সাফল্যের নেশায় যেভাবে নিজেকে বদলে ফেললেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
Tweet
মোহাম্মদ আলী শাহঃ ইউনাইটেডের দিনগুলো যতদূর মনে পড়ে, সে সময়টায় তিনি অনেকবেশি মনোযোগী ছিলেন প্লে-মেকিং, ফ্রিকিক এবং ড্রিবলিংয়ে। ব্যপারটা এমন নয়, তিনি ড্রিবলিং জানেন না কিংবা পারেন না। ধীরে ধীরে যখন বিশ্বসেরা হয়ে উঠেন, তখন পুরো পৃথিবী উনার দিকেই ফোকাসড ছিল। ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনাও উনাকে পাবার জন্য কয়েকবার বিড করেছিলো।
মেসির উঠে আসার ছোট একটি গল্প মনে করিয়ে দিচ্ছি। বি-টিমের হয়ে যখন একের পর এক সাফল্য পাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই যথারীতি তিনি মূলদলে উঠে আসেন। রাইকার্ডের ফুটবল দর্শন কখনোই একক ফুটবলার নির্ভর ছিল না। ডাচরা কখনোই এককভাবে তাদের দলকে খেলানোয় বিশ্বাসী নন! এটাই তাদের ফুটবল দর্শন। কিন্তু ততদিনে মূল দলের হয়ে মেসি বেশ কিছু দুর্দান্ত গোল করে ফেলেছিলেন সম্পূর্ন একক প্রচেষ্টায়। নিজেকে সেরা তরুণ প্রমাণ করে ফেলেছেন খুব অল্প সময়েই। পেপ যখন দ্বায়িত্ব নেন, উনি উনার মত করেই মেসি কেন্দ্রিক ছক সাজান। মেসি কে, কি এবং মেসির সামর্থ্য সম্পর্কে ততদিনে পেপ তো জানবেনই, যেখানে পুরো পৃথিবীই জেনে গিয়েছিলেন। অগণিত লা লীগা সেরা গোল মেসি করেছেন সম্পূর্ন একক প্রচেষ্টায় যেখানে ভিয়া, ইতো, ইব্রা রা ফাঁকা পোস্টে কিংবা অন্যপ্রান্তে দাড়িয়েছিলেন। দয়া করে এখন যা বলছি, এই বিষয়টি নেগেটিভলি না দেখার জন্য বিশেষ অনুরোধ করছি। কারণ ফুটবলে ভাগ্য অসম্ভব বড় একটি আশীর্বাদ। কোন খেলোয়াড় যখন দিনের পর দিন ৩/৪/৫/৬ জন খেলোয়াড়কে ড্রিবল করে একক প্রচেষ্টায় গোল দিতে সমর্থ হোন, তখন এটি দলগতভাবেই এক ধরনের এপ্রুভাল পেয়ে যায়। পেপের সেদিনের সমর্থন আজ মেসিকে সর্বকালের অন্যতম সেরা বানিয়েছেন। সেদিন যদি পেপ এই একক খেলাটার সমর্থন না দিতেন, মেসিকে বাধ্য হয়েই ২-১ জনকে ড্রিবল করার পর পাস দিতে হতো বাধ্য হয়ে। একজন কোচ চাইলেই যেকোন খেলোয়াড়ের খেলার ধরন পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন। এনরিকের সময়টায় অনেক কিউলকে দেখেছি তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে! এনরিকে কেন মেসিকে এত ডিপে খেলাচ্ছেন এটাই ছিল অভিযোগ অথচ পরবর্তিতে মেসিকে আরো সেরা প্লে-মেকার হতে সাহায্য করেছিল এনরিকের সেই ট্যাকটিসটি। এমনকি মেসি রেগুলার বেসিস ফ্রি-কিক নেয়া শুরু করেন সেই থেকেই। পেপের সময়টায় মোস্টলি কর্নার কিংবা ফ্রি কিক নিতেন জাভি! একজন খেলোয়াড় তিনি যত প্রতিভাবানই হোন না কেন, একজন কোচ তার জন্য অভিশাপ কিংবা আশির্বাদ হয়ে উঠেন। কোচের সুদৃষ্টি এবং মূল প্ল্যানে স্থান পাবার জন্য ভাগ্যেরও প্রয়োজন। তার উপর মেসির খেলার পুরোটাই গড গিফটেড মনে হয় অধিকাংশ সময়ই। পেপ এবং এনরিকের হিউজ অবদান আজ মেসিকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। তাইতো তিনি একাধারে আজ ড্রিবল-প্লেমেকিং-ফ্রিকিক এবং গোল দেয়াতেও অন্যতম সেরা।
ঠিক তেমনি, রোনালদোকে দারুণ সুযোগ করে দিয়েছিলেন SAF. কারন একজন কোচই সবচে’ ভাল জানেন তার স্কোয়াডের সেরা খেলোয়াড়টি কে এবং তার সামর্থ্য।
ওয়েল, রোনালদো যখন রেয়াল মাদ্রিদে আসলেন, তখন ইউনাইটেডের খেলার সেই প্লট কিন্তু তিনি পাননি। কারণ তাকে ম্যানচেস্টার থেকে মাদ্রিদে আনাই হয়েছিল সাফল্যের আশায়। অতএব রোনালদো নিজে তখন প্লেমেকিংয়ে মনোযোগী না হয়ে গোল করায় বেশি মনোযোগী হলেন। শুরুর দিকে কিছু কিছু ম্যাচে দারুণ কিছু ড্রিবল এবং ছন্দময় ফুটবল দিয়ে রেয়াল মাদ্রিদ যাত্রা শুরু করলেও, পরবর্তিতে সাফল্যের তাগিদে গোলের দিকেই সর্বোচ্চ মনোযোগী হয়ে উঠেন। আর মৌরিনহো তো এই জায়গাটায় রোনালদো কে পুরোপুরি তাতিয়ে দিলেন। অসংখ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট শট নেবার পরও কোচ তাকে এসবে বারণ করতেন না। কোচ তার সেই সামর্থ্যটা জানতেন বৈকি! কোচদের এসব এপ্রুভালই খেলোয়াড়দের কনফিডেন্স শতভাগ বাড়িয়ে দেয়। সে সময়টায় মৌরিনহো ম্যাচ জয় করাটাকেই বেশি বেশি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। এ ধরনের কোচের আন্ডারে এককভাবে পারফর্ম করার সুযোগ থাকে খুবই কম। মৌরিনহোর খেলার মাঠের মূল লক্ষ্যই থাকে সতীর্থ খেলোয়াড়কে পাস দিতে হবে এবং এটা মাস্ট। কোনভাবেই বেশি বেশি পাস দিয়ে বলের গতি কমানো যাবে না। আক্রমণাত্মক এবং আগ্রাসী ফুটবলটা সবসময় স্পিডি হয়, যেখানে খেলার ধর্মই হচ্ছে দৌড়াও, প্রতিপক্ষের উপর আঘাত হাণো এবং গোল দাও।
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর রোনালদো এমন ধাঁচের খেলায় নিজেকে অভ্যস্ত করলেন। ধীরে ধীরে সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করলেন। কারণ এই গোলের মাধ্যমেই দলীয় এবং ব্যক্তিগত সাফল্য ধরা দিচ্ছিলো। বয়স, মিডিয়া, ফ্যান এবং রাইভালরা এমনভাবে তাকে নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা এবং গবেষণা করতে শুরু করলেন যে, তার এখন আর পেছনে ফিরে ইউনাইটেডের রোনালদোর স্টাইলে খেলার অবস্থান ছিল না। এমনিতেই ছিলেন শতভাগ অ্যাথলেট, সেখান থেকে নিজেকে দিন দিন আরোবেশি এক্সারসাইজ এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিণত করলেন আরো ধারালো এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নিজেকে যেন নিজেই বলতেন, “আমাকে গোল করতে হবে এবং সেটা যেভাবেই হোক।”
ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, রোনালদো হচ্ছেন সবচে’ ইন্টেলিজেন্ট এবং স্মার্ট খেলোয়াড় যিনি সাফল্যের নেশায় নিজেকে এবং নিজের খেলার ধরন পরিবর্তন করে ফেলেছেন। আজ যদি রোনালদো ইউনাইটেড এর খেলার স্টাইলে নিজেকে ধরে রাখতেন, সেক্ষেত্রে তিনি হয়ত কয়েক ম্যাচ পর পর বাহবা পেতেন, অন্যসব লিজেন্ডদের মতই ইউনাইটেড কিংবা রেয়াল মাদ্রিদের একজন ফুটবল লিজেন্ড খেতাব পেতেন। কিন্তু কখনোই আজকের রোনালদো হতে পারতেন না! হতে পারতেন না সর্বকালের অন্যতম সেরাদের একজন।
গতকাল রোনালদো দুটি গোল করেছেন এবং দুটি গোলই করেছেন পেনাল্টিতে। এমনকি সেই পেনাল্টি গোল করেও দারুণ আনন্দ করেছেন। তার কাছে গোল মানেই সাফল্য, গোল মানেই শান্তি, গোল মানেই আনন্দ, গোল মানেই দলের জয়। সত্য হচ্ছে, তার ভয়ংকর ক্ষুধাটা তো শুধু গোল করার, সেরা প্লেমেকারের নয়! এমন একজন মানুষের প্রতি আবারো মনোমুগ্ধকর ড্রিবল দেখা কিংবা বেস্ট প্লেমেকার হিসেবে দেখার জন্য তাই নেই কোন বাড়তি ক্ষোভ কিংবা অভিযোগ কিংবা প্রত্যাশা। ভাই তুমি শুধু গোলই দাও, আমরা সমর্থকরা এতেই খুশি। যেভাবে খুশি গোল দাও, আমরা সমর্থকরা তাতেই খুশি।