কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ১০০০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ
Tweet
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা করেছেন, তাতে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পেয়েছে সবচেয়ে জরুরি হয়ে ওঠা স্বাস্থ্য খাত।
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যে কোনো জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যখাতে মোট ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। বরাদ্দের এই অংক জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মোট বাজেট বরাদ্দের ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসকে ‘সঠিকভাবে মোকাবেলা ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব দৃঢ়তার সাথে কাটিয়ে ওঠার’ স্বার্থে এবার গতানুগতিক বাজেটের ধারা থেকে কিছুটা সরে এসেছেন তিনি।
“সে কারণে এবারের বাজেটে সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে কাঠামো পরিবর্তন আনা হয়েছে । স্বাস্থ্য খাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ , প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ।”
অর্থমন্ত্রী ২০২০-২০১১ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন।
গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকায় নেমে আসে।
এই হিসাবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেড়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ মোকাবেলায় গৃহীত কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতের জন্য এ বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে।
“স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত কার্যক্রম ১৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা।”
গত বছরের শেষে চীন থেকে শুরু হওয়া নতুন করোনাভাইরাসের মহামারী পুরো বিশ্বকেই এখন নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার ৫২ জন। মারা গেছেন ১ হাজার ৪৯ জন। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতার দিকগুলোও এই মহামারীর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে এবার সব বাজেট আলোচনার কেন্দ্রে ছিল স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ।২০১৯-২০২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং পুরো বাজেটের আকারের ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ দুদিন আগে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, বিগত এক দশকে দেশের মোট বাজেটের আকার চারগুণ বাড়লেও স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের পরিমাণ বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী মোট বাজেটের ১০ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দ বাস্তবায়নের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কথাও জোর দিয়ে বলে আসছিলেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার এবারের কাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ালেও সেই টাকা কীভাবে কোথায় খরচ হবে, তার বিশদ পরিকল্পনা বাজেট বক্তৃতায় দেননি।
স্বাস্থ্য–শিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি খাতের গবেষণা উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকার একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল গঠন করার প্রস্তাব রেখেছেন তিনি এবারের বাজেটে।
মুস্তফা কামাল বলেন, “এ গবেষণা তহবিল দক্ষ, কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য স্বাস্থ্য খাতে অভিজ্ঞ গবেষক, পুষ্টি বিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য ও সমাজ বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ,পরিবেশবিদ ও সুশীল সমাজ ও অন্যান্য উপযুক্ত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচচ্ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হবে।”
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সরকার বিদায়ী অর্থবছরে ৫২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জরুরি ভিত্তিতে। করোনা মোকাবেলায় দায়িত্ব পালনকালে আক্রান্ত ও মৃত্যুজনিত কারণে ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মানী দিতে ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “এ মহামারী মোকাবেলায় যা করণীয় তার সবকিছু সরকার করবে।”
অর্থমন্ত্রী জানান, হৃদরোগ, ক্যান্সার ও কিডনি চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা ইউনিট স্থাপন, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট কার্ডিওভাস্কুলার ইউনিট স্থাপন, বিদ্যমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার সম্প্রসারণ ও জোরদারকরণ ও সকল জেলা সদর হাসপাতালে নেফ্রোলজি ইউনিট ও কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করা হবে।
“করোনার মত ভবিষ্যতে অন্য মহামারী দেখা দিলে তা মোকাবেলার জন্য টেকসই আবিস্কার, রোগতত্ত্ব-রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে যথাযথ গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও গবেষণার কাজে আমাদের জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। দেশ হিসেবে আমরা যদি উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে পৌঁছাতে চাই, সমন্বিত স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণা নীতিমালা প্রণয়ন, তহবিল গঠন করা ও এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।”
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে ৪০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ২৫টি দশ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ৩টি বিশ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুমিল্লায় ১টি ১০০ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে।
তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে ইউনিয়ন পর্যায়ে নতুন ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ৭০টি এমসিডব্লিউসি নির্মাণ ও আরও ২৫০টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ (পুনর্নির্মাণসহ), পুরাতন ২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আধুনিকায়ন এবয় নতুন ১ হাজার ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করার কথা জানান অর্থমন্ত্রী।
আ হ মুস্তফা কামাল বলেন, “সরকারের নানা বিভাগের সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য-শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও এর গবেষণার জন্য একটি সমন্বিত বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন পলিসি তৈরি করা প্রয়োজন। এই পলিসি বা নীতিমালার লক্ষ্য হবে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণায় দেশকে ধীরে ধীরে উন্নত বিশ্বের সমকক্ষ করে তোলা।