বাংলাদেশের প্রতি ১০০ জনে ২৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত
Tweet
নমুনা পরীক্ষা বাড়লে করোনা ভাইরাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ক্রমে কমার কথা। কিন্তু দেশে এর ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ক্রমে বাড়ছে । কিছুদিন ধরে দেশে সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৩–এর ঘরে পাওয়া যাচ্ছে। দেশে সংক্রমণের চতুর্থ মাসে এসে গড় করলে পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ২১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রোগী শনাক্তের হারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। বাংলাশের ওপরে রয়েছে আফগানিস্তান। দেশটিকে শনাক্তের হার ৪৪ শতাংশ। ভারত ও পাকিস্তানে শনাক্তের হার যথাক্রমে ৬ ও ১৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের শনাক্তের হারের এই চিত্র কয়েকটি বিষয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে। তার একটি হলো এখনো দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া এখনো প্রয়োজনের তুলনায় দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের পরীক্ষা কম হচ্ছে। গণহারে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। পরীক্ষা করার পর যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো যথাযথভাবে নেওয়া হচ্ছে না।
গতকাল রোববার পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৩০৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৪৬৪ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ৪৫ হাজার ৭৭ জন। গতকাল নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ১৫ হাজার ৫৮৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩ হাজার ৫৩১ জনের করোনা (কোভিড-১৯) শনাক্ত হয়। গতকাল সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৩৯ জন।
দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা প্রথম জানা যায় ৮ মার্চ। এরপর গতকাল পর্যন্ত ১০৬ দিনে মোট পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে শুরুর দিকে পরীক্ষা ছিল একেবারে সীমিত। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে নমুনা পরীক্ষাকেন্দ্র, পরীক্ষার সংখ্যা ও পরিধিও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৬১টি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে গড়ে ১৫ হাজারের মতো নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংক্রমণ শুরুর পর প্রথম এক মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তখন রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর পরে প্রতি মাসে দৈনিক পরীক্ষা এবং শনাক্তের হার দুটোই বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় মাসে (৯ এপ্রিল থেকে ৮ মে) প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৭১৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশে। তৃতীয় মাসে (৯ মে থেকে ৮ জুন) প্রতিদিন গড়ে নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৯ হাজার ৫৪৮ জনের। এই সময় শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে।
৯ জুন থেকে শুরু হয় সংক্রমণের চতুর্থ মাস। এরপর গতকাল পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এই ১৩ দিনের মোট পরীক্ষার বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে ১৬ জুন থেকে প্রায় প্রতিদিন (এক দিন বাদে) শনাক্তের হার ২৩–এর ঘরে। দুদিন ছিল ২৩ শতাংশের ওপরে।
রোগী শনাক্তের হারে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। শীর্ষে আফগানিস্তান। ভারত ও পাকিস্তানে শনাক্তের হার অনেক কম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৩–এর ঘরে পৌঁছে গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত মূলত সন্দেহভাজনদেরই নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে এই হার ইঙ্গিত করে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, পরীক্ষা বাড়ালে সংক্রমণ তখনই কমবে, যখন পরীক্ষার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন রাখা) এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) নিতে হবে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, দেশে শুধু পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে আর রেড জোন, ইয়েলো জোনের আলোচনাই হচ্ছে।
আক্রান্তের শীর্ষে থাকা দেশগুলো এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের চেয়ে বাংলাদেশে পরীক্ষা কম হচ্ছে। কিন্তু শনাক্তের হার বেশি। আক্রান্তের শীর্ষে থাকা ২০টি দেশের মধ্যে ১৮টি দেশেই জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষার সংখ্যায় বাংলাদেশের থেকে পিছিয়ে আছে কেবল মেক্সিকো।
ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্তের শীর্ষে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে সাড়ে ৮৪ হাজার জনের পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ভারতে প্রতি ১০ লাখে প্রায় ৫ হাজার জনের পরীক্ষা হয়েছে। সে দেশে রোগী শনাক্তের হার ৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানে প্রতি ১০ লাখে ৪ হাজার ৮৫৫ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। রোগী শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
আফগানিস্তানে গতকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ছিলেন ২৮ হাজার ৮৩৩ জন। দেশটিতে পরীক্ষা করা হয়েছে প্রতি ১০ লাখে ১ হাজার ৬৭০ জনের। মোট পরীক্ষা করা হয়েছে ৬৪ হাজার ৯৫৮ জনের। রোগী শনাক্তের হার ৪৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ৩ হাজার ৭৩৬ জনের পরীক্ষা হয়েছে। রোগী শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।
সংক্রমণের ধারা বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন রোগী শনাক্ত করতে যদি ১০ থেকে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা যায়, তাহলে পরীক্ষা পর্যাপ্ত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। সরকারি হিসাবে গতকাল পর্যন্ত দেশে একজন রোগী শনাক্ত করতে ৫ দশমিক ৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভারত ও নেপালে ন্যূনতম প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরীক্ষা করা হচ্ছে।
আইইডিসিআরের পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন বলেন, দেশে শনাক্তের হার মে মাসের শেষ থেকে বাড়ছে। এখন ২০ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। এখান থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে। শুরুতে সংক্রমণের গতি ছিল মৃদু। এখন মাঝারি গতিতে ছড়াচ্ছে। নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিলে এটা দ্রুত গতি লাভ করবে।