পেশাজীবির চোখে পর্যটন সমস্যা ও সমাধান প্রস্তাবনা
Tweet
পৃথিবীর প্রতিটা দেশেরই কিছু না কিছু পর্যটন আকর্ষণ থাকে। যার কিছুটা মানবসৃষ্ট কিছুটা প্রকৃতিক। আমাদের দেশও এর ব্যাতিক্রম নয়। মানবসৃষ্টের তুলনায় প্রাকৃতিক পর্যটন আকর্ষণই বেশি। অপার সৌন্দর্যে ভরপুর অনেক পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে আমাদের, যদিও তার সিংহভাগই অব্যাবস্থাপনায় নিমজ্জিত।
বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী পর্যটন খাত হতে পারতো বাংলাদেশের উন্নয়নের উত্তম পন্থা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এই খাতটি আজও যথেষ্ট অবহেলিত ও অবমূল্যায়িত। তিলতিল করে গড়ে ওঠা পর্যটন খাতে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। ২০১৯ সালে দেশের জিডিপিতে এই খাতের অবদান প্রায় ৭২,৩০০ কোটি টাকা। যাহোক আজ পর্যটনের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলবো না। এক যুগের বেশিসময় ধরে পর্যটন পেশার সাথে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতার আলোকে এর সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কথা বলবো।
সমস্যা সমূহঃ
বিশেষজ্ঞগণ বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে নানা শ্রেণীতে বিন্যাস করবেন হয়তো, আমি শুধু ধারাবাহিকভাবে চার শ্রেণীর ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। কারণ দেশের পর্যটন উন্নয়নে এদেরই বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করার কথা।
১. রাষ্ট্র প্রচালিত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান
২. পর্যটন খাত উন্নয়নের লক্ষে গঠিত বেসরকারি সংগঠন
৩. সেবা প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এজেন্ট
৪. সেবার গ্রাহক বা পর্যটক
উপরোক্ত চারটি শ্রেনীর মধ্যে সরাসরি রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত সংস্থা বা প্রতিষ্টানের মধ্যে রয়েছে,
ক. বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
খ. বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড।
গ. বাংলাদেশ পর্যটন করপরেশন।
ঘ. জেলা প্রশাসন।
রাষ্ট্র পরিচালিত উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোই মুলত পর্যটন উন্নয়নে চালকের আসনে।
প্রথমেই বলা যাক পর্যটনের সবচেয়ে বড় কর্তা প্রতিষ্ঠানটির কথা। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও সে নিজেই এখনো পরনির্ভরশীল। হ্যাঁ, আমাদের পৰ্যটন মন্ত্রণালয়ের কথাই বলছি। পর্যটন মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি অংশ বিশেষ মাত্র। স্বতন্ত্র একটি মন্ত্রণালয় না থাকাটা পৰ্যটন খাতের দুর্ভাগ্যই বটে। এছাড়াও কাজের ধারাবাহিকতা ও নেতৃত্বের সঠিকতার সংকট তো আছেই। দেশের মোট পৰ্যটন সম্পদের তালিকা কিম্বা মোট পর্যটক সংখ্যা কোন পরিসংখ্যানই মন্ত্রণালয়ের হাতে নাই। পর্যটন গবেষণামূলক কার্যক্রমও নাই। নেই কোন ব্যাংক ঋণ এর নীতিমালা। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫/৪০ লক্ষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এই খাতে অথচ পর্যটনকে এখনো শিল্পের মর্যাদাও দেওয়া হয় নাই।
স্বাধীনতার পর পরেই জাতির জনকের হাত দিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের (BPC) যাত্রা শুরু। বাংলাদেশর পর্যটন উন্নয়নের সার্বিক দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের ছিল, বিশেষ করে দেশ-বিদেশে পর্যটন ব্র্যান্ডিং। যার আশানুরূপ ফল কখনও দৃশ্যমান হয়নি ফলে শুরু থেকেই দেশের পর্যটন অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। এগুলোকে আমি একটি সরকারি সংস্থার ব্যর্থতাই বলবো।
এবার আসা যাক বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড প্রসঙ্গে, পর্যটনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আমাদের অনেকের কাছেই আশার আলো হিসেবে আত্বপ্রকাশ করেছিলো এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গত এক দশকের ধারাবাহিক কার্যক্রমে এই প্রতিষ্ঠানটিও তেমন কোনো সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি। অতীতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির (যারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নথিভুক্ত সংগঠনের প্রতিনিধি) সাথে মিটিং ও কিছু পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যার কোনো সুফল পর্যটনের স্টেক হোল্ডারদের কাছে পৌঁছে নাই এখনও। ২০১০ সালে বিটিবি গঠন করা হলেও এর সাংবিধানিক ম্যান্ডেড সমূহের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়নি। বোর্ডে প্রাইভেট সেক্টরের প্রতিনিধিত্বের অসমতাও এখানে গতিশীল কার্যক্রম এর অন্তরায় বলে আমি মনে করি। এছাড়াও টিও লাইসেন্সধারী ছাড়া অন্য সংগঠনগুলোর প্রতি বোর্ডের উদাসীনতা সফলতা অর্জনের অন্তরায়। অন্যদিকে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির বিদেশি একটি সংগঠনের (PATA Bangladesh chapter) সদস্য হওয়ার উদ্যেশ্যও আমার বোধগম্য নয় ।
আমাদের জেলা প্রশাসক মহদয়গন নিজ নিজ জেলায় পর্যটনের সভাপতি। অন্যান্য দাপ্তরিক কাজের চাপে তারা অনেকেই জানে না তাদের জেলায় কতগুলো পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে, তারমধ্যে কতগুলোকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোর কোনো সমস্যা আছে কি-না, সমস্যা থাকলে সমাধান কী হতে পারে, সারা বছর কতজন পর্যটক ভ্রমণ করে, পর্যটন সম্পদগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে কি না, ইত্যাদি। প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে স্বয়ংক্রিয় পর্যটন উইং না থাকাটাই একটি বড় সমস্যা।
পর্যটন খাত উন্নয়নের লক্ষে পেশাজীবীদের অনেকগুলো ট্রেড এসোসিয়েশন গঠিত হয়েছে বিগত ৩০/৪০ বছরে। এই সংগঠনগুলো প্রতিবছর একটি মেলা, একটি পিকনিক এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে নির্বাচন করে ক্ষমতা গ্রহণ (কখনও কখনও সেই নির্বাচন না করেও অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকতে চাওয়ার কারনে আদালতে যাওয়া) ব্যতীত দেশের সামগ্রিক পর্যটন উন্নয়নে তারা কী অবদান রেখেছে তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। দুঃখজনক সত্য হলো, পর্যটনকে শিল্প হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি আদায় করা কতটা জরুরী তা এই সংগঠনগুলো অনুধাবণই করে নাই কখনো। নতুন কোন সংগঠন ভালো কিছু করার চেষ্টা করলেও তাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেওয়ার অপসংষ্কৃতি তো আছেই।
এবার কথা বলব পর্যটন খাতে সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রসঙ্গে যেমন, ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট , ট্যুর গাইড , হোটেল ও রিসোর্ট , পরিবহন কোম্পানি ইত্যাদি। আমাদের দেশের দক্ষ কর্মীর যেমন অভাব আছে তেমনিভাবে যথেষ্ট অভাব আছে সুদক্ষ উদ্যোক্তারও। অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় অপরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ অপাত্রে জল ঢালারই নামান্তর। গত ৪/৫ বছরে এই খাতে অনলাইন/অফলাইন কেন্দ্রিক যত প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করেছে তাদের বেশির ভাগেরই পর্যটন বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা নাই। ফলে সেবার মানের পাশাপাশি অঙ্গীকারকৃত সেবা প্রদানেও ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া কিছু এজেন্ট পর্যটকদের অভ্যন্তরীন ভ্রমণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিরুৎসাহিত করে আর সেই সাথে রয়েছে সেবার মান ঠিক না রেখে মূল্য কমানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এসবই দেশীয় পর্যটনের জন্য ক্ষতিকর।
পর্যটক হচ্ছে পর্যটন শিল্পের সবচেয়ে বড় সম্পদ তথা হৃৎপিণ্ড। দেশীয় পর্যটনের যথেষ্ট প্রচার-প্রচারণা ও সেবার অপ্রতুলতার কারণে আমাদের বিরাট একটা সংখ্যক পর্যটক বিদেশ ভ্রমণে বেশি আগ্রহী। তাদের মধ্যে আবার অনেকেই বাজারের সবচেয়ে কম মূল্যের প্যাকেজ বুক করে আশা করেন পাঁচ তারকা মানের সেবা। ফলে সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের সংগে ভুল বোঝাবুঝি এমনকি অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। ট্যুর অপারেটর ও পর্যটকদের অসচেতনতাহেতু যত্রতত্র ময়লা ফেলার কারণে গন্তব্যের সৌন্দর্য ও পরিবেশ দুটোই হুমকির মুখে পরছে। দেশীয় পর্যটনের এই নোংরা পরিবেশের কারণেই অনেকে বিদেশ ভ্রমণে উৎসাহিত হচ্ছে। অথচ দেশের মধ্যেই বিদেশের তুলনায় কতগুলো পর্যটনগন্তব্য আছে যা প্রকৃতিগতভাবেই কতো সুন্দর। রবীন্দ্রনাথ কবিতায় বলেছেন
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
সমস্যার সমাধান প্রস্তাবনাঃ
আমাদের পর্যটনে হাজারো সমস্যা থাকলেও সবগুলো সমস্যাই সমাধানযোগ্য। পর্যটন বড় একটি খাত হিসেবে ভূমিকা পালন করছে বিগত বেশকিছু বছর যাবৎ। তাই সরকারের পক্ষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি নিচের কয়েকটি প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
# পর্যটনের জন্য সময় উপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
# স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ পর্যটন মন্ত্রণালয় স্থাপন করা।
# ঐতিহাসিক, প্রত্নত্বাত্তিক ও প্রাকৃতিক আকর্ষণ সমূহের সঠিক সংরক্ষণ ও যথাযথ প্রচার করা।
# কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পর্যটন রপ্তানি বৃদ্ধি করা।
# আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে শক্তিশালী সমন্বয় কমিটি গঠন করা।
# প্রতিটি জেলায় স্বয়ংক্রিয় পর্যটন উইং স্থাপন করা।
# সুনির্দিষ্ট পর্যটন প্রতীক ঘোষণা করা।
# পর্যটক ও পর্যটন সম্পদের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরী করা।
# এই খাতে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
# ট্যুরিজম বোর্ডে বেসরকারি প্রতিনিধিত্বের সমতা সাধন করা ।
# অধিকতর গবেষণায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কাজের স্বীকৃতি প্রদান করা।
# ট্রেড-বডিদেরকে টিও লাইসেন্স এর ভিত্তিতে নয় বরং তাদের সদস্যের স্ট্যান্ডার্ড সংখ্যার ভিত্তিতে ট্যুরিজম বোর্ডে নথিভুক্ত করা।
# রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাঁদাবাজি বন্ধ করা।
# দেশের সকল স্তরে পর্যটন বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা ।
আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুধাবন করতে দেরি করে ফেলেছি যে, পর্যটন মানেই শুধু আনন্দভ্রমণ নয়. “জীবন জুড়েই পর্যটন ” আর “প্রতিটি পর্যটকই সম্ভাব্য শান্তির দূত “। তাছাড়া যেমনটা ঘোষণা হয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি পর্যটন স্থানের মালিক সকল পর্যটক ” তাই আসুন আমরা আমানত হিসেবে রক্ষা করি আমাদের পর্যটন শিল্পকে।
পরিশেষে এটাই বলবো, সরকারকে আরও বেশি পর্যটনবান্ধব হতে হবে। মন্ত্রণালয় ও টুরিজম বোর্ড যদি বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে খ্যাতিমান পর্যটন বিশ্লেষক, লেখক, গবেষক ও পর্যটন স্কলারদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে তাঁদের পরামর্শ অনুসারে কাজ করে, তাহলে আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পই হবে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার। আমাদের পর্যটন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমরাও সারা পৃথিবীর পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকবো।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
লেখক,
কিশোর রায়হান
পরিচালক অপারেশন
বাংলাদেশ ট্যুরিজম অ্যাক্সপ্লোরারস অ্যাসোসিয়েশন – বিটিইএ