দিশাহারা মৌলভীবাজারের পর্যটন নির্ভর নানা পেশার মানুষ
Tweet
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লকডাউনের বিধিনিষেধ উঠে গেলেও পর্যটনকেন্দ্র খোলার অনুমতি মেলেনি এখনও; ফলে পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারে হোটেল-রিজোর্ট মালিকদের ক্ষতির অংক ক্রমশ বাড়ছে, দুর্দশা বাড়ছে এ খাতের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর শ্রমজীবী মানুষের।জেলার হোটেল, রিজোর্ট, রেস্টহাউজ, রেস্তোরাঁসহ এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে প্রায় তিন মাস। বড় অংকের লোকসান গুণতে গুণতে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা চালু রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মালিকদের।বেকার হয়ে পড়েছেন ট্যুর গাইডসহ এ খাতের উপর নানাভাবে নির্ভরশীল পরিবারগুলো। এতদিন পর্যটকদের সেবা দিয়ে আসা প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের জীবন-জীবিকাও থমকে আছে।
মহামারীর কারণে সারা বিশ্বে সর্বপ্রথম যে খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি পর্যটন শিল্প। প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রাক্কলন অনুযায়ী, দেশে জুন পর্যন্ত পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা; ৩ লাখ ৯ হাজার ৫০০ কর্মী কাজ হারাবেন। এই সঙ্কট যত প্রলম্বিত হচ্ছে, ক্ষতিও বাড়ছে।
মৌলভীবাজার জেলায় লাউয়াছড়া বন, হাওর, বাইক্কাবিল, মাধবপুর লেক, হামহাম জলপ্রপাত, চা বাগান, আনারস বাগান, পান, আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা ও তাদের হস্তশিল্প, বর্ষিজোড়া ইকো পার্ক, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতসহ প্রায় দেড়শ পর্যটন স্পট সারা বছর পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকত, সেসব জায়গায় এখন বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। শ্রীমঙ্গল হোটেল-রিজার্ট মালিক সমিতির আহবায়ক আবু সিদ্দিক মো. মুছা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে ‘লকডাউন’ শুরু হলেও মৌলভীবাজারের হোটেল-রিজোর্টগুলো ১৮ মার্চ থেকেই বন্ধ। খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোও কাছাকাছি সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।‘প্রায় তিন মাস ধরে বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকা লোকসানে পড়েছেন জেলার পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।’
তিনি বলেন, মৌলভীবাজারে সরকারি বে-সরকারি মিলে প্রায় দেড়শ হোটেল-রিজোর্ট রয়েছে, যার মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় সবচেয়ে বেশি। এর ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল কয়েক লাখ মানুষ; তারা এখন বেকার।পর্যটন খাতের আরেক ব্যবসায়ী এসকে দাশ সুমন বলেন, শুধু হোটেল রিসোর্ট নয়, শ্রীমঙ্গলের বেশ কিছু কৃষিপণ্যের ব্যবসাও পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল।পর্যটকরাই শ্রীমঙ্গলের লেবু, আনারস, চা ও মনিপুরী শাড়িসহ হাতে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর বড় ক্রেতা বলে জানান তিনি।শ্রীমঙ্গল ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তাপস দাশ বলেন, মৌলভীবাজার জেলায় ৭০ জনের মত ট্যুর গাইড রয়েছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন শুধু এ কাজই করেন। কাজ হারিয়ে গত তিন মাস তারা খুবই কষ্টে আছেন। সরকারিভাবে ট্যুর গাইডদের জন্য আলাদা কোনো সহায়তা মেলেনি।এ জেলায় নামিদামি পাঁচ তারকা মানের হোটেলসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় হোটেল-রিজোর্ট, কটেজ ও গেস্ট হাউজ রয়েছে, যেগুলোতে একশ থেকে চারশ লোকও কাজ করেন।
শ্রীমঙ্গল গ্র্যান্ড সুলতান টি রিজোর্ট অ্যান্ড গল্ফ-এর সেলস অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক শাহ আরিফ আলী নাসিম বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় চারশ লোক কাজ করেন। এখন প্রতিষ্ঠানের আয় শূন্যের কোঠায়। তারপরও আমরা প্রত্যেকের বেতন-ভাতা অব্যাহত রেখেছি।’
এই সঙ্কটে গ্র্যান্ড সুলতান রিজোর্টের ক্ষতি কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেন এজিএম আরমান খান।একই কথা বলেন শ্রীমঙ্গল গ্র্যান্ড সেলিম হোটেল অ্যান্ড রিজোর্টের পরিচালক সেলিম আহমদ।তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসায় নেমে এখন তারা দিশেহারা। সরকারের প্রণোদনা না পেলে অনেক রিরোজর্ট মালিককে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।
শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম সোহাগ মিয়া বলেন, এ এলাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ীই পর্যটন নির্ভর। খাবার হোটেল থেকে শুরু করে মিষ্টির দোকান, এমনকি অনেক পান দোকানও বন্ধ রয়েছে, কারণ পর্যটক না থাকলে ব্যবসাও থাকে না। ‘হাটেল বন্ধ থাকলে সরবরাহকারীদের ব্যবসাও বন্ধ থাকে। মুরগি ব্যবসায়ী, মাংস ব্যবসায়ী, মাছ ব্যবসায়ী, চাল ব্যবসায়ী, মুদি দোকানিসহ আরও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’মৌলভীবাজার জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন শ্রীমঙ্গল উপজেলা সভাপতি ময়না মিয়া বলেন, উপজেলায় ১৩৭০ জন নিবন্ধিত শ্রমিক আছেন, তার মধ্যে ৭ থেকে ৮শ জন কার, মাইক্রোবাস, জিপ বা অন্য বাহনের চালক পর্যটন খাতে নিয়োজিত ছিলেন।‘করোনাভাইরাসের কারণে এতদিন যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। এখন বিধিনিষেধ শিথিল হলেও পর্যটক না আসায় তাদের অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।’ মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বলেন, ‘এটি একটি পর্যটন জেলা। এখানে পর্যটননির্ভর লোকের সংখ্যা বেশি। অবস্থা বিবেচনায় ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের খাদ্য সহায়তা করা হয়েছে। লকডাউনের কারণে ক্ষতির মুখে পড়া পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সহায়তার বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন দপ্তরে অবহিত করা হবে।’