সচল থাকলেও জাহাজের জীবন আগের মতো ছন্দ নেই
Tweet
করোনাভাইরাস মহামারীতে আকাশ পথে যোগাযোগ সীমিত হয়ে আন্তর্জাতিক চলাচল কমে গেলেও সেই তুলনায় সচল রয়েছে সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচল; তবে আগের সেই ছন্দ হারিয়েছে জাহাজের জীবন। জাহাজে করে বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহন ঠিক রাখছেন যে নাবিকরা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের বন্দরগুলোতে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। জাহাজে বসেই এক গন্তব্য শেষে আরেক গন্তব্যের পথ ধরছেন তারা।
এদিকে দীর্ঘ দিন জাহাজে থাকায় কাজের চুক্তি ও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে কাউকে কাউকে দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে। বিশ্বের আরেক প্রান্তে গিয়ে চুক্তি বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বিমান ধরে দেশের পথে রওয়ানা হওয়ার সুযোগ এখন তারা পাচ্ছেন না।
উপায় না থাকায় ওই জাহাজে করেই দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে, যেখানে দুই দিনে ঘরে ফিরতে পারতেন সেখানে সাগর পথে মাসের বেশি সময় লাগছে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অফিসার, নাবিক ও স্টাফ মিলিয়ে মোট পাঁচ হাজার কর্মী বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জাহাজে কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে দুই হাজারের বেশি কর্মীর বিভিন্ন জাহাজে কাজের চুক্তিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন মহামারীর কারণে সব কিছু আটকে আছে।
করোনাভাইরাসের ছয় মাসসহ গত নয় মাসে জাহাজে কাটিয়ে এসেছেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মারুফুর রহমান। যমুনা গ্রুপের ‘ওসান প্রাইড’ জাহাজের অফিসার মারুফুর মেরিন একাডেমির ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী। জাহাজের জীবনে করোনাভাইরাস কী প্রভাব ফেলেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এই যুবক।
তিনি বলেন, ‘পণ্যবাহী এই জাহাজে নয় মাসের চুক্তিতে উঠেছিলাম, কিন্তু চীনে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর আমাদের ওখানে (চট্টগ্রাম) আতঙ্ক শুরু হয়।
জাহাজগুলোর চলাচলও কিছুটা স্লো মনে হচ্ছিল। ভাড়া না পাওয়ায় চট্টগ্রামে কয়েক দিন বসে ছিলাম। সে সময় অন্যান্য জাহাজের যাতায়াত, চলাচলও কম দেখছিলাম।
‘খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম ভবিষ্যৎ নিয়ে। যদি করোনাভাইরাসের কারণে সড়ক ও বিমান চলাচলের মতো জাহাজ চলাচলও বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কীভাবে চলব? বৃদ্ধ মা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছিলাম। ঠিক তখনই দেখলাম আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন বলল, ইন্দোনেশিয়ায় যাব ভাড়া পেয়েছি।‘তারপর আর থেমে নেই আমাদের জাহাজ। একে একে দুইবার ইন্দোনেশিয়া, একবার ভিয়েতনাম ও একবার মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর হয়ে এই চার মাসে কয়েকটি ভাড়া টেনে দেশে ফিরলাম।’ মারুফুর জানান, তাদের জাহাজের মতো পণ্য ও তেলবাহী প্রায় সব জাহাজই চলাচল করছে। তবে গাড়ি বহনকারী জাহাজগুলো করোনাভাইরাস সংকট শুরুর পর থেকে ভাড়া পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন শহরে নামা যাচ্ছে না। এতে জাহাজে থাকতে থাকতে মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে যেতে হয়।’ প্রায় চার শতাধিক ইঞ্জিনিয়ার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জাহাজে চাকরি করেন জানিয়ে মারুফুর বলেন, ‘অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, অনেকের চাকরির মেয়াদ শেষে হয়েছে কিন্তু দ্রুত আসতে পারছেন না বিমান চলাচল বন্ধ থাকার কারণে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কেউ বর্তমানে ব্রাজিলে রয়েছে। সেই দেশ থেকে জাহাজে আসতে অন্তত ৩৫ দিন লাগবে আর বিমান চলাচলও বন্ধ রয়েছে। এভাবেই অনেকের চুক্তির মেয়াদ ও পাসপোর্টের মেয়াদ জাহাজে থাকতেই শেষ হয়ে গেছে। ‘আবার যে দেশের বন্দরে জাহাজ ভিড়ে আছে, সেই দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে পারছেন না। কারণ করোনাভাইরাসের কারণে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক জাহাজে যারা চাকরি করেন তাদের অনেক দূর দূরান্তে যেতে হয়। তবে বাংলাদেশি জাহাজে যারা চাকরি করেন তারা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরে যাতায়াত করে। ‘সবাইর একই সমস্যা, করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন পোর্ট থেকে স্থলে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। এটাই কষ্ট।’
নাবিকদের এই সমস্যার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সুমন মাহমুদ সাব্বিরও। তিনি বলেন, ‘এই করোনাভাইরাসের সময় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, জাহাজগুলো থেকে কোনো অফিসার, নাবিক বা নৌকর্মী স্থলভাগে নামতে পারছেন না। আবার স্থলভাগ থেকে জাহাজে উঠতেও পারছেন না।’
এ কারণে নতুন কর্মী নেওয়া আটকে আছে জানিয়ে সুমন মাহমুদ বলেন, ‘সাধারণত আমরা ছয় থেকে নয় মাস চুক্তি করি অফিসার, নাবিক বা নৌকর্মীদের সঙ্গে। কিন্তু অনেকের সময় পার হয়ে এক থেকে দেড় বছর হতে চলেছে। আবার নতুন কর্মীদের নেওয়াও যাচ্ছে না।’
তবে কোথাও কোথাও এই বিধি-নিষেধ কিছুটা শিথিল রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সাদিয়া নামে একজন গৃহবধূ বলেন, তার স্বামী একটি আন্তর্জাতিক জাহাজে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন। তার স্বামী ও জাহাজের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মীদের অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডে নামতে দেওয়া হয়েছে। তার স্বামী ছয় মাসের চুক্তিতে ওই জাহাজে উঠেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অগাস্ট মাসে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে এবং আরেকটি জাহাজে উঠবেন। পাসপোর্ট ও ভিসা সব কিছু আপডেট করা রয়েছে। বর্তমানে কোনো সমস্যা নেই।’
নাবিকদের সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অনেকে এ রকম আটকা পড়তে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে গত ২৮ মে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে সমুদ্রগামী জাহাজের কর্মকর্তা, নাবিক ও নৌকর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাসপোর্ট প্রদান, নবায়ন এবং বিদেশি বন্দরে মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্টের বিপরীতে ইলেকট্রনিক ট্রাভেল পাস ইস্যুর অনুমতি দিতে অনুরোধ করা হয়। তিনি জানান, দেশে প্রায় ১৬ হাজার নিবন্ধনকৃত অফিসার ও নৌকর্মী আছেন। তবে বিভিন্ন জাহাজে কাজ করছেন পাঁচ থেকে ছয় হাজারের মতো।
এক প্রশ্নের জবাবে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কেউ জানায়নি যে, তিনি পাসপোর্ট বা ভিসা জটিলতায় আটকা রয়েছেন। শুধু একজন ফোনে জানিয়েছেন যে, তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে। ‘তিনি জাপান থেকে আসছেন এবং সিঙ্গাপুরে নেমে ভিসার কাজ করবেন। এর বাইরে করোনাভাইরাসের সময়ে আর কেউ কোনো কিছু লিখিত বা ফোনে জানায়নি।’
বিভিন্ন বিদেশি জাহাজে চুক্তির মেয়াদ পার হওয়াদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে একেকজনের একেকভাবে মেয়াদ শেষ হয়েছে। কেউ পাসপোর্টের কারণে নতুন করে চুক্তি করতে পারছেন না। আবার কারও সার্টিফিকেটের মেয়াদ ছয় মাস। তাকে নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট আপডেট করতে হবে। তবে যাদের সার্টিফিকেটে সমস্যা রয়েছে, বলা হয়েছে ওই সব সার্টিফিকেট অটো আপডেট করতে।’
বিদেশে আটকাপড়া জাহাজের কর্মীদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিদেশে কেউ আটকা পড়লে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ট্র্যাভেল পাস সংগ্রহ করে বিমানের মাধ্যমে দেশে আসতে পারেন। কিন্তু এখনও তো বিমান চলাচল সেভাবে চালু হয়নি। ‘তাছাড়া বহু বাংলাদেশি জাহাজের মাধ্যমে গিয়ে আটকা পড়ে আছেন, সে রকম তথ্য আমাদের কাছে নেই।’ এই সময়ে যারা জাহাজে আছেন তাদের ‘জাহাজের মাধ্যমেই দেশে ফেরা উত্তম’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।