবা সমর্থনে এদের পাশে থাকেও না। সবচেয়ে বড় কথা কর্মস্থলে এদের কোন নিয়োগ রীতি, মজুরি কাঠামো, কল্যাণ ব্যবস্থা, দূর্ঘটনা ও জীবন বিমা ইত্যাদি কিছুই নাই। পর্যটন নিয়ে এদেশের সরকার, বুদ্ধিজীবি, গবেষক, বাণিজ্য সংগঠন এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও উদাসীন। এরা যদি না থাকতো, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে ৭৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা কোত্থেকে আসতো, তা কী ভেবে দেখেছেন কেউ? সবচেয়ে বড় দূর্ভাগ্য হলো যে, আমাদের দেশের আমলা ও নীতিনির্ধারক কেউই এদের সম্বন্ধে জানেন না।
এখন করোনাকাল চলছে। অন্যান্য শ্রমিকদের মতো এই ৪০ লক্ষ পর্যটন শ্রমিকও চরম অনিশ্চয়তায় ভূগছে। ইতোমধ্যে অনেকে চাকুরি হারিয়েছে, অনেকে হারানোর পথে। তবে চাকুরি হারানোর চেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা হলো এদের পাশে এমন কেউ নাই যারা প্রবোধ দিবে, আশা দিবে। অন্য শ্রমিকদের সাথে এই শ্রমিকদের বড় পার্থক্য হলো – এদের প্রায় সকলেই শিক্ষিত, মার্জিত, শিষ্টচারসম্পন্ন এবং আধাদক্ষ ও দক্ষ। হয়তো এজন্য এরা ভাঙচুর করে না, রাজপথে নেমে পথরোধ করে না, গাড়িতে আগুন দেয় না। নিরবে এরা জাতি গড়ার কাজে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছে, নিরন্তর অবদান রাখছে। তাই সময় এসেছে এদেরকে মূল্যায়ন করার, বাঁচিয়ে রাখার। যদি তা না হয়, তাহলে হয় এরা উছৃঙ্খল হবে নয়তো এই সেক্টর ত্যাগ করবে। একবার এরা পেশা ছেড়ে দিলে নতুন করে আবার কোথায় পাবো এতোগুলি শিক্ষিত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শ্রমিক? করোনা সংকটউত্তর কালে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটরদের কী দূরবস্থা তৈরি হবে! ভাবলে গা শিউরে উঠে। একটি সভ্য দেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা কোন সমস্যা নয়, সমস্যা হলো সেই সম্পদ বন্টনের মধ্য দিয়ে মানুষের কষ্টের লাঘব না করতে পারা।
পর্যটন পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম শিল্পখাত। অতি সম্প্রতিকালে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন যে, পর্যটন বাংলাদেশের উন্নয়নের গ্রোথ ইঞ্জিন এবং এটি আমাদের ৩য় ক্যাটাগরির আয়ের মাধ্যম। এ কথা থেকে পর্যটনের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। তাই আমাদের সদিচ্ছা, ধীশক্তি ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে পর্যটন শ্রমিকদেরকে সুরক্ষা প্রদানের কোন বিকল্প নাই।
আজকের মে দিবসে আমাদের যদি এই প্রতিজ্ঞা হয় যে, দেশের স্বার্থে সরকার এবং মালিকপক্ষ মিলে ৪০ লক্ষ পর্যটন শ্রমিকদেরকে তাদেরকে পেশায় ধরে রাখবো, তাহলেই দিনটি প্রকৃত মর্যাদা পাবে। তা না হলে এটি হবে মে দিবসে আমাদের বড় দায় – যা আগামী প্রজন্মের কাছে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিবে।
লেখকঃ আহবায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট।
সভাপতি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন