ইলিশ পর্যটনে চাঁদপুর ও কিছুগল্প কিছুকথা
Tweet
মোনতাহা বিল্লাহ লিপুঃ পর্যটন বিষয়ে আমার যতটুকু জানাশোনা তা ঘোরাঘুরিতেই সীমাবদ্ধ। ব্যাক্তিগতভাবে আমি ভ্রমণ করতে অনেক পছন্দ করি, ছুটিছাটা পেলেই নতুন কোনো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ি, এতোটুকুই। অবশ্য পর্যটন বিষয়ে আমার তাত্বিক জ্ঞান না থাকলেও একজন পুরোদস্তুর পর্যটক হিসেবে পর্যটনের খবরাখবর রাখার চেষ্টা করি নিয়মিত।
সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটন বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনারে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবি ও উদ্যোক্তাগণ। আবু রায়হান সরকার (সুমন) এরকমই একজন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে এমবিএ করে হয়েছেন একজন পর্যটন উদ্যোক্তা। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান পর্যটনকে ঘিরে। অনেক সুযোগ থাকে সত্ত্বেও কখনো চাকরি করার কথা ভাবেননি। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা উত্থান-পতনের ভিতর দিয়ে তিনি প্রায় একযুগ সময় ধরে পর্যটন ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। ভিশন ট্যুরস বিডি’র প্রধান কর্ণধার তিনি।
কোভিড-১৯ মহামারীতে সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন খাত। যেকোনো দেশেরই টেকসই উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের ভূমিকা অসামান্য। করোনা পরবর্তী নিও-নরমাল সময়ে দেশের ডোমেস্টিক পর্যটনে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে যারা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আবু রায়হান তাদের অন্যতম। ডোমেস্টিক পর্যটনকে চাঙ্গা করতে তিনি চালু করেছেন ইলিশ পর্যটন। ইলিশ পর্যটন চালু করতে তিনি প্রাথমিকভাবে বেছে নিয়েছে ঢাকা- চাঁদপুর-ঢাকা রুট। বলাবাহুল্য যে, বাংলাদেশে তিনিই প্রথম চালু করেছেন ইলিশ পর্যটন। এবং ইতোমধ্যেই ইলিশ পর্যটন যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলা যায়।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো তার সাথে এবারের ইলিশ পর্যটন প্রোগ্রামে চাঁদপুর যাওয়ার। এই মৌসুমে ইলিশ পর্যটনের প্রতিপাদ্য ইলিশ কিনুন, প্রিয়জনকে ইলিশ উপহার দিন। এরকম একটা প্রতিপাদ্য আমার প্রথম হাস্যকরই লেগেছিলো। যাহোক, এই হাস্যকর কান্ড দেখতে রাজি হলাম পানি পথে চাঁদপুর যাওয়ার জন্য।
গত ৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় ঢাকা থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম বোগদাদীয়া-৭ নামক লঞ্চের বিজনেস ক্লাস আসনে বসে। যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম আমার মতো অতিউৎসাহী হয়তো দুই চার জন যাবেন ইলিশ পর্যটনে, কিন্তু ভিতরে গিয়ে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা দেখে আমি অবাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, বেশ কয়েকজন সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা, কিছু ব্যবসায়ীসহ কয়েকজন মিডিয়া কর্মীও উপস্থিত। ৩৭ জনের বিশাল একটা দল। পরে শুনলাম গ্রুপ মেম্বার বৃদ্ধি হওয়াতে নাকি শেষ মূহুর্তে কয়েকজনকে রেখে এসেছেন। কথা দিয়েছেন পরের কোনো প্রোগ্রামে তাদেরকে নিয়ে আসবেন।
সকালের নাশতা শেষ করে ভ্রমণসঙ্গীরা যে যার মতো ছবি তোলায় ব্যস্ত। এই ফাঁকে সুমনের ব্যস্ততম সময়ের আমি কিছুটা নিলাম গল্প করতে। ইলিশ পর্যটন শুরু করার গল্পটা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এর আগে ইলিশ রপ্তানির কারণে বাজারে এই মাছের মূল্য বৃদ্ধি ছিল। বিগত বেশকিছু বছর যাবৎ ইলিশ রপ্তানিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাজারে ইলিশের মূল্য হাতের নাগালে ছিল। ক্রেতা সাধারণ ইলিশ কিনে খেয়েছেও বেশ। কিন্তু এইবার করোনা মাহামারীতে ভোক্তাদের ক্রয়ের সামর্থ্য কমে গেছে তার উপর আবার রপ্তানিতেও আছে নিষেধাজ্ঞা। ফলে ইলিশমাছ ধরা জেলে, আড়ৎদার, পাইকার ও খুচরো ব্যবসায়ীসহ সবাই আছেন সংকটে। এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ভিশন ট্যুরস বিডি’র সামান্য প্রয়াস ইলিশের ভোক্তাদেরকে ইলিশের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। ভোক্তা পণ্যের কাছাকাছি এলে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয়। তাই তিনি ইলিশ পর্যটনের মাধ্যমে ভোক্তাদেরকে ইলিশের কাছাকাছি আনার চেষ্টা করছেন।
বেসরকারি চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের তুখোড় বিজনেস রিপোর্টার রুহুল আমিন রিপন ভাইও আমাদের ভ্রমণসঙ্গী। তার সাথে লঞ্চের আনাচেকানাচে, ছাদে, সিঁড়িতে ঘুরে ঘুরে আমরা ছবি তুলছি। হটাৎ ডাক পড়লো কেক কাটা হবে। ভাবলাম কারো মনে হয় জন্মদিনের কেক কাটবে, এই সুযোগে এক টুকরো কেক পেলে মন্দ কি! ওমা, গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড, এরকম একটা চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভাবতেই পারি নাই। বিরাট একটা আস্ত ইলিশ টেবিলের উপর থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এই ইলিশ যে কেক হতে পারে প্রথম দেখায় তা বোঝার উপায়ই ছিল না। এই কেকটি কাটলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
চাঁদপুর পৌঁছে লঞ্চ থেকে নেমে অটোরিকশা করে চলে গেলাম ইলিশ পার্কে। সেখান ফটোসেশান শেষ করে ইন্জিন চালিত নৌকা নিয়ে মেঘনার বুকে ঘুরলাম ঘন্টাখানেক। নদীতে ভাসতে ভাসতে নদীর পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখায় আছে অনন্ত সুখ। মাতাল মেঘনার বুকে সেই সুখ আহরণ করে আমরা দুপুরের খাবার খেতে গেলাম। আমাদের খাবারের আয়োজন করেছে খান’স ধাবা। আয়োজকদের সীমিত পরিসরে এতো বড় গ্রুপের বসার কিছুটা সমস্যা হলেও তাদের আন্তরিকতা দিয়ে তা পুষিয়ে নিয়েছে ভালভাবেই। কলাপাতায় বাসমতি চালের ভাত, শর্ষে ইলিশ, কয়েক পদের ভর্তাসহ ইলিশের মাথার মুড়িঘন্ট খেয়ে কেউ অতৃপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়না। বিশেষ করে খাবারের শেষে পুডিং ছিল অমৃত।
দুপুরের খাওয়ার পরের সময়টা বরাদ্দ করা ছিল ইলিশ পার্কে বসে ছায়াশীতল পরিবেশে বিশ্রাম নেওয়া অথবা আড়তে গিয়ে ইলিশ মাছ দেখা এবং কেনা। এক ফাঁকে আমি আর রুহুল ভাই চাঁদপুরের বিখ্যাত ওয়ান মিনিট আইসক্রিমের স্বাদ গ্রহণ করে আসলাম। সুস্বাদু এই আইসক্রিমটি খাঁটি দুধ থেকে বানানো হয়। আরও শুনলাম একশত বছরের বেশি সময় থেকে তারা এই পারিবারিক ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।
এবার আসল কথায় আসি। আড়তে এসে ইলিশের সমাহার দেখে মাথা চক্কর খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। জীবনেও এতো পদের ইলিশ একসাথে দেখা হয় নাই। মনে হলো শুধুমাত্র ইলিশ মাছের সমাহার দেখার জন্য হলেও একবার চাঁদপুর আসা উচিৎ। এতোক্ষণে ভালো করে বুঝতে পারলাম ভিশন ট্যুরস বিডি কতো সুন্দর একটা প্রোগ্রাম চালু করেছে। এধরণের প্রোগ্রাম তো আরও অনেক আগেই চালু করা উচিৎ ছিল। ইলিশ পর্যটনের এরকম একটা প্রস্তাব না থাকলে আমি হয়তো এই জীবনে এতো প্রকারের ইলিশ একসাথে দেখারই সুযোগ পেতাম না। এক কেজি ওজনের ইলিশ, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ, দুই কেজি ওজনের ইলিশ, মণে মণে ইলিশ, টনে টনে ইলিশ, সমুদ্রের ইলিশ, মেঘনার ইলিশ, পদ্মার ইলিশ মোটকথা ইলিশ আর ইলিশ।
ইলিশ কেনার কোন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ইলিশের সম্ভার দেখে কিনতে বাধ্য হলাম। ভ্রমণসঙ্গীদের বেশিরভাগেরই একই অবস্থা, সবাই কিনছে ইলিশ। অর্থাৎ ইলিশ পর্যটনের উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে বলা যায়। এরইমধ্যে রুহুল ভাইয়ের কপালে ঘটে গেল একটা ঘটনা। উনি স্তূপকার ইলিশের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার সাথে সাথে একের পর এক ফোন আসা শুরু হয়েছে। সবাই শুধু ওনাকে ইলিশ কিনে নিয়ে আসতে অনুরোধ করছেন। বেচারা পড়ে গেছেন মহাবিপাকে, নতুন করে ইলিশ কেনার মতো আর এক মিনিটও সময় অবশিষ্ট নাই। ইলিশ পর্যটনের আয়োজক সুমন লঞ্চ থেকে একের পর এক ফোন দিচ্ছেন, ঠিক পাঁচটার সময় ঘাট থেকে ছেড়ে যাবে লঞ্চ। আমরা দৌড়ে গিয়ে লঞ্চে উঠলাম। যারা এবার ইলিশ কিনতে পারেনি কিম্বা যারা ঘরে বসে পদ্মার ইলিশ বাসায় পেতে চায় তাদের জন্য আছে ঢাকাই এগ্রো এণ্ড ফার্মস। ঘরে বসে ন্যায্যমূল্যে ইলিশ পাওয়ার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এই আয়োজনে আমাদের সাথেই ছিল।
আমরা সবাই ঠিকঠাক আছি কি-না, বিকেলের নাশতা পেলাম কি-না সব বিষয়ই সুমন নজরদারি রাখছেন একজন দক্ষ নেতার মতোই। এবার রোদ কমে এলে সূর্য ডোবার পালা। বিকেলের নরম রোদ কেটে কেটে মেঘনার বুকে ভেসে জাহাজ এগিয়ে চলছে ঢাকা অভিমুখে। চাঁদপুরের দিকে ফিরে তাকালেই বিষন্নতার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে মন। সূর্য ডুবুডুবু। ঠিক এরকম কোনো একটা সময়েই হয়তো পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন, যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি // প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে সূর্য ডোবে রক্তপাতে। কিন্তু আমাদের সব টেলিফোন এসেছে বরং যে টেলিফোন আসার কথা ছিল না সে টেলিফোনও এসেছে। তাই আমাদের আর মনের অবস্থা খারাপ হয় না। ইলিশ মাছ দেখা আর কেনাকে কেন্দ্র করে ভিশন ট্যুরস বিডি অভিনব ইলিশ পর্যটন গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন। ইলিশ পর্যটনের জন্য শুভকামনা নিরন্তর…..