জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে নাজমুন
Tweet
পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা।
আমাদের এই পর্বের আয়োজন নাজমুন নাহার কে নিয়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে তিনি বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডে এইচআর এন্ড এডমিন অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।
বিশ্বব্যাপী দ্রুত বিকাশমান পর্যটন শিল্পের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বাংলাদেশের দরকার পর্যটনজ্ঞান সমৃদ্ধ দক্ষ জনশক্তি। সেই দক্ষ জনশক্তি তৈরির নিমিত্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে ২০০৭ সালে ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ চালু হয়। সন্ধ্যার পর বাণিজ্য অনুষদের নতুন এই বিভাগ আলোকিত করে রাখতো সেই সময়ের সবচেয়ে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার কিছু ছাত্র-ছাত্রী। নাজমুন নাহার সেইসব প্রগতিশীলদের অন্যতম। যার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোনো ট্যুর অপারেটর অথবা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করার । আজকে এতোদিন পরে এসেও অনেক ছাত্র হয়তো ট্যুরিজম নিয়ে পড়তে দ্বিধাদ্বন্দে ভোগেন অথচ একযুগেরও বেশি সময় আগে নাজমুন নাহার কী নিঃশঙ্ক চিত্তেই না পড়েছিলেন পর্যটন বিষয়ে!
নাজমুনকে ছোটবেলা থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো সাহসী করে তুলেছিলেন মা-বাবা। বরাবরই মেধাবী নাজমুন বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে ডাক্তার হোক, আর মেয়ে মনে মনে চেয়েছিলেন তিনি পড়বেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেডিকেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দু’রকম প্রস্তুতির নৌকায় একসাথে পা রেখে শেষমেশ কোনটাতেই ভর্তি হতে পারলেন না। অথচ ২০০২ সালে রাজশাহী বিভাগ থেকে যে ১৮ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী এইচএসসি পাশ করেছেন নাজমুন তাদেরই একজন। বেশ ভাল নাম্বারসহ তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তে না পারলেও তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে বিবিএ পড়ে এসে ঠিকই এমবিএ ভর্তি হন সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই।
পড়ালেখা শেষ করেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোনো একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিয়ে বিশ্ব ঘুরে বেড়াবেন অথবা দেশের মধ্যেই কোনো ফাইভ স্টার হোটেলে চাকরি নিয়ে শুরু করবেন তার স্বপ্নের ক্যারিয়ার। কতো স্বপ্নের জাল বুনছেন তিনি মনে মনে। নাজমুন নাহার জানেন আধুনিক সময়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ অতোটা সহজ নয়। এখানে পদে পদে নানা বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। সমাজের বিভিন্ন কোন থেকে প্রশ্ন ওঠছে, মেয়ে মানুষ পড়ালেখা করে হোটেলে চাকরি করবে কেন! এসব প্রশ্ন তিনি খুব একটা পাত্তা দেন না কারণ তার প্রতি পরিবারের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তিনি বরং নিরবে দিনক্ষণ গননা করছেন, আর মাত্র অল্পকিছু দিন, এরপরেই স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবেন উপরে। এই সোনালী সময়ে আশপাশ থেকে উড়ে আসা এসব উটকো প্রশ্নে তিনি বিচলিত হবেন কেন!
এমবিএ শেষ হওয়ার আগেই দেশের অন্যতম সেরা ফাইভ স্টার হোটেল, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল এন্ড রিসোর্ট থেকে জব অফার পাওয়াটা তার জন্য ছিল একাদশে বৃহস্পতি। যদিও এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এমবিএ শেষ না হতেই চাকরি পাওয়ায় বন্ধুবান্ধবদের হয়ে উঠেছিলেন মধ্যমণি, শিক্ষকদেরও ব্যাপক প্রসংশা কুড়িয়েছিলেন নাজমুন। কিন্তু সবাই তো আর শিক্ষক নয় কিংবা তার মতো প্রগতিশীলও নয়। পরিচিত মহল থেকে তার ও পরিবারের প্রতি ধেয়ে আসছে প্রশ্ন, মেয়ে হোটেলে চাকরি করে কেন! হোটেলে কি ভালো মেয়েরা চাকরি করে! এই মেয়েকে বিয়ে দিবেন কেমনে, ইত্যাদি হাজার রকমের প্রশ্ন। যে বাবা তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছেন সেই বাবার চোখের ভাষাটাও যেন ধীরে ধীরে কোমল হয়ে আসছে। বাবা মুখে কিছু বলেন না তবুও নাজমুন অনুভব করতে পারছেন বাবা যেন বলতে চাইছেন, যেহেতু তোমার যোগ্যতা আছে তুমি না হয় অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখ মা।
পিছিয়ে পড়া সমাজে প্রগতিশীল হয়ে এগিয়ে যাওয়ার কষ্টটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন নাজমুন নাহার। এমনকি সেই দুঃসময়ে তিনি সহ্য করেছেন সহকর্মীদেরও (টিমমেট) অসহযোগিতা। সমস্ত প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো অসীম সাহসের অধিকারিণী নাজমুন নাহার, তিনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তিনি চান না কোনো আধা প্রগতিশীলদের প্রশ্নের মুখোমুখি হোক তার মা-বাবা। এতো স্বপ্নের একটা চাকরি তিনি ছেড়ে দিবেন একথা চিন্তা করতেই ভিতর থেকে ছোট্ট একটা কাঁপুনি অনুভব করলেন। তবু্ও তিনি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, চাকরিটা ছেড়েই দিবেন। তবে চলে যাওয়ার আগে নিজেকে প্রমাণ করে যাবেন। সাত মাস পরে তিনি যখন পদত্যাগপত্র জমা দেন তখন তার পারফর্মেন্স লেভেল অনেক উপরে। ফলে কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করেছিলো টিমমেটদের অসহযোগিতার কারণে চাকরি ছাড়তে চাইলে তিনি যেন তাদের পাবলিক রিলেশন অফিসার এর নতুন পদে অথবা সেলস ডিপার্টমেন্টে যোগদান করেন। কিন্তু এতোদিনে সুখস্বপ্নে বিভোর নাজমুন নাহার আজ ফাইভ স্টার হোটেলে চাকরি করার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে জয় করে হয়ে উঠেছেন জিতেন্দ্রিয়।
বাসায় এসে নতুন করে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছেন। তবে এবার নিজের পছন্দের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু ভেবে দরখাস্ত করছেন। এরমধ্যেই বার্জার পেইন্টস থেকে ডাক পেলেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে সেখানে যোগদান করলেন। এডমিন ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য নিয়মিত দ্বায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ট্রাভেল পার্টটাও দেখতেন। ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়ালেখা করায় তিনি অর্পিত দ্বায়িত্ব সাবলীলভাবেই পালন করছেন।
ট্যুর প্রোগ্রামগুলোতে অংশগ্রহণ করে আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি দ্বায়িত্বও পালন করছেন সফলতার সাথে। বহুজাতিক কোম্পানিতে দেশের ভিতরে ও বাইরে বছরের সব সময়ে ছোট এবং বড় পরিসরে করপোরেট ট্যুর প্রোগ্রাম থাকে। প্রোগ্রামগুলো নিয়মিতভাবে সমন্বয় এবং সফল আয়োজনে আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করেছেন ট্রাভেল ডেস্ক।
তিনি এখন কাজ করেন এইচআর ডিপার্টমেন্টের মূল অংশে। বর্তমান চাকরিতেই তিনি পেয়েছেন সুখের সন্ধান।
একদা ফাইভ স্টার হোটেলে চাকরি করতে চাওয়া, চাকরি পাওয়া তার স্থায়ী সুখ না হলেও একটুকরো সুখের স্মৃতি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আপোষ করে বিসর্জন দিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন। এরকম নাজমুনদের বিসর্জনের উপর ভিত্তি করেই আজ অল্প পরিসরে হলেও মেয়েরা ফাইভ স্টার হোটেলগুলোতে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ছেন। তিনি এখনো স্বপ্ন দেখেন সময় একদিন বদল হবেই। দেশের মেয়েরা অন্যান্য খাতের মতো পর্যটন খাতেও নিজেদেরকে প্রমাণ করার সুযোগ পাবে। নাজমুন নাহারদের অংশগ্রহণে দেশের পর্যটন আকাশে যে ঊষার আলো ফুটে উঠেছে তা আরও আলো ঝলমলে হয়ে দিনের আলোর মতো করে আলোকিত করুক সারাদেশকে পর্যটনিয়া পরিবার সেই কামনা করে।