জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে মাইনুল
Tweet
পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন জনাব মাইনুল সোহাগকে নিয়ে। তিনি এয়ার কিং ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে কর্মরত আছেন।
মাইনুল ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই স্বপ্ন পূরণের সাধের নোঙর সাধ্যের মোহনায় ফেলতে সক্ষম হননি তিনি। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সামর্থ্যের সবটুকু খরচ করে ব্যয়বহুল বেসরকারি মেডিকেলে পড়তেও মনে সায় দিলো না। অগত্যা ভর্তি হলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে।
পড়াশোনার আর বাবার ব্যবসায় সময় দেওয়া এই নিয়েই তার ব্যস্ততা। অনার্স শেষ হলো একদিন মাস্টার্সও শেষ হলো। বন্ধুরা বিভিন্ন চাকরিতে দরখাস্ত করা নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু মাইনুল ব্যস্ত বাবার ব্যবসায়। আসলে বিগত বেশকিছু বছর যাবৎ ব্যবসার পিছনে সময় দিতে গিয়ে ব্যবসা করার চেতনা তার মনের অজান্তেই জন্ম লাভ করেছে। সুতরাং তিনি মনস্থির করলেন বন্ধুদের মতো চাকরি নয় বাবার মতো ব্যবসা করবেন। তবে বাবার ব্যবসায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজের চেষ্টায় নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করবেন। মানুষের সেবা করার সুপ্ত ইচ্ছাটা মনের মধ্যে আগে থেকেই বিদ্যমান। এমন কী ব্যবসা করার আছে, যা করলে আর্থিক উপার্জনের পাশাপাশি মানুষের সেবা করারও সুযোগ পাওয়া যাবে!
মার্কেট রিসার্চ করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, বিশ্বব্যাপি সবচেয়ে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। বিশ্বে প্রতি বছর ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ একদেশ থেকে আরেক দেশে, একস্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমন করে নতুন কিছু দেখার আশায়, নতুন কিছু জানার আশায়। প্রতিদিন তারা খরচ করছে ৩৪০ কোটি ডলারেরও বেশি। যদিও বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে, তবুও তো আমাদের আছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। অন্যান্য অনেক ব্যবসার তুলনায় পর্যটন ব্যবসাকেই তার সম্ভাবনাময় মনে হলো। সুতরাং ব্যবসা করলে পর্যটন ব্যবসাই করবেন বলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন।
পর্যটন ব্যবসা অন্যান্য ব্যবসা থেকে আলাদা। এই ব্যবসা শতভাগ সেবা নির্ভর। প্রতিযোগিতার বাজারে পর্যটন জ্ঞান ব্যাতিরেকে পর্যটন ব্যবসা করে সফলতা অর্জন করার সম্ভাবনা শূন্য। তাই পর্যপর্যটন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হলেন। ক্লাস, পড়ালেখা, পরীক্ষা, পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেমিনার ও এক্সপোজিশনে অংশগ্রহণ, ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন সবই একসাথে চলতে থাকলো। পর্যটনের ব্যবসা করাই তার মূল লক্ষ্য। ফলে এমবিএ পড়াকালীন সময়েই ব্যবহারিক জ্ঞান অন্বেষণের জন্য তিনি অনেকগুলো গ্রুপের সাথে দেশের প্রায় প্রত্যেকটা পর্যটন গন্তব্য ভ্রমণ করতে শুরু করলেন।
২০১৪ সালে এমবিএ পাশ করার পর ২০১৫ সালেই দু’জন বন্ধুকে সাথে নিয়ে শুরু করেন Ento connection নামের একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। প্রথমে কিছুদিন ছোটো ছোটো ইভেন্ট ম্যানেজ করলেন খুব সফলভাবে। পরবর্তীতে কাজের পরিধি ক্রমশ বাড়লেও মেগা ইভেন্ট আয়োজনের পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবে বেশ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। তিনি বুঝতে পারছেন, গ্রাহককে আশানুরূপ সেবা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছেন। শুধু অর্থ উপার্জন করার জন্য সেবাব্রত মাইনুল ব্যবসা করতে আসেন নাই। তিনি এসেছেন ব্যবসার মাধ্যমে প্রত্যাশিত সেবা দিয়ে তিনি কিছু মুনাফা অর্জন করবেন। মাইনুল অনুভব করলেন, যেকোনো কাজ কার্যকর ও দক্ষতার সাথে (effective and efficient way) সম্পন্ন করতে অভিজ্ঞতা ভীষণ জরুরি। নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য তিনি নিজহাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিয়ে চলে আসলেন।
নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার প্রচণ্ড স্পৃহা। বাবার ব্যবসার বাইরে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় দাঁড় করানোর একাগ্রতা। সদ্য নিজের ব্যবসায় ব্যর্থতার পর তার হাতে এখন অবশিষ্ট আছে “ওয়ার্ল্ড লিংক এয়ার ওয়েজ ” নামের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে ইন্টার্নিশিপ করার অভিজ্ঞতাটুকু। মাইনুলের সামনে এখন দুটো পথ খোলা। একটা হচ্ছে বাবার ব্যবসায় ফিরে যাওয়া অন্যটা হচ্ছে ঐ সামান্য অভিজ্ঞতাটুকুর উপর ভ’র করেই লড়াই চালিয়ে যাওয়া। নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া মাইনুল বেছে নিলেন লড়াইয়ের পথ। খুবই সামান্য বেতনে ‘গ্লোব ট্রাভেল বিডি’ নামক একটা প্রতিষ্ঠানে রিজার্ভেশন অফিসার হিসেবে যোগদান করলেন।
নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে তিনি কাজ শেখার প্রতি বিশেষ মনযোগী হলেন। সারাদিন কাজে ডুবে থেকে তিনি আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বড় বড় করপোরেট হাউজগুলো বিজনেস ডিল করতে সফল হলেন। ফলে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি পারফরম্যান্স বোনাস, সেলস কমিশন মিলিয়ে যা উপার্জন করছেন তা খারাপ না। ক্ষেত্র বিশেষে, তার যেকোন ব্যাংকার বন্ধু বা বড় প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরীজীবি বন্ধুদের চেয়ে বেশিই বলা যায়। পরের বছর আরও বেশি কাজ, আরও ভালভাবে শেখার জন্য তিনি চলে আসেন ‘এয়ার কিং ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস’ নামের আরেকটা ট্রাভেল এজেন্সিতে। বর্তমানে এখানেই এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে আছেন মাইনুল।
বিগত বছরগুলোতে কর্মময় জীবনে তিনি এয়ার টিকেট, ভিসা প্রসেসিং, হোটেল রিজার্ভেশন, হলিউডে প্যাকেজ এবং হজ্জ প্যাকেজ নিয়ে কাজ করেছেন। কাজের প্রতি নিবেদিত মাইনুল সোহাগ এয়ার টিকেটের ক্ষেত্রে Gallileo ও Sabre এই দুটি GDS রপ্ত করেছেন। ইউরোপ আমেরিকা সহ বেশ কিছু দেশের ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে কাজ করছেন। এর বাইরেও ইন্ডিয়া, ভূটান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে বেশ কিছু করপোরেট প্যাকেজ পরিচালনা করেছেন। এমনকি অনেক সময়ই প্যাকেজের গুনগত মান বজায় রাখতে গাইড হিসেবে নিজেও ভ্রমণ করেছেন। একটি সফল ভ্রমণ সম্পন্ন করে পর্যটকদের সন্তুষ্টি ও হাসিমাখা প্রশংসা শুনতে ভালবাসেন তিনি।
মাইনুল সোহাগ নিজেকে সমৃদ্ধ করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছেন। ভ্রমণ বিষয়ক সকল খুটিনাটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছেন। প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সেবার গুনগত মান বাজায় রেখে পুরাতন গ্রাহকদেরকে ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন গ্রাহক আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হবার পর এতোগুলো বছরের চেষ্টা ও সাধনায় নতুন করে তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন। আত্মবিশ্বাসী মাইনুল পুরাতন স্বপ্নটাই একদিন নতুন করে আবার সাজাতে চান। তিনি আবার একজন পর্যটন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আমরা পর্যটনিয়া পরিবার কামনা করি, মাইনুল সোহাগ তার স্বপ্ন পূরণে সফল হোক।