জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে খাইরুল
Tweet
পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা।
আমাদের এই পর্বের আয়োজন জনাব খাইরুল আমিনকে নিয়ে। তিনি পর্যটন নগরী কক্সবাজারে তিন তারকা মানের ‘হোটেল ইলাফ ইন্টারন্যাশনাল’ এর জেনারেল ম্যানেজার পদে কর্মরত আছেন।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে যারা ক্যারিয়ার গড়েছেন তাদের প্রায় সবার থেকেই খাইরুল আমিনের ক্যারিয়ার বিষয়ক গল্পটা আলাদা। তিনি যখন হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে যোগদান করেন তখনো দেশের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়াশোনা চালুই হয়নি। ফলে ইদানিং যারা হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ালেখা করে হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার গড়ছেন তাদের থেকে খাইরুলের গল্পতো একদম গোড়া থেকেই আলাদা। আবার তৎকালীন সময়ে যারা বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীন ন্যাশনাল হোটেল এন্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে কোর্স সম্পন্ন করে হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার গড়েছেন গল্পটা তাদের থেকেও আলাদা।
আদ্যান্ত ব্যতিক্রম খাইরুল আমিনের হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার শুরুর আগের গল্পটা আরও বেশি হসপিটালিটি দিয়ে শুরু। তার বড়বোন পিটিআই’য়ে ট্রেনিং নিতে একবছরের জন্য গিয়েছেন কক্সবাজার। সারাদিন ট্রেনিং তাই ছোট্ট সোনামণির যত্ন নেওয়ার জন্য একজন আপন মানুষ দরকার। গৃহকর্মীর কাছে আদরের সন্তানকে রেখে যেতে স্নেহময়ী মায়ের মন যেন সায় দিচ্ছে না। একদিকে ট্রেনিং অন্যদিকে ছোট্ট সোনামণি, বড় আপা পরেছেন উভয়সংকটে, ঠিক এই সময়ে আপাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে সদ্য গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা ছোটভাই খাইরুল আমিন। তোমার ছেলেকে আমিই সারাদিন দেখে রাখবো বলে আপাকে অভয় দিলেন খাইরুল।
ভাগ্নের সেবাযত্ন আর সন্ধ্যার পর কখনো শহর কখনো সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে যাওয়া, এভাবেই কাটছে তার কক্সবাজারের দিনগুলি। শহরের অলিগলি পরিচিত হয়ে উঠলে একদিন শখের বশেই কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসে জোনাল ম্যানেজার হিসেবে চাকরি নেন। ভেবেছিলেন আপার ট্রেনিং শেষ হলে তিনিও চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন কুমিল্লায়। শৈশব, কৈশোর কাটানো নিজ শহরের প্রতি ভালবাসা জেগে ওঠে মাঝে মধ্যেই। কিন্তু আপার ট্রেনিং শেষের দিন যতো ঘনিয়ে আসছে খাইরুলের মনে কক্সবাজারের জন্য মায়া যেন ততোই বেড়ে চলছে। শেষমেশ কক্সবাজারের মায়ার বাঁধনে এমনভাবে জড়িয়ে পড়লেন, ট্রেনিং শেষে আপা চলে গেলেও তিনি রয়ে গেলেন।
দিনের কাজকর্ম সম্পন্ন করে অবসর সময়ে তিনি সমুদ্রসৈকতে গিয়ে বসে থাকেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই সমুদ্রের পাড়ে বসে তিনি প্রতিদিনই ঢেউ দেখেন, গর্জন শোনেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, একই সমুদ্র, একই ঢেউ, একই গর্জন তবুও যেন পুরাতন মনে হয় না। প্রতিদিনই নতুন মনে হয়। একেকটা দিন যেন এমনও হয়, সৈকত থেকে ঘরে ফিরতে খাইরুলের মন বিষণ্ণতার ভারে নুয়ে পড়ে। সৈকতের পাশে সারিসারি হোটেল, সন্ধ্যার পর হয়ে ওঠে লাল-নীল আলোয় রঙিন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কুরিয়ার সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যেভাবেই হোক হোটেলে চাকরি নিবেন।
২০০৩ সাল রেনেসাঁ দি গ্র্যান্ড হোটেল। স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার শুরু এখান থেকেই। তারপর কেটে গেছে প্রায় দেড় যুগ। জনাব খাইরুল আমিন আজ ইলাফ ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার। মাঝখানে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হোটেল সী প্যালেস এর বিভিন্ন পদে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। পেশাগত উৎকর্ষতা সাধনের জন্য তিনি পর্যটন কর্পোরেশনের অধীন ন্যাশনাল হোটেল এন্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ফ্রন্ট অফিস অপারেশন বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। ২০০৫ সালে হোটেল সী প্যালেসে ফ্রন্ট অফিস এক্সিকিউটিভ পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ার পর দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে তিনি ধাপে ধাপে এক্সিকিউটিভ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, ডেপুটি ম্যানেজার এরপর ফ্রন্ট ডেস্ক ম্যানেজার পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি এইচএসপিএল ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ফ্রট অফিস বিভাগের ট্রেইনার হিসেবেও দ্বায়িত্ব পালন করছেন ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত।
সদাহাস্যজ্বল ও বন্ধুবৎসল খাইরুল আমিন তার চাকরি ও সংসারের মতোই বন্ধুদের প্রতিও যথেষ্ট যত্নশীল। পর্যটনের রাজধানী কক্সবাজারের হোটেলিয়ার হওয়ার সুবাদে সারাবছরই তাকে বন্ধুদের আবদার রক্ষা করতে হয়। মৌসুমে যখন কোনো হোটেলেই কোনো রুম খালি পাওয়া যায় না তখনো খাইরুল রক্ষা করে চলেন বন্ধুদের আবদার। নিজের হোটেলে রুম ফাঁকা না থাকলে অনেক খোঁজাখুঁজি অনেক চেষ্টা অনেক তদবির করে হলেও কোনো না কোনো হোটেলে তিনি ঠিকই ব্যবস্থা করে দেন। সেবা প্রদানে বরাবরই ক্লান্তিহীন ও আপোষহীন তিনি যখন যে প্রতিষ্ঠানেই যাচ্ছেন সেখানেই হয়ে উঠছেন নির্ভরতার প্রতীক। পেশাগত জীবনে একাগ্রতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে একাদিক্রমে সফলতা পাওয়া খাইরুল স্বপ্ন দেখেন তিনি একদিন ফাইভ স্টার হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার হবেন। খাইরুল আমিনের সেই সুন্দর স্বপ্ন শীঘ্রই পূরণ হোক পর্যটনিয়া পরিবার তা কায়মনোবাক্যে কামনা করে।
One thought on “জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে খাইরুল”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
Nice