পর্যটনের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন: মিথ না বাস্তব
Tweet
[আজ ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা কর্তৃক ২০২০ সালের এই দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারিত থিম শ্লোগান Tourism and Rural Development. এর আলোকে এই প্রবন্ধটি রচনা করা হলো।]
পর্যটনের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের সুযোগ আছে বলে এখন দেশে বিদেশে অনেকে দাবী করছেন। গবেষকদের পাশাপাশি অনুশীলনকারীরাও একই কথা বলছেন। তাহলে পর্যটনের মাধ্যমে বাস্তবে কি সত্যিই গ্রামীণ উন্নয়ন সম্ভব? যদি হয়, তাহলে গ্রামীণ উন্নয়নের যতগুলি শাখা আছে তার প্রত্যেকটিতে পর্যটন কী অবদান রাখতে পারে তা খতিয়ে দেখা দরকার। এসব বিষয় যখন পৃথিবীর উন্নয়নকর্মী, পরিকল্পনাবিদ, গবেষকদের ভাবনায় প্রবল – তখন জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা এ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে ‘পর্যটনের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন’ থিম শ্লোগান।
জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে প্রায় ৬৬% আন্তর্জাতিক পর্যটক কমেছে; কেবল জুন ২০২০ মাসেই কমেছে ৯৩%। ফলে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের পর্যটন রপ্তানি মার খেয়েছে। আগামী দিনে এর উন্নয়ন ঘটাতে হলে ভ্রমণ স্বাস্থ্যবিধি প্রবর্তন, পর্যটকদের আস্থা অর্জন ও স্বাগত গন্তব্যের প্রস্তুতি গ্রহণ ইত্যাদিতে যে সময় লাগবে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স বলছে, পর্যটনকে ২০১৯-এর জায়গায় ফেরত আনতে হলে ২০২৪ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে নিজেদের মতো এগিয়ে নিলে এবং বিশেষত গ্রামীণ এলাকার পর্যটনকে ভিন্নরূপে গড়ে তুললে অর্থনৈতিক মন্দা অনেকটা কাটানো যাবে। এই ব্যবস্থা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উন্নয়নের নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে নীতি নির্ধারকগণ মনে করেন।
গ্রামীণ উন্নয়ন করতে হলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে সর্বাগ্রে উন্নয়নের ধারণা (Sense of Developemnt) তৈরি করতে হবে যা তাদের আকাঙ্খাকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে নিজেদেরকে উন্নয়নের সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করবে। অতপর পর্যটন দিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে কীভাবে উন্নয়ন ঘটানো যায় তার পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। একে Persuasive Approach বলে। গ্রামীণ এলাকার সকল দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সম্পদের শুমারি, সম্পদের পরিরক্ষণ ও উপরিরক্ষণ (Conservation and Preservation), টেসকই উন্নয়নে সম্পদের ব্যবহার ইত্যাদির সাথে সকলের সম্যক পরিচিতি ঘটাতে হবে। সর্বোপরি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলির গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষতা বাড়াতে হবে। ফলে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
এবার প্রশ্ন হলো গ্রামীণ উন্নয়ন কী এবং পর্যটন কীভাবে এই উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। সহজ কথায় গ্রামীণ উন্নয়ন হলো গ্রামীণ এলাকার কৃষি ও অকৃষি কর্মকান্ডের একক ও যৌথ উন্নয়ন যা ঐ এলাকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের অগ্রগতি সাধন এবং প্রকৃতি ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন করে। মজার ব্যাপার এই যে, একমাত্র পর্যটন ছাড়া উন্নয়নের এই বহুমুখীতাকে কাঁধে তুলে নিতে পারে এমন কোন ব্যবস্থা এখনো আমাদের অজানা। তাই অন্তত নিচের দেড় ডজন কর্মকান্ডের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন সম্ভব বলে আমি মনে করি।
১. কৃষি উন্নয়ন: কৃষি গবেষণা, সম্প্রসারণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন করা হয়। কিন্তু হাল আমলে কৃষির উৎকর্ষ সাধনের জন্য পর্যটনকে যুক্ত করা হয়েছে। এতে করে পর্যটকরা কৃষি খামারে বা কৃষিপণ্য উৎপাদন এলাকায় ভ্রমণ করে কৃষিকার্যে অংশগ্রহণ করেন, জ্ঞান অর্জন করেন এবং সরাসরি কৃষিজাত পণ্য ক্রয় করেন। কৃষি পর্যটনের এই কর্মকান্ড কৃষিকে নতুন মর্যাদা দান করে ও প্রত্যক্ষভাবে কৃষিপণ্য ক্রয় নিশ্চিত করে। ফলে গ্রামের কৃষকরা মানসম্মত, নিরাপদ ও জৈব কৃষিপণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হয়। এভাবে কৃষি পর্যটন কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখে।
২. খাদ্যসম্পদের উন্নয়ন: প্রতিটি অঞ্চলের খাদ্য ঐ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় উৎপাদিত খাদ্যপণ্য দিয়ে ঐ অঞ্চলের মানুষেরা তাদের পছন্দের স্বাদমতো খাবারের প্রস্তুত করেন। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরণের ও স্বাদের খাবার পাওয়া যায়। পর্যটকদের কাছে খাবারের এই ভিন্নতা অনেক বড় আকর্ষণ। তারা ছুটে চলেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহুমুখী খাবারের আকর্ষণে। স্থানীয় খাদ্য ও খাবার (Food and Meal) সংরক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে ও অন্য জায়গার পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করতে খাদ্য পর্যটনের ভূমিকা অনন্য।
৩. বাণিজ্যিক উন্নয়ন: আমরা অনেকেই মনে করি যে, বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণনের জন্য শহরের বিকল্প নাই। এই ধারণা ভেঙ্গে দিতে পারে পর্যটন। কর্পোরেট বাণিজ্যকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিউনিটি বাণিজ্য সৃষ্টি করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে পর্যটনের। পর্যটন খুব সহজেই গ্রামীণ এলাকার মানুষদেরকে একত্রিত করে শুরু করতে পারে সমবায়ভিত্তিতে কমিউনিটি বাণিজ্য। তাদের নিজেদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা সহজেই মধ্যস্থতাকারী ব্যাতিরেকে তুলে দিতে পারে ভোক্তাদের হাতে। এভাবে গ্রামীণ এলাকায় গড়ে উঠতে পারে বাণিজ্য পর্যটনের। এই ধরণের পর্যটনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো পরিবেশের দূষণ রোধ এবং সমাজের অর্থনৈতিক অসমতা থেকে গ্রামের মানুষদেরকে রক্ষা করা।
৪. গ্রামীণ শিল্পোন্নয়ন: স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণ এমনকি অনেক পণ্যের রপ্তানি চাহিদা মেটানোর জন্যও গ্রামীণ শিল্প স্থাপন করা যায়। কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজনের উদ্দেশ্যে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, বৃষ্টির পানি বোতলজাতকরণ, ধাতু, মাটি ও কাঠের হস্তশিল্প, জামদানি, পোষাক শিল্প, পর্যটকদের জন্য স্মারক বস্তু ইত্যাদি ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপন করে তার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলকে শিল্প সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এরজন্য উচ্চ কারিগরি জ্ঞান ও আমদানিকৃত কাঁচামালের প্রয়োজন নাই। বরং স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে এবং মানুষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন রীতি দিয়েই তা গড়ে তোলা যায়। সাংস্কৃতিক পর্যটনের মাধ্যমে গ্রামীণ শিল্পোন্নয়নকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করার সুযোগ রয়েছে।
৫. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: আমাদের পর্যটন বাংলাদেশের অর্থনীতির ৩% দখল করে আছে। কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার তেমন কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গ্রামীণ পর্যটনের মাধ্যমে জৈব কৃষি ব্যবস্থা চালু, অকৃষি গ্রামীণ পণ্য যেমন নৌকা, পালকি, বাঁশি, বাঁশ ও বেতের দ্রব্যাদি, স্থানীয়ভাবে কমিউনিটি বিনিয়োগ, চিরায়ত গ্রামীণ খাবারের উৎপাদন কেন্দ্র, ভেষজ উদ্ভিদের চাষ, গ্রামীণ এলাকায় আয়ুর্বেদিক ওয়েলনেস সেন্টার স্থাপন, গ্রামীণ জাদুঘর স্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির মাত্রার পরিবর্তন করা সম্ভব। তাই পর্যটনকে গ্রামে এনে বসাতে হবে এবং স্থানীয় মানুষদেরকে সঙ্গে নিয়ে একে পরিচালনা করতে হবে।
৬. সামাজিক উন্নয়ন: গ্রামীণ এলাকায় পর্যটনের অনুশীলন শুরু হলে সঙ্গত কারণে ঐ এলাকার কতগুলি পরিবর্তন ঘটবে। যেমন এলাকাটি পরিচ্ছন্ন হবে, মানুষের পোষাক পরিচ্ছেদের গুণগত মান বাড়বে, মানুষের সাধারণ আচরণ পরিবর্তিত হয়ে তাতে সৌজন্যের মাত্রা বাড়বে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সব ধরণের প্রতিষ্ঠানের সেবার মান বাড়বে, দৃশ্যমান সামাজিক অনাচার কমবে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক পীড়নগুলির অনেকাংশে অবসান ঘটবে। কারণ পর্যটনের কারণে মানুষের অবাধ চলাচল ও স্থানীয় মানুষের সাথে আন্তঃক্রিয়ার জন্য অন্যায়, অনিয়ম ও অনাচারকারীরা অনেকটা পিছু হটবে। এটাই সামাজিক নিয়ম। তাই কেবল পর্যটনের অনুশীলন বাড়িয়ে সামাজিক সংকট দূরীকরণ এবং বহুমাত্রিক সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
৭. সাংস্কৃতিক উন্নয়ন: জীবন পরিচালনার সকল পথের সমাহারকে আমরা সংস্কৃতি বলি। অর্থাৎ জীবন পরিচালনার দৃশ্যমান ও অদৃশ্য উপাদানগুলি সংস্কৃতির অংশ। যেমন আমাদের জীবনধারা আমাদের সংস্কৃতি এবং এই জীবনধারা পরিচালানার উপাদান ভাত, শাড়ি, লুঙ্গি, বাংলা গান, নাচ, বাংলা ভাষা ইত্যাদি সবই আমাদের সংস্কৃতির অংশ। শুধু তাই নয়, ধর্ম, জাতীয় বিশ্বাস, ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন, প্রত্নসম্পদ, চিরায়ত চিকিৎসা ব্যবস্থা ইত্যাদি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। তাই পর্যটনের মাধ্যমে আমাদের এইসব সংস্কৃতিকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারলে তা কখনো হারিয়ে যাবে না। সাংস্কৃতিক পর্যটনের মাধ্যমে তা সুরক্ষিত হবে এবং উৎকর্ষ সাধিত হবে।
৮. লোকশিল্প উন্নয়ন: লোকশিল্প এমন একটি পর্যটনপণ্য যার মাধ্যমে পর্যটকরা স্থানীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে জানতে পারেন। লোকশিল্প মূলত একটি স্থানের ও মানুষের গল্প যা থেকে পর্যটকরা ঐ স্থান দর্শনে ও উক্ত ক্রাফট থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে আগ্রহী হন। লোকশিল্প উৎপাদন যেহেতু বড় আকারে ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হয় না – তাই এর সাথে মানুষের শিল্পজ্ঞান, মেধা ও প্রত্যক্ষ শ্রমের সংশ্লেষ থাকে। পর্যটন একে সহজেই মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারে। লোকশিল্প মানুষের শিল্পসম্মত দক্ষতার প্রকাশ এবং একে সমাজের সৌন্দর্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাই লোকশিল্প ও উৎপাদন দক্ষতা একটি মেধাবী সমাজের প্রতিচ্ছবি। তাই এর বিকাশ ও সম্প্রসারণের জন্য সাংস্কৃতিক পর্যটনের কোন বিকল্প নাই।
৯. পরিবেশগত উন্নয়ন: পরিবেশগত উন্নয়নের অর্থ হলো অবকাঠামো নির্মাণ, পারিপার্শ্বিক দৃশ্যপট, সবুজ এলাকা ও গণ-এলাকার উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ ও তার সৃজনশীলতা। গ্রামীণ পরিবেশ উন্নয়নের জন্য পর্যটনকে মাথায় রেখে অবকাঠামো উন্নয়ন ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করলে পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে, পর্যটন পরিবেশের অবনতি ঘটায়। একথা সত্য নয়। কারণ পর্যটন ও পরিবেশ একাট্টা হয়ে আছে। উল্লেখ্য যে, পর্যটন পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম শিল্প হওয়া সত্ত্বেও মোট নিঃসরিত কার্বনের মাত্র ৮% নিঃসরণ করে। পরিবেশের কোন প্রকার অবনতি ঘটতে পারে এমন কার্যক্রমকে পর্যটন বিশেষজ্ঞগণ পরিহার করার তাগিদ দিয়েছেন। অর্থাৎ অপরিকল্পিতভাবে পর্যটন পরিচালনা করে পরিবেশ নষ্ট কোনভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং, পরিবেশ উন্নয়নের জন্য পরিবেশ পর্যটনের সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দরকার।
১০. বিলুপ্তপ্রায় সম্পদ সংরক্ষণ: আমাদের দেশের গ্রামীণ এলাকা থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক উদ্ভিদ, প্রাণি, মানবসৃষ্ট ঐতিহ্যবস্তু ও সাংস্কৃতিক অনুশীলন। শংকার কথা যে, আমরা হারিয়ে ফেলেছি শতাধিক জাতের ধান, অগণিত ভেষজ উদ্ভিদ, দেশি জাতের মাছ, বুনো পাখি এমনকি বাড়ি ঘরের আদি স্থাপত্যকলা, গান, খাবার প্রস্তুতি রীতি ও সংরক্ষণের আদি কৌশল। এইসব সম্পদ পুনরায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে আমাদের সংস্কৃতি আগামী দিনে আত্মপরিচয় সংকটে পড়বে। পর্যটনের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সম্পদগুলি ফিরিয়ে এনে এদেরকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পর্যটকদের কাছে তুলে ধরে জাতিসত্ত্বা ও ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব।
১১. মানবসম্পদ উন্নয়ন: গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আমরা অনেকেই মানবসম্পদ বলে মনে করি না। আবার এই জনগোষ্ঠীই আমাদের সার্বিক কৃষি কর্মকান্ড পরিচালনা করে, শ্রমিক হিসেবে বিদেশে গমন করে এবং জিডিপিতে বড় অবদান রাখে। জনসংখ্যার প্রায় ৮০% মানুষকে প্রকৃত মানবসম্পদে পরিণত করার কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। অন্যদিকে এই বিপুল পরিমাণ মানুষকে গড়ে তোলার জন্য এই দেশে এখনো তেমন কোন ব্যবস্থা গড়ে উঠে নাই। এই কাজটি করার জন্য একমাত্র পর্যটনকে সবচেয়ে সফলভাবে ব্যবহার করা যায়। গ্রামগুলিকে পর্যটন গ্রামে রূপান্তরের পদক্ষেপ নিলে গ্রামীণ জনবলকে পর্যটনপণ্য ও সেবা উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং সেবা প্রদান এই ৩ ধরণের কাজের জন্য প্রশিক্ষিত করে তোলা যায়। বলা বাহুল্য, এই ধরণের জনবলের দেশে এবং দেশের বাইরে ক্রমবর্ধমান চাহিদা রয়েছে।
১২. শিক্ষাগত উন্নয়ন: পর্যটন শিক্ষা মানেই জীবনমুখী শিক্ষা। গ্রামের মানুষ এখনো যথেষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করে বিধায় তাদের প্রায়োগিক শিক্ষা ও জ্ঞান নাগরিক মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। তাই প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি পর্যটন শিক্ষা এবং পর্যটনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা হলে গ্রামের তরুণরা অনেক বেশি উৎপাদনশীল হয়ে উঠতে পারে। যেমন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, গাইডিং, পর্যটকদের জন্য পল্লী পরিবহন, ভেষজ উদ্ভিদের চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, পণ্য ও সেবা বাজারজাতকরণ ইত্যাদি নানা ধরণের প্রায়োগিক শিক্ষা প্রদান করা যায়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি পর্যটন শিক্ষা তাদেরকে অনেক বেশি দক্ষ ও কর্মক্ষম করে তুলতে পারে।
১৩. চিরায়ত চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন: পল্লী চিকিৎসক তৈরি করে আমরা চিকিৎসা সেবাকে গ্রামের মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। রাষ্ট্রের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে যদি আমরা গ্রামের যুবকদেরকে বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় এনে ডিপ্লোমা-ইন-আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি (ডিএএমএস) প্রদান করি এবং সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গ্রামীণ চিকিৎসাকর্মে নিয়োজিত করি। এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন গ্রামের এসএসসি পাশ যুবাদেরকে সম্মানজনক চিকিৎসা পেশায় যুক্ত করবে। অন্যদিকে দেশজ উৎস থেকে তৈরি ঔষধ দিয়ে চিরায়ত পদ্ধতিতে কার্যকর চিকিৎসা জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাবে। এর ফলে গ্রামগুলিতে চিকিৎসা পর্যটনের এক নতুন রূপ আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে।
১৪. সামাজিক পুঁজি উন্নয়ন: গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখন খুব সীমিত পরিমাণে ব্যাংকের ঋণ, বিস্তর এনজিওর ঋণ এবং তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয়ভাবে প্রায় ৩০০% সুদের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ করে। এই বাস্তবতার প্রধান কারণ হলো সামাজিক পুঁজির অভাব। সামাজিক বিবর্তনে উদ্ভুত সামাজিক সংকট ও অনাস্থা বৃদ্ধির ফলে আমাদের সমাজে আস্থা, ভালবাসা, যোগাযোগ, নেটওয়ার্ক ইত্যাদি সামাজিক পুঁজির ক্রমাগত ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই সমন্বিতভাবে কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে সহজেই সামাজিক পুঁজির পরিমাণ বাড়ানো যায়, যা গ্রামীণ উন্নয়নকে বহুমাত্রিকভাবে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে।
১৫. মানবিক উন্নয়ন: একটি সমাজে সামাজিক পুঁজির ঘাটতি দেখা দিলে মানবিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্থ হয়। বলা বাহুল্য যে, কোন সমাজে মানবিক উন্নয়ন ব্যতীত কার্যকর ও টেকসই উন্নয়ন হয় না। মমতা, দয়া, স্নেহ, শ্রদ্ধা এই সকল মানবিক গুণাবলি সমাজে টিকিয়ে রাখতে হলে নানামুখী গ্রামীণ পর্যটনের অনুশীলন করতে হবে। একটি গ্রামের সকল মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পর্যটন পরিচালনা করলে তা থেকে প্রত্যেকেই আর্থিক ও সামাজিকভাবে লাভবান হবেন। এই অবস্থা বজায় রাখতে পারলে একটি গ্রামের মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলিগুলি বৃদ্ধি পাবে এবং সার্বিক মানবিক উন্নয়ন সংঘটিত হবে। পর্যটনের এই শক্তিমত্তা দিয়ে মানবিক উন্নয়ন করতে পারলে আগামী দিনের গ্রামগুলি মানবিক গ্রামে পরিণত হবে।
১৬. নারী উন্নয়ন: জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা বলছে, সারা পৃথিবীতে পর্যটনে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ১৪.৭%। অর্থাৎ পর্যটনে নারীর অংশগ্রহণের ব্যাপক সুযোগ আছে। পর্যটনে নারী ৬ প্রকারে অংশগ্রহণ করে থাকে। ক) কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খ) পর্যটনে শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ, গ) পর্যটন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান, ঘ) পর্যটন কার্যক্রম গ্রহণে নেতৃত্ব প্রদান, ঙ) পর্যটন বিষয়ক নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং চ) স্থানীয় সম্প্রদায় ও নাগরিক সমাজ গঠনে পর্যটনের প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। গ্রামীণ পরিবেশে নারীরা অনেক বেশি পিছিয়ে আছে। তাই তাদেরকে কাজের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দিতে চাইলে পর্যটনকে অবশ্যই প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের স্থানীয় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে বর্তমান কাঠামোর পরিবর্তন করে নারীদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় প্রশিক্ষিত করে পর্যটনে যুক্ত করতে হবে। অন্যথায় সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং উন্নয়ন টেকসই হবে না।
১৭. জীবনযাত্রার উন্নয়ন: জীবনযাত্রার উন্নয়ন বলতে কেবল মানুষের ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক উন্নয়নকে বুঝায় না। বরং তা মানুষের চিন্তা, দর্শন ও কাজের গুণগত মানোন্নয়নকে বুঝায়। গ্রামীণ মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য পর্যটনকে এখন এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষা, উদারতা, চেতনার স্বচ্ছতা, শিষ্টাচারপূর্ণ আচরণ ইত্যাদি গ্রামের মানুষকে নতুন ও আধুনিক অবয়বে রূপান্তরিত করবে। মানুষের মধ্যে তৈরি করবে পুষ্টি, স্বাস্থ্য, রোগ ব্যবস্থাপনা, জীবনধারার জ্ঞান ইত্যাদি। যা দিয়ে তৈরি হবে একটি নিরোগ ও কর্মময় সমাজ। শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ব্যাধি দূর হবে ক্রমান্বয়ে। তাহলে সত্যিই ভেবে দেখা দরকার যে, আমরা পর্যটনকে গ্রাম পর্যায়ে কেন নিব না। একথা আজ দায়িত্ব নিয়ে বলা যায় যে, পর্যটন গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রাকে খুব সহজে উচ্চমার্গে পৌঁছিয়ে দিতে পারবে যার সমকক্ষ কোন ব্যবস্থা এখনো উদ্ভাবিত হয় নাই।
১৮. টেকসই গ্রামীণ উন্নয়ন: প্রায় সকল উন্নয়নই ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী। তাই আমরা টেকসই উন্নয়নের সন্ধান করি। টেকসই উন্নয়ন হলো যে উন্নয়ন কোন অবস্থাতে তার নিজ স্থানের নিচে নামে না। বলতে দ্বিধা নাই, এইরূপ উন্নয়ন ব্যবস্থা বিরল। তবে আশার কথা যে, বিশেষজ্ঞগণ পর্যটনকে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যম বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে তা কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, এটা নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। যেমন কৃষি উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদন ও সঠিক বিক্রয়মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটনের মাধ্যমে একটি গ্রামের কৃষি উৎপাদনের মান, পরিমাণ ও মূল্যকে আগাম প্রচার করতে শুরু করলে তা সহজেই ক্রেতাদেরকে আকৃষ্ট করবে। ফলে ক্রেতারা কৃষি প্রযুক্তি স্বচক্ষে দেখার জন্য উক্ত গ্রামে ছুটে যাবেন, তা ভোগ করবেন এবং চূড়ান্তভাবে ঐসব পণ্যের ক্রেতা হবেন। একইভাবে গ্রামীণ অন্যান্য কৃষি ও অকৃষিপণ্য, সংস্কৃতি, আচার, রীতি, উৎসব ইত্যাদি সবই পর্যটকরূপী ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরা যায়।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বসবাসের স্থান গ্রাম। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, গ্রামীণ পর্যটন এমন এক ধরণের দায়িত্বশীল পর্যটন যা স্থানীয় মানুষের জীবনমুখী কার্যক্রম, উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তুরক্ষণ করে। ফলে গ্রামীণ উন্নয়ন সাধন ও এর টেকসই রূপ গড়ে উঠতে পারে। বিশ্ব পর্যটন দিবসের এই শিক্ষা সাধারণ মানুষ থেকে নীতি নির্ধারক পর্যন্ত সকলকেই ধারণ করতে হবে। কৃষি বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লবের পর বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়াল ক্ষতিকে প্রগতিশীলতা দিয়ে মোকাবেলা করার জন্য এবার দরকার পর্যটন বিপ্লবের, যা গ্রাম থেকেই শুরু হবে। দেশে দেশে গড়ে উঠা এই বিপ্লব পুরাতন জরাজীর্ণতাকে ভেঙ্গে প্রগতির পথে এগোবে। ঐ দেখুন, অনিরুদ্ধ পর্যটন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য দূর্বার গতিতে এগিয়ে আসছে।
মোখলেছুর রহমান
আহ্বায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট