পর্যটনসম্পদে দিনাজপুর
Tweet
মোখলেছুর রহমানঃ দিনাজপুরের পর্যটন সম্বন্ধে কাউকে জিজ্ঞেস করলে অনায়াসেই তিনি বলে দিবেন কান্তজিউ মন্দির, রাজবাড়ি, রামসাগর, সীতাকোট বিহার ইত্যাদি ধরণের কয়েকটি নাম। কারণ, দীর্ঘদিন যাবৎ এ নামগুলির সাথে গণমানুষ পরিচিত। এক কথায় বলা যায়, এগুলি দিনাজপুরের পর্যটনের সিগনেচার বা পরিচয় বাহক। কিন্তু পর্যটনসম্পদের প্রাচুর্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দিনাজপুরে রয়েছে দৃশ্যমান (প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট) স্থাপনা এবং অদৃশ্য (সুনাম, ভাবমূর্তি ও সংস্কৃতি) নানা ধরণের পর্যটনসম্পদ, আকর্ষণ ও অনুগন্তব্য (Micro-Destinations)। একটু বিস্তারিতভাবে বলা যায় যে, ঐতিহাসিক নিদর্শন, সাংস্কৃতিক প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নগর স্থাপনার প্রত্নসম্পদ, জলাভুমি ঐতিহ্য, জাদুঘর, হস্তশিল্প, বাচন ঐতিহ্য ও আঞ্চলিক ভাষা, আচার উৎসব, চিরায়ত বিশ্বাস, সঙ্গীত, উপস্থাপযোগ্য কলা, সনাতন চিকিৎসা পদ্ধতি, নিজস্ব সাহিত্যকর্ম, আঞ্চলিক খেলাধুলা ইত্যাদি দিনাজপুরকে সত্যিকার অর্থেই ঐতিহ্যমন্ডিত করে রেখেছে। ইউনেস্কো কর্তৃক ২০টি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে ১৪টিই দিনাজপুরে বর্তমান। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বাংলাদেশের জেলাগুলিতে কী পরিমাণ পর্যটনসম্পদ রয়েছে। দিনাজপুর তার একটি উদাহরণ মাত্র।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এ সকল পর্যটনসম্পদ দিয়ে মানুষের কী হবে? মানুষ কেন এ সকল সম্পদের গণসংরক্ষণ করবে? সমাজ সংসারে কী কাজে লাগে এগুলি? উত্তর পরিস্কার: প্রথমত সকল পর্যটনসম্পদ পর্যটকদেরকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করে। ফলে পর্যটন গন্তব্যে পর্যটকদের আগমন ঘটে এবং বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ে। অন্যদিকে একটি এলাকার ঐতিহ্য ঐ অঞ্চলের সভ্যতার পরিমাপকও বটে। পর্যটন উৎস স্থান ও গন্তব্যের মানুষের মধ্যে বাহন হিসেবে সাংস্কৃতিক বিনিময়ে সহায়তা করে। অর্থাৎ দিনাজপুরের পর্যটনসম্পদের প্রাচুর্য এই গন্তব্যস্থানকে আগত ও সম্ভাব্য পর্যটকদের কাছে তুলে ধরবে, ফলে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নির্দেশকগুলির উন্নয়ন ঘটবে। উৎকর্ষ সাধিত হবে মানুষের মননশীলতার এবং শেষ পর্যন্ত শান্তি আসবে। কেননা, পর্যটনকে পৃথিবীর প্রথম শান্তির শিল্প এবং প্রত্যেক পর্যটককে সম্ভাব্য শান্তির দূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
দিনাজপুরের পর্যটনসম্পদের তথ্য পর্যালোচনা ও কাঠামোগত স্বরূপ উন্মোচনের জন্য নিচে অতি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো। এ থেকে কেবল একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। বিস্তারিত জানার জন্য ব্যাপক গবেষণার দরকার।
১. ঐতিহাসিক নিদর্শন: ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, দিনাজপুর ছিল প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের একটি অংশ। দিনাজপুর শহরের ১১ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত দেবকোট ছিল লক্ষৌটির রাজধানী। এই দেবকোট হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পর্যটন অনুগন্তব্য। ইতিহাস থেকে আরও পাওয়া যায় যে, রাজা সুখদেব রায় (১৬৪২-১৬৭৭ খ্রি:) দিনাজপুরের রাজা থাকালীন সময়ে ‘সুখসাগর’ খনন করেন। তাঁর পুত্র মহারাজা প্রাণনাথ (১৬৮২-১৭২২ খ্রি:) পিতার অনুসরণে দিনাজপুর শহর থেকে ১৮ কি.মি. দক্ষিণে খনন করেন ‘প্রাণসাগর’, দিনাজপুর শহরে রাজবাড়ি ও ১৮ কি.মি. উত্তরে ঢেপা নদীর পাড়ে স্থাপন করেন কান্তজিউ মন্দির। অতপর রাজা প্রাণনাথের পালিত পুত্র মহারাজা রামনাথ (১৭২২-১৭৬৩ খ্রি:) দিনাজপুর শহর থেকে ৬ কি.মি. দক্ষিণে ১৭৫০ সালে খনন করেন ‘রামসাগর’ নামক দীঘি। একইসাথে তিনি রাজবাড়ি ও কান্তজিউ মন্দিরের অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। তিনি রাজারামপুর গ্রামে ‘মাতাসাগর’ নামক আরেকটি দীঘি খননসহ একটি ‘কালিমন্দির’ স্থাপন করেন। বিজয় চক্রবর্তী নামে একজন সমাজকর্মী ১৮৫২ সালে বর্তমান দিনাজপুর জেলা স্কুল স্থাপন করেন। মহারাজা গিরিজানাথ রায়বাহাদুর ১৯১৩ সালে স্থাপন করেন ‘মাহারাজা গিরিজানাথ রায় হাই স্কুল’।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও ১৯৮১ সালের জেলাভাগ হওয়ার পর বর্তমানে ১৩টি উপজেলায় প্রায় ৩৩ লক্ষ মানুষের বাস দিনাজপুর জেলায়। এদের মধ্যে রয়েছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ রাজবংশী, সাওতাল, ওরাউঁ ও মুন্ডা স¤প্রদায়ের আদিবাসী। তাই এ জেলায় মসজিদ আছে ৪৮৯১টি, মন্দির ৯৫৬টি, চার্চ ৭৫টি, পেগোডা ২৩টি, মাজার ১৬টি এবং অন্যান্য পবিত্র স্থান ২৫৫টি। উল্লেখ্য, সবগুলিই ধর্মীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন এবং গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যপর্যটন সম্পদ। এদের মধ্যে কিছু সুপরিচিত স্থাপনা আছে যেমন – নয়াবাদ মসজিদ, কান্তজিউ মন্দির, ব্যপ্টিস্ট চার্চ, চেহেলগাজীর মাজার, গোরা শহীদ মাজার ইত্যাদি।
২. সাংস্কৃতিক প্রাচুর্য: জীবনযাত্রার সরলতার ভিতর দিয়েই এখানে আবহমানকাল থেকে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে তৈরি হয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রাচুর্য। গণমানুষের জীবন থেকে উঠে আসা এ সকল বিষয় কখনো উৎসবে, কখনো সামাজিক আচারে রূপান্তরিত হয়েছে। জীবনের এ সকল উপজীব্য বিষয় পর্যটনের মাধ্যমে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা সম্ভব। আগত পর্যটকরা তার কাছে ভিন্নরূপী কোন সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা অত্যন্ত আনন্দ ও শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেন।
৩. প্রত্নপর্যটন সম্পদ: প্রত্নস্থাপনাগুলি এ জেলার বিশেষ পর্যটন আকর্ষণ। কান্তজিউ মন্দির, সিংহ দুয়ার প্যালেস, দিনাজপুর রাজবাড়ি, রামসাগর, শ্রীচন্দ্রপুর দূর্গ, সীতাকোট বিহার, গোলাপগঞ্জের জোড়া মন্দির, চাউলিয়াপট্টির প্রাচীন মন্দির, গনেশতলার মহিশমর্দিনী মন্দির, নিমতলা কালী মন্দির, কালিতলা মশান কালী মন্দির, নয়াবাদ মসজিদ, সীতার কুঠুরি, হাবড়া জমিদারবাড়ি, গৌড়গোবিন্দ, অরুণ ধাপ, বার পাইকের পাড়, কালিয়া জিউ মন্দির বড়দুয়ারি, ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ি, কাহারোলে অবস্থিত প্রাচীন বিষ্ণু মন্দির প্রভৃতি স্থাপনা এখানকার অন্যতম প্রত্নসম্পদ। এর বাইরে অজানা কত প্রত্নসম্পদ রয়েছে যা বলা কঠিন। তবে প্রতিনিয়ত সে সবের অনুসন্ধান চলছে। প্রত্নসম্পদ একটি গন্তব্যের স্বীকৃত সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনসম্পদ। এসকল প্রত্নসম্পদ পর্যটকদের কাছে এই জেলার অতীত শাসন, শোষণ, বঞ্চনা ও আনন্দের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও প্রাচীন উন্নয়নের নির্দেশক। কেবল পর্যটক নয়, প্রত্নসম্পদ আমাদের উত্তরপুরুষদের কাছে পৌঁছে দেয় অতীত দিনের বিশেষ বার্তা।
৪. কৃষি ঐতিহ্য: কৃষিভিত্তিক দেশ বা জনপদে কৃষির চর্চা ও ঐতিহ্যকে দেখার জন্য নাগরিক মানুষেরা ছুটে চলেন অনাদিকাল থেকেই। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যারা পর্যটনের জন্য এই ঐতিহ্যকে লালন করে যাচ্ছে নানাভাবে। কিন্তু আমাদেরকে ভিন্নভাবে লালন করতে হয় না। কেননা, আমাদের সংস্কৃতিই কৃষিভিত্তিক। উত্তরাঞ্চলের জনপদ দিনাজপুর ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিসম্পদে সমৃদ্ধ। চিরিরবন্দর উপজেলার কাটারীভোগ চাল কিংবা সদর উপজেলার মাসিমপুর গ্রামের বেদেনা লিচুু এই জেলার চিরায়ত কৃষি ঐতিহ্য। এ ছাড়া বিরল উপজেলার লিচুগ্রাম হিসেবে খ্যাত মাধববাটি তো আছেই। বীজ উৎপাদনের জন্য দিনাজপুরের গুরুত্ব বাংলাদেশের কৃষিতে দীর্ঘদিন যাবৎ বিশেষভাবে উল্লেখ করা মতো। আধুনিক কৃষির পাশাপাশি আদি পদ্ধতির কৃষি চর্চা এখনো এখানে বর্তমান। যা কৃষি পর্যটকদেরকে আকর্ষণ করবে।
৫. জলাভুমি ঐতিহ্য: এই ধরণের পর্যটনসম্পদের মধ্যে পূনর্ভবা নদী, রামসাগর, আনন্দসাগর, মাতাসাগর, কড়াইবিল সকলের কাছে সুপরিচিত। ‘রামসার কনভেনশন নামক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যারা ১৯৭২ সাল থেকে সারা পৃথিবীতে জলাভুমি পর্যটন নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছে। তারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সহস্রাধিক জলাভূমি গন্তব্যকে ‘রামসার সাইট’ বলে চিহ্নিত করেছে এবং তৈরি করেছে এক বিশাল রামসার তালিকা। দিনাজপুরের কোন জলাভূমি অদ্যাবধি রামসার তালিকাভূক্ত না হলেও রামসাগরের মতো ঐতিহাসিক দীঘি তাদের বিবেচনায় আসার যোগ্যতা রাখে। উল্লেখ্য, সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের এই দুটি জলাভূমি রামসার কনভেনশন কর্তৃক ‘রামসার সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
৬. জাদুঘর: আধুনিক পর্যটন শিল্পের অন্যতম উপাদান জাদুঘর। জাদুঘরকে বলা হয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, নিদর্শন ও গল্পের সংগ্রহশালা ও জ্ঞানভান্ডার। একটি গন্তব্যের নানান ঐতিহ্যকে উত্তরপুরুষ ও আগত পর্যটদের কাছে তুলে ধরে। তাই জাদুঘর পর্যটন এখন পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। পৃথিবীর অনেক দেশের শহর এমনকি গ্রামে জাদুঘর গড়ে উঠেছে তাদের অতীত ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও অন্যের কাছে তা তুলে ধরার জন্য। দিনাজপুরে আছে একটি জাদুঘর, যাতে কয়েক শত বছরের প্রত্নসম্পদ সংরক্ষিত আছে। সংগ্রহের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের ৩য় বৃহত্তম জাদুঘরের মর্যাদা লাভ করেছে। এখানে আরও স্থাপন করা যেতে পারে গ্রামীণ জাদুঘর, ঐতিহ্য জাদুঘর এমনকি ভার্চুয়াল জাদুঘর। এই সকল জাদুঘর মানুষের জীবনযাত্রার বহুমুখী উপাদানকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরবে।
৭. হস্তশিল্প: প্রচীনকালে হাতে বুনা কাপড় বিশেষত রেশম কাপড়, পাটদ্রব্য, কাঠের কাজ, মুৎপাত্র নির্মাণ ও তাতে ছবি আকাঁ ইত্যাদি দিনাজপুরের বিশেষ ঐতিহ্যের পরিচায়ক। স্বর্ণকার, কামার, কুমার, সুঁচি ও এমব্রয়ডারি এবং কাঠের কাজ নিয়ে এখনো টিকে আছেন অনেক কুটির শিল্পী। পর্যটনসম্পদ হিসেবে এই হস্তশিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকে উত্তরাধিকারসুত্রে এই ঐতিহ্য থেকে মানুষের শিল্পচিন্তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
৮. আঞ্চলিক ভাষা: দিনাজপুরের রয়েছে নিজস্ব একটি আঞ্চলিক ভাষা, যা প্রমিত উচ্চারণ থেকে খানিকটা আলাদা। বিশেষত আদি ‘পলিয়া’ (হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই) সম্প্রদায়ের মানুষের এই কথ্য ভাষা এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। যেমন ‘আপনি কোথায় যাবেন?’ এর পরিবর্তে ‘কুন্ঠে যাবু বারে?’ অথবা ‘নিয়ে এসো’ এর পরিবর্তে ‘ধরি আইসেক’ ইত্যাদি। এই ভাষায় রচিত সঙ্গীত ও সাহিত্যকর্মের ঐতিহ্যমূল্য অনেক বেশি যা পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা যায়। এই আঞ্চলিক ভাষা কত প্রাচীন তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় নাই। তবে একথা ঠিক, এই আঞ্চলিকতার মধ্যে রয়েছে হাজার বছরের লুকানো ঐতিহ্য। অনেক পর্যটক এধরণের অপ্রচলিত বিষয় নিয়ে গবেষণাও করে থাকেন। এই অদৃশ্য ঐতিহ্য অনেক বড় পর্যটনসম্পদ।
৯. খাদ্য পর্যটন: প্রত্যেকটি অঞ্চলের রয়েছে নিজস্ব খাদ্য প্রস্তুতপ্রণালী বা রেসিপি ও খাদ্যাভ্যাস। আগত পর্যটকদের কাছে স্বাগত জনেেগাষ্ঠীর স্থানীয় খাদ্য অন্যতম আকর্ষণের বিষয়। বাইরে থেকে আসা পর্যটকরা এ ধরণের খাবার গ্রহণ করে নতুন অভিজ্ঞতা পেতে চায়। এমনকি কোন কোন গন্তব্যে শুধু তাদের স্থানীয় মানুষের প্রস্তুতকৃত খাদ্যের স্বাদ গ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে ঐ স্থান ভ্রমণ করেন। পাটশাকের পেলকা, ঘাটি নামক সব্জী-নিরামিষ, একটু বেশী লবন দিয়ে মুড়িভাজা, বড়মাছের বাসি তরকারি দিয়ে শীতের সকালে ভাঁপা পিঠার প্রাতঃহ্রাস, সিদল ইত্যাদি সহ হারিয়ে যাওয়া নানান রেসিপি হতে পারে আঞ্চলিক খাদ্য পর্যটনের বিশেষ আকর্ষণ। খাদ্য পর্যটনকে কারিগরি জ্ঞান দিয়ে উৎকর্ষ সাধন করতে পারলে, আলাদা করে দিনাজপুরের খাদ্য পর্যটন দিয়েই পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব।
১০. ক্রীড়া পর্যটন: ক্রীড়া পর্যটনের মধ্যে স্থানীয় খেলাধুলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। লোকজ ইনডোর ও আউটডোর উভয় ধরণের ক্রীড়া পর্যটকদের বিনোদনের বিশেষ অংশ। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের ক্ষেত্রে দিনাজপুরে তাদের নিজস্ব স্থানীয় খেলাধুলা প্রদর্শনের জন্য স্থানীয় ক্রীড়া পর্যটন উৎসব অনুষ্ঠান করে তাতে দেশি ও বিদেশি ক্রীড়ামোদী পর্যটক ও বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। স্থানীয় ক্রীড়ার মাধ্যমে পৃথিবীর নানান মানুষকে একস্থানে এনে প্রীতিডোরে বাধা সম্ভব। বলা বাহুল্য যে, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কানামাছি, দাড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি ইত্যাদি স্থানীয় ক্রীড়া আমাদের ঐতিহ্যপর্যটনের বিশেষ সম্পদ।
১১. বিশ্বাস, আচার ও উৎসব: ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র ভেদে বিশ্বাস, সংস্কার ও আচার টিকে আছে দিনাজপুরে। সনাতন হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। যেমন ধর্মীয় জ্যোতিষদের পরামর্শ ছাড়া সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখানে সাধারণত ছেলে-মেয়েদের বিয়ের তরিখ নির্ধারণ করেন না; অথবা রোগমুক্তির জন্য রাক্ষুসী কালীর পুজা দেন সনাতন হিন্দু জনগোষ্ঠী; কিংবা এরা সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে বাঁশ কাটেন না। একইভাবে এখানকার মুসলমানদের মধ্যেও রয়েছে কিছু বিশেষ ধর্মীয় সংস্কার, যেমন পীরের মাজার জিয়ারত, ওরশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী একেক ধর্মের মানুষ তাদের নিজস্ব আচার পালন করেন। আবার নবান্ন জাতীয় সর্বজনীন উৎসবে যোগ দেন সকল ধর্মের মানুষেরা। অন্যদিকে নানান ধর্মের মানুষের সাথে আদিবাসী মানুষদের জীবনাচার বহুমুখী ও বর্ণাঢ্য করেছে এই জনপদকে। পর্যটকদের কাছে এ সকল আয়োজন বিশেষ আকর্ষণের ও মর্যাদার। একটি জনপদের বিশ্বাস, ও আচার উৎসব তাদের নিজস্বতার ঐতিহ্যের পরিচায়ক।
১২. প্রাচীন লৌকিক চিকিৎসা: তাবিজ-কবজ কিংবা পানি পড়া দিয়ে রোগের চিকিৎসা আমাদের লোকচিকিৎসার একটি অংশ এবং ঐতিহ্য। এতে কি রোগ ভালো হয় কি না কিংবা এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না, বিশ্বাসের কাছে তা প্রাসঙ্গিক নয়। গবেষকগণ বলেছেন, বিশ্বাসের প্রভাব চিকিৎসার অংশ। এর অর্থ হলো, চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষের আস্থা কিংবা বিশ্বাস তার উপর বিশেষ শারীরতত্ত্বীয় প্রভাব ফেলে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। লোকচিকিৎসায় এই আস্থার স্থানটি অনেক বড়। এ জন্যই এই ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতিকে আধুনিককালে বিকল্প ও সম্পুরক চিকিৎসা বলে মানুষ গ্রহণ করেছে। দেশে দেশে এমন অনেক লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতি আছে যা আপাত দৃষ্টিতে অবৈজ্ঞানিক বলে মনে হয়। কিন্তু তাদের সমাজে টিকে আছে বছরের পর বছর ধরে। দিনাজপুরেও এমন আদি কিছূ লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। ইউনেস্কো একে ঐতিহ্য বলে চিহ্নিত করেছে। সঙ্গত কারণে পর্যটন বিশেষজ্ঞরা একে স্থান দিয়েছেন ঐতিহ্যপর্যটন সম্পদের সারিতে।
১৩. জলবায়ু: ১৯৯৭ সালের ডেভোস ঘোষণায় জলবায়ুকে পর্যটনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ও অনন্য সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দিনাজপুর বাংলাদেশের কম বৃষ্টিবহুল ও অধিক শীতসমৃদ্ধ জেলা। এ বিবেচনায় এর রয়েছে গ্রীষ্মকালে গলফ পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা। উল্লেখ্য যে, থাইল্যান্ডে সারা বছর গরম থাকে বলে গলফ পর্যটন তাদের অন্যতম ক্রীড়া পর্যটন। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে বেশ কয়েকটি ১৮-গর্তের গলফ মাঠ এবং বেসরকারি পর্যায়ে কয়েকটি ৯-গর্তের গলফ মাঠ রয়েছে। দিনাজপুরেও হতে পারে অনুরূপ ৯ কিংবা ১৮ গর্তের গলফ মাঠ। প্রচার করা গেলে গ্রীষ্মের শুরুতে দেশি এবং বিদেশি উভয় ধরণের গলফারগণই যোগ দিতে পারেন দিনাজপুরের গলফ আসরে। আবার শীতকালে ইউরোপিয়ানরা দীর্ঘমেয়াদি অবসর ভ্রমণের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিতে পারেন দিনাজপুরকে। এই সময় তারা অকৃত্রিম আতিথেয়তায় গ্রামে হোম স্টে করতে পারেন। ফলে মানুষের সাথে হবে ব্যাপক সংস্কৃতি বিনিময়, সাথে পাবেন স্থানীয় রেসিপির অনন্য স্বাদ। সুতরাং ২ মাস পর পর পরিবর্তনের মাধ্যমে যে ঋতুবৈচিত্র্য আমরা পাই – পর্যটনে তা সহজেই ব্যবহার করা যায়।
১৪. জীবনযাত্রা পর্যটন: দিনাজপুর এখনো কৃষিভিত্তিক আদি জীবনাচারকে ধরে রেখেছে। শিল্প স্পর্শ করতে পারে নাই এখানকার জীবনের মৌলিকতাকে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা সম্পদের প্রাচুর্যের বাইরে থেকে প্রকৃতির স্পন্দনে পরিচালিত হয়। এই অবয়ব অবলোকন করতে চান পৃথিবীর অনেক কৌতুহলী পর্যটক। কত কম সম্পদে মানুষের জীবন সুখে নির্বাহ করা যায় তা দেখতে হলে অবশ্যই দিনাজপুরে পা রাখতে পারেন সম্পদশালী অসুখী মানুষেরা। জীবনমুখী এই শিক্ষা পর্যটনের বিশেষ অংশ। উল্লেখ্য, জীবনযাত্রা একটি এলাকার অন্যতম পর্যটনসম্পদ হিসেবে পরিগণিত। জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা জীবনযাত্রা পর্যটনকে কোন গন্তব্যের আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক উন্নয়নে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও জীবনযাত্রা পর্যটনের অবদান অপরিসীম। তবে দরকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় সরকারের যুথবদ্ধ প্রয়াস।
পর্যটন মানুষের জীবন থেকে উঠে আসা একটি কর্মময় ও জ্ঞানভিত্তিক শিল্প। তাই এটি বিজ্ঞান, কলা, সমাজ বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও প্রযুক্তির সমন্বিত রূপ। তবে পর্যটনকে বুঝতে হলে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সম্পদ, সমাজ, সংস্কৃতিক ও মানুষের জীবনাচার সম্বন্ধে সবিস্তারে জানতে হবে। জানতে হবে এদের সংরক্ষণ কৌশল সম্বন্ধেও। ইতিহাস ও ফেলে আসা অতীত মানুষের এবং একইসাথে পর্যটনের অনেক বড় সম্পদ। মানুষের আচরণ, চাহিদা সবই পর্যটনের সাথে জড়িত। এক কথায় মানুষের বেড়ে উঠা, বেঁচে থাকার সকল উপাদানই পর্যটনসম্পদ। তবে মনে রাখতে হবে যে, সকল সম্পদের মতো পর্যটনসম্পদেরও জীবনচক্র আছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একে ব্যবহার না করতে পারে তা নষ্ট হয়ে যায়। দিনাজপুরের যে সকল চিহ্নিত ও সম্ভাবনাময় পর্যটনসম্পদ আছে স্থানীয় পরিকল্পনা মাফিক তার সদ্ব্যবহার করা উচিত। হয়তো জানিনা বলে পরিকল্পনাও করতে পারি না। তবে জানার চেষ্টা করলে স্বীকার করতেই হবে যে, দিনাজপুর পর্যটনসম্পদে কতটা সমৃদ্ধ।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সহজেই পুনরায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাই দিনাজপুরের মতো পর্যটনসম্পদে পরিপূর্ণ।
লেখক, আহবায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট।