গ্রীষ্মকালীন ছুটির সেইসব দিনগুলি
Tweet
লকডাউনের করণে ফুলটাইম অফিস করলেও অফিসে যাওয়া-আসা, পোশাক পরা ও পাল্টানোর কাজে সময় বেঁচে যাচ্ছে। তাছাড়া বাজারে বা বাইরে যাওয়া তো খুবই সীমিত। তাই বিক্ষিপ্ত মনটা মাঝে মাঝেই অনেক দূর ভ্রমণে চলে যায়। কাল যেমন গিয়েছিলো সেই ছোট্ট বেলায়।
ছোটবেলায় অন্য অনেকের মতোই আমরাও গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যেতাম। ছুটির এক-দুই মাস আগেই ক্যালেন্ডারের পাতায় নির্দিষ্ট তারিখটা গোল করে শুরু হতো অপেক্ষা। বাড়ি যাওয়াকে কেন্দ্র করে ভাইয়েরা মিলে কত পরিকল্পনা, কত খেলনা সামগ্রী জমানো। প্রতিদিন একটা একটা করে তারিখ কাটতাম, তারপর একসময় সেই শুভদিনটা এসে যেত। আজ বাড়ি যাওয়ার দিন, আজ ডানা মেলানোর দিন।
যাইহোক, রাজশাহী থেকে গ্রামের বাড়ি মাগুরায় পৌঁছেই কোনোমতে জামাজুতো খুলে দৌঁড় দিতাম আমবাগানে। গিয়ে দেখতাম কোন গাছে কত আম। তারপর চলতো আমাদের কতশত অভিযান। সকালে উঠে আম দুধ আর সাথে মুড়ি বা খৈ দিয়ে নাস্তা। তারপর পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, বা চাচাতো ভাই বোনদের নিয়ে পেঁয়ারা গাছে উঠে পেঁয়ারা পেড়ে খাওয়া। আমাদের পুকুর পাড়েই ছিল বিশাল একটা জামরুল গাছ। অতি মাত্রায় জামরুল ধরার কারণে গাছটি সুবুজ আর সাদার এক দারুন ছবির মতো মনে হতো। কখনো সেই জামরুল গাছে উঠে বেছে বেছে বড় আর পাকা জামরুল পাড়া। কখনো বা উঁচু কোন আমগাছে উঠে কয়েকটা আম পেড়ে খাওয়া। শুরু হতো প্রতিযোগিতা, কে কাকে পেছনে ফেলে আরো উপরে গাছের মগডালে উঠে যেতে পারে। তারপর সুবিধামতো একটা ডালে হেলান দিয়ে বসে সবাই মিলে সমস্বরে গলা ছেড়ে গান গাওয়া। “মাঝি বাইয়া যাও রে…. আমার খাতায় প্রতি পাতায় প্রতি কবিতায় …. তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর …” এরকম আরও কত গান।
তারপর দুপুর গড়িয়ে গেলে মা-চাচির বকুনি খেয়ে পুকুরে বা বাড়ির পাশের বিশাল ক্যানেলে ঝাঁপিয়ে গোসল করা। সময় মতো পুকুর থেকে না উঠার জন্য আবার লম্বা বাঁশের বাড়ি খাওয়া। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আবার খেলতে যাওয়া। গোল্লাছুট, দাড়িয়াবাঁধা, লুকোচুরি খেলে সন্ধ্যা বেলা ঘরে ফেরা। তারপর সবাই পুকুর ঘাটের মাচায় নেমে হাতমুখ ধুয়ে উঠানে গোল হয়ে বসে গল্প বলা। এর মধ্যে হঠাৎ ধুম করে আম পড়ার শব্দ শুনে হারিকেন, বা টর্চ নিয়ে দৌঁড় দিয়ে কে আগে আমটার দখল নিবে তার প্রতিযোগিতা। মাঝে মাঝে আমি আর আমার চাচাতো ভাই যুক্তি করে একটা মাটির দলা বা ইটের টুকরা গাছে ছুড়ে মারতাম। সেটা গাছের পাতায় লেগে সরসর শব্দ করে ধুপ করে যখন মাটিতে পড়তো, তখন সবাই আম পড়েছে ভেবে পড়িমরি করে দৌঁড় দিতো আর আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে হাসতাম। কখনো সত্যি সত্যি আম পড়লেও আমরা বলতাম “অমুকে ঢিল ছুড়েছে”, তারপর যখন সবাই যেতে গিয়েও ফিরে আসতো তখন আমরা গিয়ে সেই আমটা কুড়িয়ে আনতাম। এরকম কত মজা করে সেইসব ছুটির দিনগুলো কাটতো।
মাঝে মাঝে ভয়ংকর ঝড়-বৃষ্টি হতো। তখন দাদি বা ফুপি আমাদের ছোটদের বের হতে নিষেধ করতেন। ঝড়ে অনেক সময় গাছের ডাল ভেঙে পড়তো। তারপরও আমরা যারা একটু বড়ো, তারা ঠিকই ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যেতাম আম কুড়োতে। গাছতলায় আম পড়ে বিছিয়ে থাকতো। কুড়িয়ে শেষ করা যেত না। কখনো কখনো গাছ থেকে আম এসে গায়ের উপরেই পড়তো। তাই মাথার সুরক্ষার জন্য বাসের মাথাল ব্যবহার করতাম। আর এক গাছ থেকে অন্য গাছের নিচে যেতে গিয়ে কেউ কেউ পা পিছলে আলুরদম হতো। বাকি সবাই সেই দৃশ্য দেখে আম কুড়ানো ফেলে হেসেই গড়াগড়ি।বিশেষ করে মা-চাচীরা কেউ আছাড় খেলে তো কথাই নেই। হাসির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হয়ে যেত।
মাঝে মাঝে বৃষ্টির সময় পুকুর থেকে জ্যান্ত কৈ মাছ কান দিয়ে মাটি ঘষতে ঘষতে বাড়ির উঠোনে চলে আসতো। তখন সেগুলোকে ধরে রাতের মেনুতে যোগ করা হতো। এভাবেই ফুড়ুৎ করে কখন যেন ছুটির সেই মজার দিনগুলো শেষ হয়ে যেত। চলে আসার দিন মা, দাদি, ফুপি, চাচি সবারই সে কি কান্না! সাথে আমার চাচাতো ভাই বোনরাও কান্না করতো। তখন খুবই খারাপ লাগতো। কিছুতেই আসতে মন চাইতো না। মনে হতো পৃথিবীটা এত নিষ্ঠূর কেন? শহরে না গিয়ে গ্রামে থাকলে কী এমন হয়…..
লেখকঃ মুস্তাফিজ রহমান