জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে জাকিরুল
Tweet
পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন জনাব জাকিরুল ইসলাম খানকে নিয়ে। তিনি পর্যটনের সাবেক ছাত্র ও একজন উদ্যোক্তা। ফার্নিচার তৈরির আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘কারখানা’র প্রধান নির্বাহী হিসেবে কর্মরত আছেন।
মুক্তিযোদ্ধা পিতার আদর্শ সন্তান হিসেবে বন্ধুবান্ধবের গন্ডি পেরিয়ে পরিচিত মহলেও তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। বই-পুস্তকে সাদা পৃষ্ঠার কালো অক্ষরে আমরা যেসকল ‘ভালছেলে’দের গল্প পড়ি জাকিরুল ইসলাম খান যেন তাদেরই কোনো একজনের বাস্তবরূপ। তিনি অন্যদের মতো ছোটোবেলা থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস ক্যাডার হতে চাননি। তিনি হতে চেয়েছিলেন পরোপকারী। অঢেল অর্থ-বিত্ত বা প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক হতে না চেয়ে তিনি হতে চেয়েছেন একান্তই একজন পরোপকারী মানুষ। ফলে, সরকারি চাকরি করার চেয়ে ব্যবসা করাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সরকারি চাকরি করে অন্য উপায়ে টাকা উপার্জন করে দানশীল হওয়াটা তার নীতিবিরুদ্ধ বিষয়। তিনি চেয়েছেন ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে সেখানে থেকে একটা অংশ জনকল্যাণে ব্যয় করতে।
জাকিরুল ইসলাম খান পরোপকারে যতটুকুই ব্যয় করেন তা সাধারণত নিরবে নিভৃতেই করেন। ঢাকঢোল পিটিয়ে উপকার করার বিষয়ে তিনি বিশ্বাসী নন। ‘রেইজ ইওর ভয়েস’ নামে একটা গ্রুপ করে বন্ধুদের সাথে নিয়ে সাধ্যমতো দান করে আসছেন অসহায়দের মাঝে। তবে তিনি কিংবা তার বন্ধুরা কেউই এসব কার্যক্রম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচার করতে পছন্দ করেন না। সেই বাল্যকালে বাবার নতুন লুঙ্গি একজন অসহায়কে দান করার মাধ্যমে জাকিরুলের যে দানশীল কার্যক্রমের শুরু তা আজও চলমান।
স্বল্পভাষী ও ধীরস্থির বুদ্ধিসম্পন্ন জাকিরুল ইসলাম খান ব্যবসায়ী হওয়ার তীব্র বাসনা থেকেই এসএসসি ও এইচএসসিতে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে পড়াশোনা করেন। মতিঝিল মডেল হাই স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে থেকে অর্থনীতি ও হিসাব রক্ষণে স্নাতক শেষ করে এমবিএ ভর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে।
নতুন চালু হওয়া এই বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র জাকিরুল। তিনি স্বভাবে একজন মৌলিক পর্যটক। পর্যটক হিসেবে ইতোমধ্যেই তিনি বন্ধু ও নিকট আত্মীয় মহলে যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করে যা রোজগার করেন তার পুরোটাই তিনি ভ্রমণের পিছনেই ব্যয় করেন। ভ্রমণে যাওয়ার জন্য তিনি সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন না বরং সুযোগ তৈরি করে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটা পর্যটন গন্তব্যে তিনি একাধিকবার ভ্রমণ করেছেন। এখন পর্যন্ত কক্সবাজারই গেছেন ১৮ বার! বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনেও গিয়েছেন বহুবার। তবে প্রথম যেবার তিনি সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যান তখনো সেখানে কোনো ক্রুজ শিপ চালুই হয়নি। সেই যুগে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়া আসার একমাত্র মাধ্যম ছিল ট্রলার। এছাড়া দেশের বাইরেও এখন পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড, মালেয়শিয়া, শ্রীলঙ্কা ও চায়না। নিতান্তই ভ্রমণ পাগল মানুষ বলেই হয়তো তিনি দেশিয় গন্তব্যগুলোর মতোই বেশ ক’টি দেশেও একাধিকবার ভ্রমণ করেছেন।
এতবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন অথচ একবারের জন্যেও বাংলাদেশের বাইরে কোনো দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চাননি। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তার মধ্যে দেশপ্রেমটাও কিছু বেশিই বলা যায়। এমবিএ পাশ করে তিনি চাইলে অনায়াসেই দেশের বাইরে বিলাসী জীবন গড়তে পারতেন, কিন্তু তিনি চেয়েছেন বাংলার মাটিতেই সুখে দুঃখে জীবন গড়তে। ব্যবসায় নীতি নৈতিকতা বজায় রেখে পরিমিত মুনাফা অর্জন করে তিনি থাকতে চেয়েছেন ন্যায়নিষ্ঠ। মুক্তিযোদ্ধা বাবা তাকে মধ্যবিত্তের জীবনযাপন শিখিয়েছেন। তিনিও রপ্ত করেছেন কিভাবে বিলাস-বিহীন জীবন গড়তে হয়।
ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট থেকে পড়ালেখা করার পর কোনো এয়ারলাইন্স বা ফাইভ স্টার হোটেলে চাকরি নিতে পারতেন। কিন্তু সে পথে তিনি পা বাড়াননি। কারণ তার মনের মধ্যে সুপ্ত বাসনা তিনি সম্পূর্ণ অফ-ট্র্যাকের কোনো একটা ব্যবসা করবেন। রাজধানীজুড়ে বিদেশি ফার্নিচারের বড় বড় শো রুম। চাকচিক্য ও বিলাসবহুল এসব ফার্নিচার ইমপোর্ট করা হয় বেশিভাগই চায়না থেকে অল্পকিছু থাইল্যান্ড আর মালেয়শিয়া থেকে।জাকিরুল ভাবলেন, এসব ব্যয়বহুল ফার্নিচার যদি দেশেই তৈরি করা যেতো তাহলে আমদানি নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি দামটাও সাশ্রয়ী করা যেতো।
আধুনিক ডিজাইনের এরকম ফার্নিচার দেশেই উৎপাদন করার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য তিনি কিছু ফার্নিচার তৈরির কারখানা পরিদর্শন করলেন। কারিগরদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি পেলে তারাও এরকম আধুনিক ও আকর্ষণীয় ফার্নিচার তৈরি করতে পারবেন। এমনকি তারা এখন যেসব ফার্নিচার হাতে তৈরি করছেন সেগুলো তৈরিতে যদি মেশিনারিজ ব্যবহার করা যায় তাহলে তাদের উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। যথাসম্ভব অনলাইন ঘাটাঘাটি করে ফার্নিচার তৈরির যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও ইন্ডেনটিং ফার্মের সাথে কথা বলে বুঝলেন, এগুলো আমদানি করতে বড় বিনিয়োগের দরকার হবে। যেহেতু বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি তাই ঝুঁকির মাত্রাও অনেক বেশি। ব্যবসায় ঝুঁকি আছে তা তিনি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই জেনেছেন। ঝুঁকি নিতেও তিনি মানষিকভাবে প্রস্তুত কিন্তু কতোখানি ঝুঁকি তিনি কোন স্তরে নিবেন সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ফার্নিচার ও দাম সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন ফার্নিচার মার্কেট চষে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ একদিন তার মনে পরলো কোথায় যেন পড়েছিলেন, Sweat saves blood, blood saves lives, but brains saves both. সেদিনের মতো মার্কেট ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে তিনি বাসায় চলে গেলেন।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে তার মনে হলো চাকরি বা ব্যবসার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এতো বড় ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ব্যবসা করার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে চাকরি খুব ভালো একটা উপায়। ফলে তিনি চাকরি নিলেন এভারগ্রীন গ্রুপে হিসাবরক্ষক পদে। ব্যাকগ্রাউন্ড কমার্স থাকায় হিসাব রক্ষণের খুঁটিনাটি তিনি অল্পদিনের মধ্যেই রপ্ত করতে সক্ষম হলেন। তারপর কিছুদিন তিনি পাওয়ারট্র্যাক গ্রুপ ও রূপায়ণ গ্রুপে বিপনন বিভাগে কাজ করেছেন। বিপনন বিভাগে কাজ করতে তাকে ডেস্ক থেকে বাইরে এসে কাজ করতে হয়েছে। মূলত বাইরে ঘুরে কাজ করাটা কঠিন হলেও জাকিরুল ইসলামের জন্য সেটা ছিল সাপেবর। হিসাবরক্ষণ বিভাগে কাজ করে তিনি হিসেবের আদ্যোপান্ত শিখেছেন কিন্তু ব্যবসা শুরু করার আত্মবিশ্বাস পুরোটাই অর্জন করেছেন বিপনন বিভাগে কাজ করে।
অর্জিত আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ২০১৪ সালে ট্রেড লাইসেন্স করেন। আমদানিকারক হিসেবে ব্যবসা শুরুর অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজকর্ম সম্পন্ন করে তিনি চায়না থেকে প্রথম চালান আমদানি করেন ২০১৬ সালে। শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি অগনিত কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছেন। এছাড়াও তার মালিকানাধীন আরেকটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘নিউ নিপু ইন্টারন্যাশনাল’ শুরু থেকেই ফার্নিচার ডিজাইন করার নিত্যনতুন সরঞ্জামাদি (টুলস)সরবরাহ করছে। বর্তমানে জাকিরুল ইসলাম খানের প্রতিষ্ঠান ইন্টেরিওর ডিজাইন থেকে শুরু করে চাহিদানুযায়ী কেতাদুরস্ত আসবাবপত্রও তৈরি করে দিচ্ছে। এভাবে একাধারে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ এবং আসবাবপত্র তৈরি করে তিনি দেশীয় ফার্নিচার ও মেটাল শিল্পকে করে তুলছেন সহজ, সাশ্রয়ী ও আধুনিক। তিনি দেশে উৎপাদিত ফার্নিচারসমূহকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনার পরিবেশ তৈরি করতে চান। জাকিরুল ইসলাম খানের হাত ধরে দেশিয় ফার্নিচার ও মেটাল শিল্প উন্নত হয়ে আমদানি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠুক পর্যটনিয়া পরিবার কায়মনোবাক্যে সেই কামনা করে।