রেস্তোরাঁ-ক্যাফে খুললেও ভাল যাচ্ছে না ব্যবসা
Tweet
রাজধানীর বিভিন্ন হোটেলৈ মোটেল রেস্তোরা-ক্যাফে শপ খুলে দেওয়া হয়েছে অনেক দিন হচ্ছে। আবার কিছু কিছু খোলা অপেক্ষায়। যদিও এই মুহুর্তে এসব খোলা রাখার কথা ছিল না। দেশের যে পরিস্থিতি তাতে কোনভাবেই সব কিছু খুলে দেয়ার পক্ষে না সব শ্রেনির সাধারণ মানুষ।
পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে যারা ব্যবসা চালু করেছে তাদের মধ্যে গ্রাহকদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো ব্যবস্থাই নেই। অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁগুলো সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে।তকে ব্যবসা ভাল না থাকায় বন্ধ হবার শঙ্কায় পড়েছেন এসব মালিক।
ধানমণ্ডি এলাকার সাত মসজিদ রোডের একটি ক্যাফেতে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বন্ধ রয়েছে । ফ্লেভারস মিউজিক ক্যাফে নামের ওই রেস্তোরাঁ সাত বছর আগে শুরু করেন এস এম রাজন।
মহামারীকালে সম্প্রতি এটি পুনরায় চালু করার চিন্তা-ভাবনা করলেও এখনও দ্বিধাগ্রস্ত রাজন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে সঙ্কটের সময় পার করছেন এখন। দক্ষ কর্মী সঙ্কট, দোকানের ভাড়া, আশানুরূপ গ্রাহক পাবেন কি না, এসবই এখন তার চিন্তার বিষয়।
রাজন বলেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমরা পুনরায় চালু করার ভাবছি। ডাইন-ইন দিয়েই শুরু করতে চাই। সেটা করতে চাইলে বসার ক্যাপাসিটি কমে যাবে। অনলাইনেও চালু করব। সেখানেও প্রায় একই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
আসলে শুধু অনলাইন অর্ডার নিয়ে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে যাবে। এখন স্বাভাবিকভাবে কাস্টমারও কমে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা বাড়িওয়ালা তো ছাড় দিচ্ছে না।
কবে নাগাদ চালু করতে পারবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও ভাবছি। সবগুলো অবজেকটিভ কন্ডিশন মোটামুটি মিলে গেলে চালু করতে পারব।
সেক্ষেত্রে কাস্টমার পাওয়াটাও চ্যালেঞ্জ, এই দুঃশ্চিন্তাটুকুও মাথা থেকে নামছে না তার।
এদিকে, বিদেশিদের যাতায়াত বেশি থাকে গুলশানের বিস্ত্রো ই-তে। ২৫ জুন থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টেকঅ্যাওয়ে সেবা চালু করেছে তারা।
নতুন করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে চলা টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ওঠার পর গত ৩০ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস খোলার পাশাপাশি দোকানপাটও দিনের বেলা খুলতে দেওয়া হয়। ১ জুলাই থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখা যাচ্ছে।
গত শতকের ৯০ এর দশক থেকে রাজধানীর বনানী, ধানমণ্ডিসহ কয়েকটি এলাকায় জমজমাট হয়ে ওঠে ক্যাফে-রেস্তোরাঁর ব্যবসা। এসব খাবারের দোকান হয়ে ওঠে তরুণ-যুবাদের আড্ডাস্থলও।
২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার পর বেশ কিছুদিন ওই এলাকার রেস্তোরাঁগুলোর ব্যবসায় খরায় পড়ে। তবে তার প্রভাব অন্য এলাকায় পড়েনি।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিক্রির এই খাতে করোনাভাইরাস মহামারীর যে প্রভাব পড়েছে, তাতে অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে সমিতির তালিকাভুক্ত প্রায় ৮ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। সমিতির বাইরে রয়েছে আরও ছোট-খাটো অনেক খাবারের দোকান।
সমিতির হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে প্রায় ৯ লাখ শ্রমিক সরাসরি যুক্ত এই খাতের সঙ্গে। আর ঢাকা শহরে লাখের ওপর।
দীর্ঘদিন বন্ধ এবং ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে যেসব রেস্তোরাঁ খোলা আছে, সেগুলোতেও গ্রাহক কম।
রেস্তোরাঁ মালিক এবং ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, ‘লকডাউনে’ কর্মচারীদের ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় পুঁজি হারানো, বাড়িভাড়ার সমস্যা এবং সময়ের বাধ্যবাধকতার কারণে তারা সঙ্কটে পড়েছেন।
তারা বলছেন, সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সময় দিলে এই ব্যবসা চালানো তাদের জন্য কঠিন হবে। তাদের যুক্তি, খাবার একটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। সাধারণ দোকানের সঙ্গে এটিকে গুলিয়ে ফেললে হবে না।
অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছেন, ফেব্রুয়ারি-মার্চের তুলনায় তাদের অর্ডার বেড়েছে। অংশীদার রেস্তোঁরার সঙ্গে আলাপ করে খেলার ব্যবস্থাও করছেন তারা।
ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের প্রেজি কফি শপ কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ৩১ মে থেকে ব্যবসা পুনরায় চালু করে। শুরুতে শুধু পার্সেল সার্ভিস রাখলেও গত দুই সপ্তাহ ধরে ‘ডাইন-ইন’ চালু করেছে তারা।
তবে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে গ্রাহক বসানোর বাধ্যবাধকতার জন্য কমে গেছে আসন সংখ্যা। আগে যেখানে ৯৫ জন বসতে পারত, এখন সেখানে সর্বোচ্চ ৩৫ জন বসতে পারছে। ৫-৭ জন কর্মী মিলে রোস্টার করে দোকানটি চালাচ্ছেন। আগে কর্মী সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ।
প্রেজির সহকারী ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার শিহাব বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তাদের বিক্রি কমে গেছে ৬০ শতাংশ।
তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই বিক্রি কমেছে। আসন সংখ্যা ৩৫ এ নামিয়ে আনা হয়েছে। সেটাও পূরণ হচ্ছে না।
প্রেজি কফি শপেই বসে কথা হয় এর নিয়মিত গ্রাহক ফাহাদ বিন শাখাওয়াতের সঙ্গে।
তিনি বলেন, এই ক্যাফেতে মূলত সপ্তাহে এক-দুইবার আসাই হত। দীর্ঘদিন পর আবার এলাম। ছুটির দিনে বন্ধুদের নিয়ে কিছু সময় কাটানোর যে জায়গা সেটা এই মহামারীর কারণে পাল্টে গেল। এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে বলেই দুই দিন হল আসছি।
রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে দুটো শাখা রয়েছে ‘টাইম আউটের’। প্রায় ২০ বছর ধরে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ব্যবসা করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। মহামারীতে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কত দিন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবেন, তা নিয়ে এখন সন্দিহান প্রতিষ্ঠানটির মালিক সংগীতা আহমেদ।
এই রেস্তোরাঁটিরও ৬০ শতাংশ আসন কমিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রথমে হোম ডেলিভারি ও পার্সেল সার্ভিস চালু করলেও গত ২ জুলাই থেকে ডাইন-ইন চালু হয়েছে।
সংগীতা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের বসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে ৬০ ভাগ জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে। আগে যদি ১০০ জন বসতে পারতেন এখন পারবেন ৪০ জন।
এমন অবস্থায় আসলে কিছু করার নেই। এরকম পরিস্থিতিতে কতদিন চালাতে পারব, জানি না।
রেস্তোরাঁ কারি একসেন্টের পরিচালক (অপারেশন) অভিষেক সিনহা বলেন, পয়লা রমজান থেকে আমরা হোম ডেলিভারি চালু করেছি। ৮০ জন কর্মী ছিল, এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ এ। ঢাকা থেকে অনেকে চলে গিয়েছিল। যারা ঢাকায় ছিল তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ব্যবসা চালু রেখেছি।
রেস্তোরাঁ খোলার সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়ে অভিষেক বলেন, অন্তত রাত ১০টা পর্যন্ত চালু রাখতে না পারলে টিকে থাকা মুশকিল। শুধু হোম ডেলিভারি দিয়ে টিকে থাকা যাবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রেস্তোরাঁ ব্যবসার বিভিন্ন সঙ্কটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যারা অনেক বেশি বিনিয়োগ করে ব্যবসা করছে, তাদের অবস্থাও সুবিধার নয়। যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, তাদের যে কী অবস্থা!
গুলশানের অভিজাত রেস্তোরাঁ বিস্ত্রো ই’র ব্যবস্থাপক শামীম শরীফ বলেন, ডাইন-ইন কবে চালু করা হবে, সেটা এখনও কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিদের আনাগোণা বেশি থাকা এই রেস্তোরাঁটি ২৫ জুন থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টেকঅ্যাওয়ে সেবা চালু করেছে।
মোহাম্মদপুরের ফাস্ট ফুড শপ ঢাকা ফ্রায়েড চিকেনের এক কর্মচারী তার প্রতিষ্ঠান চালু থাকার পরও চাকরি নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে রংপুর থেকে ঢাকায় কাজ করতে আসা ওই কর্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দোকান চালু আছে, বেতনও পাচ্ছি।
কিন্তু যেভাবে কাস্টমার কমেছে, তাতে মালিক ক‘দিন দোকান চালু রাখবে, বুঝতে পারছি না। আর দোকান বন্ধ থাকলে তো বসিয়ে বসিয়ে কেউ বেতন দেবে না।