জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে শাহেদ কবীর
Tweet
পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন জনাব শাহেদ কবীরকে নিয়ে। তিনি বর্তমানে পারটেক্স স্টার গ্রুপে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিভাগে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে কর্মরত আছেন।
শিক্ষক বাবা ও গৃহিণী মায়ের তিন ছেলে তিন মেয়ের মধ্য তিনিই সর্বকনিষ্ঠ। পরিবারের সবার ছোট হওয়ায় অন্যান্য ভাইবোনের তুলনায় তিনি একটু বেশিই আদর যত্নে বড় হয়েছেন। বাবা মায়ের সাথে ভাই বোনদেরও আদর-যত্ন, স্নেহ-ভালোবাসার মধ্য দিয়ে কেটে গেছে দুরন্ত শৈশব আর কৈশোর। রাজবাড়ী সরকারি কলেজে অধ্যয়নকালে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন চাঁদ সওদাগরের ঢিবি থেকে শুরু করে নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির, শাহ পাহলোয়ানের মাজারসহ আরও কতো জায়গা। বাবা চেয়েছিলেন ছোটছেলে ডাক্তার হোক কিন্তু শাহেদ হতে চেয়েছিলেন ব্যাংকার। ব্যাংকের চাকরিতে যথেষ্ট সম্মানের পাশাপাশি বেতন কাঠামোও বেশ ভালো। ডাক্তারি পেশায় মানবসেবা করার সুযোগ ছাড়াও ব্যাংকের তুলনায় রোজগার অনেক বেশি। তবুও শাহেদ ডাক্তার না হয়ে ব্যাংকারই হতে চেয়েছিলেন। উচ্চাভিলাষী জীবনের মোহে আবিষ্ট না হয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন নিজের পছন্দ ও স্বাধীনতার প্রতি। ডাক্তারের পেশায় অনেক সময় রোগীর জীবন নিয়ে জটিল ও সংবেদনশীল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। পেশাগত জীবনে তিনি এরকম স্পর্শকাতর বিষয় এড়িয়ে চলতে চান বলেই ব্যাংকে চাকরির প্রতি তার ঝোঁক বেশি।
দুরন্ত শাহেদ একদিন বন্ধুবান্ধবের দলবল নিয়ে ঘুরতে গিয়েছেন ধুঞ্চি গোদার বাজার, পদ্মা নদীর পাড়। বছরের অন্যান্য দিনের মতোই সেদিনের সূর্যও ডুবে গেল পদ্মানদীর জলে। ব্যতিক্রম কিছুই ছিল না। তবুও সেদিনের সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখে কী কারণে যেন তার মনের মধ্যে একটা পরিরর্তন ঘটে গেল। সন্ধ্যার পর তারা শহরে ফিরছেন। বরাবরই উচ্ছল শাহেদ আজ যেন একটু চুপচাপ। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। দূর থেকে ভেসে আসা বাতাসে পাকা ধানের মাতাল ঘ্রাণ। শাহেদদের চুপচাপ পথচলায় নেমে আসে নিস্তব্ধতা। এই নিঝুম নিস্পন্দ সন্ধ্যায় মর্ত্যলোকের কোনো বন্ধুবান্ধব নয় বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগৎ থেকে এক দমকা মাতাল হাওয়া কানে কানে বলে গেল শাহেদ, তুমি পর্যটনের পথে পা বাড়াও। ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন তাড়িত ক্লান্ত প্রাণ শাহেদ যেন অতিদূর সমুদ্রের ‘পর হাল ভেঙে হারায়েছে দিশা।
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্যটনে ক্যারিয়ার গড়ার নতুন স্বপ্নের হাল এখান থেকেই টানা শুরু শাহেদের। ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী হওয়ায় পর্যটনের অনেকগুলো কোর্সের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ায়ে নিতে সুবিধা হলো। স্বপ্নের পথে হাঁটতে এর চেয়ে সুন্দর সূচনা আর কী হতে পারে! বিভাগের চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় একটা পর্যটন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার পর তার বোধ হলো পর্যটনের পথই হতে পারে পয়মন্ত।
যেহেতু পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই তিনি হঠাৎ নেমে পড়েছেন পর্যটনের পথে তাই অল্পতম সময়ের মধ্যেই পর্যটন সম্পর্কে বিস্তর ধারণা অর্জনের জন্য নিয়মিত ক্লাসের বাইরেও পর্যটন সংশ্লিষ্ট কোনো সভা-সেমিনারের খোঁজ পেলেই তিনি সেগুলোতে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করতেন। প্রতিবছর অন্তত তিন-চারটা আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলা হয় ঢাকা শহরে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর ও ট্রাভেল এজেন্সি সেই মেলাগুলোতে অংশগ্রহণ করে। তিনি নিয়মিত এসব বিদেশি স্টলগুলো পরিদর্শন করতেন। বিদেশি ট্যুর অপারেটরদের সাথে তাদের ভ্রমণ প্যাকেজ ছাড়াও আরও বহু বিষয়ে আলাপ করতেন। তাঁদের সার্ভিস ডিজাইন নিয়ে কথা বলতেন। এভাবে বহুমাত্রিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে তিনি বুঝতে পেরেছেন পর্যটন একটা সংবেদনশীল শিল্প। এই শিল্পে ক্যারিয়ার গড়তে হলে শুধু পর্যটন জ্ঞান থাকলেই হবে না দক্ষতাও জরুরি। Knowledge is not enough. Skill is more important than knowledge to do better in tourism industry.
শুরু হলো দক্ষতা অর্জনের জন্য দুর্বার পথচলা সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে। সাধারণ আড্ডা কমিয়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ক্লাস, পড়ালেখা, পরীক্ষা, পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেমিনার ও এক্সপোজিশনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে। জ্ঞানের সাথে দক্ষতার সমন্বয় ঘটানোর জন্য ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনে জড়াতে লাগলেন নিজেকে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোর্স করতে গিয়ে ক্লাসের ছাত্রদেরকে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করতে হয়েছে। তিনি নিজ গ্রুপের ইভেন্টের বাইরেও অন্য গ্রুপের কাজ করেছেন শুধুমাত্র নিজেকে অধিক দক্ষ করে গড়ে তুলবার জন্য।
দিন যায় শাহেদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও স্বপ্ন গাঢ় হতে গাঢ়তর হয়। শাহেদ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে নিঃশঙ্ক যে, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার প্রসিদ্ধ কোনো ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে ট্রাভেল কনসালটেন্ট হিসেবে চাকরি নিবেন। বিভিন্ন দেশের ট্যুর প্যাকেজ আইটিনিরারি তৈরি করে দিবেন। ফাঁকে ফাঁকে তিনি নিজেও ঘুরে বেড়াবেন পৃথিবী। রোমান কলোসিয়াম, ক্যানেল গ্রান্ড, ল্যুভর মিউজিয়াম ইত্যাদি না দেখে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া অর্থহীন। শাহেদের আশা নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়ে একবার যেতেই হবে। মৃত্যুর পূর্বে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান ভ্রমণেও যেতে হবে একবার। এতো এতো দেশ ঘোরাঘুরি করার স্বপ্ন যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতার কয়েকটা চরণ হঠাৎ মনে পড়ে যায়, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া // ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া // একটি ধানের শীষের উপরে// একটি শিশিরবিন্দু। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই তিনি ব্যাগ গুছিয়ে চলে যান কুয়াকাটা।
যদিও দেশের অনেকগুলো পর্যটন গন্তব্য তিনি ইতোমধ্যেই ভ্রমণ করেছেন তবুও তিনি আরও ভ্রমণ করতে থাকেন। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে কাজ করার আগে নিজেকে তো অবশ্যই একজন আপাদমস্তক পর্যটক হতে হবে। রাজবাড়ী থেকে ঢাকায় এসে এমনিতেই প্রতি মাসে অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। তার উপর ইদানিং আবার যোগ হয়েছে ভ্রমণ খরচ। প্রতিমাসে এতোগুলো করে টাকা বাবার কাছে নিতে মনে সায় দেয় না। ভ্রমণ খরচের যোগান পেতে তিনি ফ্লেমিংগো এগ্রো টেক লিমিটেডে কমার্শিয়াল অফিসার পদে কাজ নেন। তারপর আরও ভ্রমণ, আরও টাকা এরকম প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে পুরাতন চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি কিছুদিন রাজ কামাল এভারবেস্ট করপোরেশন লিমিটেড তারপর ইউনিভেট লিমিটেডেও কাজ করেন। এভাবে এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে যান, বেতন বাড়তে থাকে আর তিনি ভ্রমণের পিছনে খরচ করতে থাকেন।
এমবিএ শেষ এখন বিদেশি প্রতিষ্ঠানে দরখাস্ত করার পালা। বাংলাদেশের বর্তমান চাকরির পাশাপাশি বিদেশি বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে সিভি জমা দিচ্ছেন কিন্তু ডাক পাচ্ছেন না। কারণ পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখা থাকলেও তার কাজের অভিজ্ঞতা সার্টিফিকেট তো পর্যটনের বাইরে। যদিও তিনি পর্যটনের জন্যই নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বহু সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে উপস্থিত থেকেছেন, ছোটখাটো বেশ কয়েকটি ইভেন্ট আয়োজন করেছেন নিজহাতে, বহু ভ্রমণ করেছেন কিন্তু এসব তো এখন মূল্যহীন। এতোদিন চাকরি করার ফলে বেতন স্কেলও বেড়ে গেছে বেশ কিছুটা। এখন সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নতুন করে কোনো দেশীয় ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলে কেউ এই পরিমাণ বেতন দিবে না। বেতনের মায়ায় চাকরিও ছাড়তে পারছেন না আবার অভিজ্ঞতার অভাবে বিদেশি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানেও চাকরি নিতে পারছেন না। এরকম এক অকল্পনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি শাহেদ কবীর।
দীর্ঘ চিন্তাভাবনা করে তিনি বর্তমান চাকরিটা না ছাড়ারই সিদ্ধান্ত নিলেন। পরিবারের সবার ছোটো হওয়ায় জীবনে কখনো পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। কিন্তু এখন সময় ভিন্ন। পড়ালেখা, ঘোরাঘুরি চাকরি ইত্যাদি কাজে অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে তিনি ইতোমধ্যে বিবাহিত। এখন চাইলেই আর অবিবাহিত জীবনের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তবে কি এতোদিনের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা বিফলে যাবে! পর্যটনে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা ব্যার্থ হয়ে যাবে একেবারে? না। তিনি বরং নিজেকে আরও দক্ষ, অভিজ্ঞ ও যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টায় রত আছেন। একদিন তিনি দেশের মধ্যেই কোথাও ইকো রিসোর্ট গড়ে তুলবেন বা ক্রুজ শিপ নির্মাণ করবেন বলে পরিকল্পনায় রেখেছেন। তিনি শুধু সময়, সুযোগ ও আরেকটু আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের অপেক্ষায় আছেন। এই সক্ষমতাটুকু আর্জিত হলেই তিনি নেমে পড়বেন পর্যটনের পথে দু-দণ্ড শান্তির অন্বেষণে। জনাব শাহেদ কবীরের এবারের পরিকল্পনা কোনো রকম বাধাবিঘ্ন ছাড়া শীঘ্রই বাস্তবায়িত হোক তা পর্যটনিয়া পরিবারের একান্ত কামনা।