জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে মাহমুদ
Tweet
পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন জনাব মো. মাহমুদ হাসানকে নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়াশোনা করে তিনি বর্তমানে দেশের অন্যতম সেরা পাঁচ তারকা হোটেল, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট’র ব্যবস্থাপক (সেলস) পদে কর্মরত আছেন।
১৯৮৪ সালের ২৩ আগস্ট চাঁদপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন মাহমুদ হাসান। মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় বড় বোনের মৃত্যুর পর তার জন্ম। ফলে মা-বাবার পাশাপাশি নিকট আত্মীয়দেরও অতিরিক্ত আদর-যত্ন ও স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। বাবা BIWTA এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও শিপিং পাইলট হিসেবে কর্মরত থাকায় তার শৈশবের কিছুকাল আর কৈশোরের পুরোটাই কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। জীবনের ঊষালগ্নেই সরলতা ও উদারতার শিক্ষাটুকু তিনি পেয়েছেন বাবার কাছে। মমতাময়ী মা তাকে শিখিয়েছেন জীবনে সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র ‘অল্পেই তুষ্ট’ হওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে এমবিএ ভর্তি হওয়ার আগে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি ও চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার তীব্র বাসনা নিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে অল্পকিছু নাম্বারের জন্য স্বপ্ন ভঙ্গ হয় তার। পরে চট্টগ্রামের নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইআইইউসি (IIUC) থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং নিয়ে বিবিএ পড়েন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যারিস্টার হওয়ার পারিবারিক প্রত্যাশার ভার বহন থেকে মুক্ত মাহমুদ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা হিসেবে। বরাবরই তিনি ছিলেন ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ছাত্র। বিবিএ শেষ পর্যায়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ইন্টার্নিশিপ প্রোগ্রাম করার সময় নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার পুরনো ইচ্ছা আর সৃজনশীল কাজের প্রবনতাই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ফের উদ্বুদ্ধ করে। শেষ সুযোগ হিসেবে এইবার আরও ভালো প্রস্তুতি নিয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি এমবিএ ভর্তি হতে সক্ষম হলেন অবশেষে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে সদ্য চালু হওয়া ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। নতুন এই বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র তিনি। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের হয়ে উঠতে হয় অনির্বাণ। অপর্যাপ্ত ক্লাস রুম এমনকি প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক শিক্ষক নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করে খুবই সীমিত সুযোগ সুবিধা নিয়ে পড়ালেখা শুরু করে তাদেরকে এগিয়ে যেতে হয়। নিজেদের ক্যারিয়ার নিজেদেরই চেষ্টায় গড়ে নিতে হয়। রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করার মতো কোনো বড় ভাইও থাকে না। সময়ের ব্যবধানে নিজেরাই বড়ভাই হিসেবে নবাগতদের প্রতিও দায়িত্ব পালন করতে হয়।
কোনো বিভাগের প্রথম ব্যাচ যে রাস্তা তৈরি করে দিয়ে যায় দ্বিতীয় ব্যাচ এসে সেই পথ অনুসরণ করে চলে। এভাবেই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চমের ক্রমধারায় একটা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মাহমুদদের সামনে অগনিত চ্যালেঞ্জ। সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজের সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বের গুনাবলী নিয়ে সামনের সারিতে এগিয়ে এলেন মাহমুদ। ক্লাস রুম থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা সবখানে তিনি প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করলেন। নিয়মিত ক্লাস করার পাশাপাশি পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আলোচনাসভা, সেমিনার বা এক্সপোজিশনেও অংশগ্রহণ করে জানার চেষ্টা করছেন শিল্পের আদ্যোপান্ত। ক্লাসে শিক্ষকগণ উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন ‘তোমাদের হাত ধরে দেশে পর্যটন বিপ্লব ঘটবে’।
ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং নিয়ে বিবিএ পড়া মাহমুদ ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হয়ে ক্রমে ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগলেন ব্যাক্তিগত স্বপ্ন থেকে। তিনি হতে চেয়েছিলেন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তাকে হতে হচ্ছে দেশের সম্ভাব্য পর্যটন বিপ্লবের অগ্রগামী সৈনিক। দ্রুত বিকাশমান পর্যটন শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে দরকার পর্যটনজ্ঞান সমৃদ্ধ জনবল। মাহমুদ ও তার সহপাঠীরা হয়ে উঠবেন পর্যটনের সেই ঈপ্সিত দক্ষ জনশক্তি। পড়ালেখা শেষ করে তিনি চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন কিন্তু তাতে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছলেও শিল্পের চাহিদা পূরণ হবে না। শিল্পের চাহিদার মুখোমুখি ব্যাক্তিগত স্বপ্ন পূরণের কিস্তি; স্বীয় স্বার্থ বিসর্জনেই একমাত্র সমাধান।
চূড়ান্ত লক্ষ্য স্থির। বন্ধুরপথ। লক্ষ্য বরাবর এগিয়ে যাওয়ার দুরন্ত লড়াই শুরু এখান থেকেই। এ তুফান ভারী দিতে হবে পাড়ি নিতে হবে তরী পার। মাহমুদ জানেন, তিনি সর্বেসর্বা নন তবে নিজের কাজে শতভাগ নিবেদিত। ফলে তিনি যা করেন তা সুন্দর করেই করেন। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার উপর ভ’র করে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব জেনে তিনি নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষার বাইরেও পর্যটনের ব্যবহারিক জ্ঞান অন্বেষণে ভ্রমণ করতে লাগলেন নিয়মিত। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা মাহমুদ বন্ধুদের সাথে এর আগে কতোবার ঘুরে বেড়িয়েছেন হজরত শাহ আমানত (রহঃ) এর মাজার, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, ফয়’স লেক, চিড়িয়াখানা, ডিসি হিল, জাম্বুরি পার্ক ও বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এমনকি দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত। এতোদিনের সবগুলো ভ্রমণ ছিল নিতান্তই আনন্দ ভ্রমণ। কিন্তু এখন তিনি ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের একজন গর্বিত ছাত্র। দেশের পর্যটন শিল্পেকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার গুরু দায়িত্ব তার কাঁধে। এখন তিনি এসব গন্তব্যে ভ্রমণ করে আনন্দ উপভোগ করার পাশাপাশি গন্তব্যগুলোর সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে গবেষণা করেন। দেশের পর্যটন গন্তব্যগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করতে সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করতেও চেষ্টা করেন তিনি।
কেউ বলেনি তবুও নিজ গরজেই পর্যটনের নানা উপখাত সম্পর্কে ধারণা পেতে পর্যটনের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সম্পর্ক গড়ে তোলেন জনাব মাহমুদ হাসান। এমবিএ পড়াকালীন সময়েই তিনি কিছুদিন কাজ করেন দেশের অন্যতম সেরা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি মার্কেট একসেস ও এশিয়াটিক ইভেন্টসের সাথে। ক্লাস, পড়াশোনা, পরীক্ষা, ঘোরাঘুরি, সেমিনার, পর্যটন মেলা এবং বেশকিছু ইভেন্ট আয়োজন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মাহমুদ যেন হয়ে উঠেছেন পর্যটনের বৈদান্তিক। এখন তার কথাবার্তা ও চিন্তা-চেতনায় অভিজ্ঞতা ও পারদর্শীতার ছাপ স্পষ্ট।
এমবিএ শেষের দিকে তিনি ইন্টার্নিশিপ করার দরখাস্ত নিয়ে যান ইন্ডিয়ার অন্যতম সেরা স্পাইসজেট এয়ারলাইন্সের ঢাকা অফিসে। মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে কর্তৃপক্ষ ইন্টার্নিশিপের বদলে একেবারেই চাকরির প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। মাহমুদের মঞ্জিলে মকসুদ পাঁচ তারকা হোটেল হলেও আপাতত তিনি এই কাজে রাজি হয়ে গেলেন। সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং ডিভিশনে কাজ করে তিনি নিজেকে প্রমাণ করার এরচেয়ে বড় সুযোগ আর হয় না। পরিশ্রম, সততা ও কাজের প্রতি একাগ্রতা দিয়ে তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন প্রতিষ্ঠানের সেলস ভলিউম বৃদ্ধি করার মাধ্যমে। ছাত্রজীবনেই শিল্প সংশ্লিষ্ট নানারকম পরিশ্রম আর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে মাহমুদ হয়ে উঠেছেন পর্যটনের একজন চৌকস সেনাপতি। স্পাইস জেট এয়ারলাইন্সে কিছুদিন কাজ করে যখন তার আত্মবিশ্বাস উত্তুঙ্গে তখনই তিনি যোগ দেন তার কাঙ্খিত ঠিকানা ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে।
সেলস এক্সিকিউটিভ পদে ঢুকে কেটে গেছে দশটি বছর। আজ তিনি ব্যবস্থাপক (সেলস) পদে কর্মরত। একজন ব্যবস্থাপক হিসেবে কয়েকটি দলের সম্মিলিত পরিচালনায় সেলস, মার্কেটিং, হোটেল লয়্যালটি প্রোগ্রাম, এবং ডিজিটাল মার্কেটিং এর কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করে চলেছেন। ব্যাক্তিগত অহংকার বোধ ও সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে তিনি কাজের সফলতা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন টিমমেটদের সাথে আর ব্যাক্তিগত স্বার্থের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েই আজকের অবস্থানে উঠে এসেছেন তিনি। টিম মেম্বাদের প্রতি যথাযথ উদারতা ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেকে ধরে রেখেছেন জনপ্রিয় করে। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পাঁচ তারকা হোটেলে ক্যারিয়ার শুরু করার পর থেকেই পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সভা সেমিনারে অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুপ্রাণিত করে আসছেন শতশত শিক্ষার্থীদেরকে। পরিশ্রমী, নিরহংকারী ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত মাহমুদ শিক্ষার্থীদের সামনে প্রতিনিয়তই বলে যাচ্ছেন তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সফলতা ও ব্যর্থতার গল্পগুলো। মাহমুদ হাসান কাজের বাইরে সময় কাটাতে পছন্দ করেন ব্যাক্তিগত কিছু ভালো লাগা যেমন- পারিবার, বন্ধুবান্ধব, সামাজিক ও পেশাগত নেটওয়ার্কিং ও ফটোগ্রাফি নিয়ে। এছাড়াও নতুন কিছু জানা ও মানষিক উৎকর্ষ সাধনে তিনি প্রবন্ধও পড়েন নিয়মিত।
ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। পিতা-মাতা ও ছোট ভাইসহ স্ত্রী, কন্যাকে নিয়ে যৌথ পরিবারে বাস করছেন। কর্মব্যস্ত জীবনে প্রতিদিনের পেশাগত সফলতা ও ব্যর্থতার জটিল সমীকরণের পর পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরে আসার উষ্ণতা অনুভব করেন তিনি। পারিবারিক নিঃস্বার্থ ভালবাসা মাহমুদ হাসানের প্রতিটি দিনকে আলোকিত করে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। মানবিকতার শিক্ষায় দীক্ষিত করা বাবা-মা তাকে দিয়েছেন সত্য ও সরল পথের অনুসন্ধান। সেই পথ অনুসরণ করেই তিনি নিজেকে পরিচয় করাতে চান একজন সৎ, পরিশ্রমী ও বিবেকবান মানুষ হিসেবে।