অসহায় অক্সিজেন বলছে আমি কার
Tweet
করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত শ্বাসকষ্ট থেকে জীবন রক্ষায় বাজার থেকে সিলিন্ডার ভর্তি অক্সিজেন সংগ্রহের দিকে ঝুঁকছেন বহু মানুষ, যাতে বেসরকারি উদ্যোগে অক্সিজেনের সরবরাহ ব্যবস্থায় তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে সংকটের সময় কয়েকগুণ দামে বিক্রি করতে হচ্ছে জানায় অক্সিজেন বিক্রেতারা। আর অসহায় মনে হয়েছে খোদ অক্সিজেন সিলেন্ডারকে। সে নিজে নিজেই বলছে হে অসহায় অক্সিজেন আমি কার?। এদিকে অক্সিজেন যে কতটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে এরই মধ্যে তার টের পাওয়া গেছে যখন কোন রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়া দৌড়ি করেও যখন অক্সিজেন মিলছে না, তখন রোগী রাস্তায় মারা গেছেন। গতকাল এমন খবর অনেক দৈেনে প্রকাশিত হয়েছে।
নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে কেনাকাটা বেড়েছে অনলাইনে, সেখানে অর্ডার করা অক্সিজেন সিলিন্ডার ১১ এপ্রিল ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মী। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি ও অক্সিজেন সরবরাহে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সঙ্কটের কারণে ইতোমধ্যেই সিলিন্ডারভর্তি অক্সিজেনের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। তবে গত সপ্তাহ থেকে চড়া দামেও মিলছে না জীবন রক্ষাকারী এই অক্সিজেন।
দেশে অ্যাজমা, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য কয়েক বছর ধরে অক্সিজেনের সিলিন্ডার ভাড়া দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। এর সঙ্গে বাসায় গিয়ে নার্সিং সেবা যুক্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা সেবা দেওয়ার নতুন একটি খাত তৈরি হচ্ছিল।
গত মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর এই খাতে বড় রকমের উল্লম্ফন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে বাসায় গিয়ে নার্সিং সেবাদানকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ এর কারণে গত দুই মাসে ফেইসবুক ও অনলাইনভিত্তিক শতাধিক প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে এই সেবাকেন্দ্রিক। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের সঙ্কটে পড়েছেন সবাই, প্রায় পাঁচ গুণ দাম বেড়ে মাঝারি মানের একটি অক্সিজেনের সিলিন্ডার ও আনুসাঙ্গিক সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ তিন মাস আগেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের এই সেট পাওয়া যেত পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায়।
বাংলাদেশে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে বোতলজাত অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে লিনডে গ্রুপ। দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইসলাম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। কিন্তু গ্যাসের বোতল অনেকটাই আমদানি নির্ভর।
সম্প্রতি অক্সিজেনসিলিন্ডারবিডি, অক্সিজেনবিডি, মেডিশপ ডটকম, লিনডে ডটকমডটবিডি, সিসমার্ক লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এবং কিছু ফেইসবুকভিত্তিক অক্সিজেন সরবরাহ কোম্পানির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সঙ্কট পরিস্থিতির চিত্র পাওয়া যায়।
অক্সিজেন সিলিন্ডারবিডির ব্যবস্থাপক আল ইমরান রুবেল বলেন, অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজে তার প্রতিষ্ঠানের দুটি মোবাইল নম্বরে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অনবরত ফোন আসছে। কিন্তু গত পাঁচ দিন ধরে নতুন করে কোনো অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি কিংবা ভাড়া দিতে পারছেন না। কারণ যেসব পণ্য ছিল তা ইতোমধ্যেই বিক্রি বা বুকড হয়ে গেছে।
“অনেকে বাসায় সংরক্ষণের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার চাচ্ছেন। অনেকে আবার শ্বাসকষ্টে পড়ে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন চাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে অনেকে ফোন করে রীতিমতো হাহাকার করছে। কিন্তু আমাদের এই মুহূর্তে কিছুই করার থাকছে না। কারণ পাঁচ দিন আগেই স্টক ফাঁকা হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই জেনেও অনেক ক্রেতা অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য জোর করে টাকা জমা দিয়ে গেছেন।”
তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় কয়েকটি ওয়েবসাইটে দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল করে। এদের সবাই ফোন ধরেই বলছেন, “অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। কবে আসবে তাও বলতে পারছি না। ৩-৪ দিন পর যোগাযোগ করেন।” এই কথা বলেই কেটে দেওয়া হচ্ছে সংযোগ।
ইমরান জানান, তিনি সম্প্রতি চীন থেকে প্রায় ১৫০০ সিলিন্ডারের একটি চালান এনেছেন। তবে এগুলোর অধিকাংশই আগাম বিক্রি হওয়া। “এই পরিস্থিতে চীনেও সিলিন্ডারের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। চীন থেকে দুই হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার সিলিন্ডারগুলো আনতে খরচ পড়ে যাচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা।”
মেডিশপ ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা রাকিব উদ্দীনও একই পরিস্থিতি বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, “তিন মাস আগে যেখানে সারা মাসে ৫০টি সিলিন্ডার ভাড়া বা বিক্রি করা যেত না সেখানে এখন দিনেই হাজার হাজার ফোন আসছে সিলিন্ডারের জন্য। কিন্তু এতো চাহিদা পূরণ করার সক্ষমতা আমাদের কখনও ছিল না, এখনও নেই।
“আমরা কয়েক দিন ধরে নতুন কোনো ক্রেতার সঙ্গে লেনদেন করতে পারছি না। আগে যাদেরকে ভাড়া দিয়েছিলাম তাদেরকে রিফিল করে দেওয়ার জন্য ১০০টি বোতল মজুদ রেখেছি। ১৫ থেকে ২০ দিন পর আরও প্রায় দুই হাজার সিলিন্ডারের একটি চালান চীন থেকে আসবে।”
নার্সিং হোম কেয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠান বলছে, তারা ঢাকা শহরের ভেতরে দুই ঘণ্টার মধ্যে অক্সিজেন সাপোর্ট হোম ডেলিভারি ফুল প্যাকেজ ২৬ হাজার ৪৫২ টাকার মধ্যে দিচ্ছেন। বিওসি লিনডে অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন টলি, ফ্লো মিটার ও মেডিকেল মাস্ক এই প্যাকেজের মধ্যে থাকছে।
সম্প্রতি নতুন করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়া কাস্টমসের ঢাকা বিমানবন্দর কার্যালয়ের কর্মকর্তা ফয়সাল বিন আশিক জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি এক পরিচিত দোকান থেকে ১৬ হাজার টাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের একটি প্যাকেজ কিনেছেন। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানেন এর বাজারমূল্য আরও বেড়ে গেছে।
সম্প্রতি স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। শুধু তিনি নন এই অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ আরও অন্তত ১৭ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
তবে তাদের মধ্যে অবস্থা খারাপ হয়েছিল আগে থেকেই হৃদযন্ত্রের জটিলতায় ভোগা মনজু শাহরিয়ারের।
বর্তমানে কিছুটা সুস্থতার পথে থাকা শাহরিয়ার বলেন, তার জন্য আগে থেকেই বাসায় একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিছু দিন আগে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তিনি সিলিন্ডারের অক্সিজেনের সাহায্য নেন।
“কোন পরিস্থিতিতে কত মাত্রায় অক্সিজেন গ্রহণ করতে হবে তার একটি ভিডিও টিউটোরিয়াল আমি আগে থেকেই জেনে নিয়েছিলাম। ব্যাপারটি আসলে অতটা জটিল নয়,” বলেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আলোচিত এই কর্মকর্তা।
হাসপাতালগুলোতে ইতোমধ্যেই রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করায় কোভিড-১৯ রোগীদের বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়াকেই বেশি ভালো মনে করছেন ঢাকার জাতীয় নিওরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ফজলে এলাহী মিলাদ।
তিনি বলেন, সেজন্য কারও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ভাড়ায় অথবা বাজার থেকে কিনে অক্সিজেন সরবরাহের যে পদ্ধতিটি চালু হচ্ছে তা খুবই ইতিবাচক। এর ফলে অনেক প্রাণ হয়ত রক্ষা করা সম্ভব হবে।
“সাধারণ রোগীর শরীরে অক্সিজের উপস্থিতি ৯০ শতাংশের নিচে নামতে শুরু করলেই অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। পালস অক্সিমিটার নামে একটি সহজ ডিভাইসের মাধ্যমে অক্সিজেনের শতকরা উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায়। অক্সিজেন যদি ৮০ শতাংশ বা এর আশপাশে থাকে তখন বাসায় রেখে অক্সিজেন দিয়েও সঙ্কট মোকাবেলা করা হয়। আর এর চেয়েও কমে গেলে তখন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন হবে।”