সারপ্রাইজ গিফটে আমেরিকা ভ্রমণ
Tweet
অনিয়মিত ও সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী – পর্ব-০১
ভ্রমণকালঃ আগস্ট ২০১৮
রচনাকালঃ ১৭ জুলাই ২০২০
ড. মো. মামুন আশরাফী
সকাল সাতটায় মুঠোফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে আনন্দিত কন্ঠে আমার সম্বন্ধী (স্ত্রী’র বড় ভাই) বললেন, আপনার আর মুনমুনের জন্য আপনাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে ভাইবারে উপহার পাঠিয়েছি, দেখুন। আমি দেখলাম, কিন্তু প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছিলো। ফোনের শব্দ আর আমাদের কথাবার্তার শব্দে ততক্ষণে মুনমুন ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। ওকে দেখালাম মিন্টু ভাইয়া আমাদের দু’জনের জন্যে ঢাকা-নিউইয়র্ক-ঢাকার টিকেট পাঠিয়েছেন। মনে পড়লো, গতবার লং আইল্যান্ড সিটি পার্কে ইস্ট রিভারের তীরে এক রঙিন সন্ধায় ওপারে ম্যানহাটানের দিগন্ত বিস্তৃত উঁচু বিল্ডিং এর আলোঝলোমলো দৃশ্য দেখতে দেখতে কফি খাচ্ছিলাম আর ভাইয়ার কাছে শুনছিলাম শরতকালে কীভাবে পাল্টে যায় এখানকার সবুজ প্রকৃতি আর কিভাবে সে রং বেরং এর পত্রপল্লবের সমাহারে আর ঝরাপাতার আবেশে নিজেকে নতুনরূপে সাঁজায়। তখনই আগ্রহ প্রকাশ করে বলেছিলাম আবার যদি আমেরিকায় আসি, তাহলে শরতকালেই আসবো। সেটা মনে রেখেই তিনি সারপ্রাইজ গিফটটি পাঠিয়েছেন। সেজন্য ভাইয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে শুরু হলো আমাদের সংক্ষিপ্ত আমেরিকা ভ্রমণ পরিকল্পনা। সংক্ষিপ্ত বললাম একারণে যে, সারাবছরই আমি সময়ের নিদারুণ অভাবে দিন কাটাই।
অফিসের কাজকর্ম সহ সবকিছু মোটামুটি গুছিয়ে নিয়ে অবশেষে একদিন আমেরিকান শরতকাল দেখার উদ্দেশ্যে স্ত্রীসহ উড়াল দিলাম সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারের দেশে। সে এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণ যাত্রা। ঢাকা থেকে দুবাই পাঁচ ঘন্টা, আবার দুবাই থেকে প্রায় পনেরো ষোলো ঘন্টা। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, পেশায় একজন পর্যটন কর্মী হওয়ার কারণে বিগত প্রায় পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে আমাকে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কাজে ফ্রিকোয়েন্টলি ট্রাভেল করতে হয়। তাই এই প্লেন জার্নি আমার কাছে শুরুতে খুবই রোমাঞ্চকর লাগলেও মাত্রাতিরিক্ত ভ্রমণের কারণে ধীরে ধীরে আমার এই রোমাঞ্চ হ্রাস পেতে থাকে। এখন খুবই প্রয়োজন না হলে আমি ট্রাভেল করি না, লং-হল ট্রাভেল তো নয়ই। এর আগেও আমি যে কয়বার আমেরিকায় গিয়েছি, ততোবারই ট্রানজিট পয়েন্ট থেকেই একটি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে একঘুমে গন্তব্যে পৌঁছেছি, তবে ঘুম ঘুম চোখে প্লেনে খাবার খেয়ে নিয়েছি। কারণ, আমি ক্ষিদে সহ্য করতে পারি না।
নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে যখন নামলাম, তখন সকাল। বিভিন্ন এয়ারলাইনসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শত শত যাত্রী ঘুমঘুম চোখে হেঁটে এসে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে বিভিন্ন লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। সাদা চামড়া এক ইমিগ্রেশন অফিসার হাসিমুখে আমাকে আমেরিকা প্রবেশের অনুমতি দিলেও আমাকে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পাশে অপেক্ষা করতে বলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন কিছু আনুষ্ঠানিকতা সারবেন বলে। আমি ভাবলাম, কী সমস্যা হলো! আবার না আমার স্ত্রীকে কোন কারণে ডিপোর্ট করে দেয়! দু’বছর আগেও আমরা একইসাথে নিউইয়র্কে এসেছি, তখন তো কোন সমস্যা হয়নি! আমি একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর দেখি সে আসছে। মৃদু হেসে দূর থেকেই সে জানান দিলো, কোন সমস্যা নেই। আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
ইয়া লম্বা এক কালো আমেরিকানের ট্রলিতে আমাদের লাগেজ উঠাতে বলে বাইরে এসে দেখি ভাইয়া অপেক্ষা করছে। গাড়ীতে লাগেজ উঠিয়ে বিশ ডলার দিয়ে কালো দৈত্যটিকে বিদায় করে আমরা গাড়ীতে চেপে বসলাম। নিউইয়র্কের ঝকঝকে নীল আকাশ আর নির্মল বাতাস গায়ে মেখে আমরা ছুটে চললাম ফ্লাশিং এলাকায়, ভাইয়ার বাসায়।
গাড়ী তখন নিউইয়র্ক শহরে প্রবেশ করেছে। প্রশস্ত রাস্তা, ঝা চকচকে দামী গাড়ী, দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, দোকানপাট আর শহুরে সবুজের সমারোহ ভেদ করে আমরা এগিয়ে চলেছি। আমি ও মুনমুন তখন দীর্ঘ সময় ধরে ভ্রমণ ও না খাওয়ার কারণে ক্ষুধার্ত আর জেটল্যাগের কারনে ক্লান্ত। চোখের সামনে শুধু গরম খাবারের ছবি ভাসছে। ভাবীর হাতের রান্না করা স্যামন মাছ, রেড স্নাপার, রুপচাঁদা আরও কত কি! এমন সময় আরেকটি বিস্ময়ের মুখোমুখি হলাম। আমি এটির জন্যও প্রস্তুত ছিলাম না একেবারেই। ভাইয়া তার গাড়ীর ড্রয়ার থেকে একটি নতুন স্যামসাং মোবাইল ফোনের সেট এবং একটি সিম কার্ড বের করে আমাকে দিয়ে বললেন, এটি আপনার ভাবী আপনাকে উপহার দিয়েছেন। আমি খুবই লজ্জিত কিন্তু আনন্দিত ভঙ্গিতে উপহার গ্রহণ করে মোবাইল ফোনটি সচল করে প্রথমেই ভাবীকে ফোন করলাম। আমরা ততক্ষণে বাসার কাছাকাছি পৌছে গেছি। ভাবী যেন ফোনের অপেক্ষায়ই ছিলেন। একটি রিং হওয়া মাত্রই রিসিভ করলেন আর ততক্ষণে হঠাতই যেন লংকাকান্ড বেঁধে গেলো!
(চলবে)