সুন্দরবনের সাতকাহন দ্বিতীয় পর্ব
Tweet
সুন্দরবনের আয়তন
এখন সুন্দরবনের মোট আয়তন কত বলতে পারবেন? অনেকেই তো চেঁচিয়ে বলবেন, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিমি। উহু, সে হলো আমাদের দেশের সুন্দরবনের আয়তন। ভারতেও তো সুন্দরবনের একটা বড় অংশ থেকে গেছে। দুটো মিলিয়ে সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিমি। তবে ইউনেস্কো আবার সুন্দরবনকে দু’ভাগ করে হিসেব করে; ওদের কথা অনুসারে আমাদেরটার নাম সুন্দরবন, আর ভারতের অংশটুকুর নাম সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্ক। সেই হিসেবে অবশ্য আপনাদের কথায় কোনো ভুলও নেই!
আবার আমাদের দেশের সুন্দরবনের আয়তনের আরো একটা হিসেব আছে। এই ৬ হাজার ১৭ বর্গকিমি তো পুরো বনটা। এরমধ্যে স্থলভাগ মোটামুটি ৪ হাজার ১১০ বর্গকিমি। আর নদী-খাল-খাঁড়ি মিলে জলভাগ মোটামুটি ১ হাজার ৭০০ বর্গকিমি।
সুন্দরবনের গাছপালা
সুন্দরবনের প্রধান গাছ কোনটা, সে তো আগেই বলে দিয়েছি– সুন্দরী গাছ। এছাড়াও গেওয়া, কেওড়া, গরান আর ধুন্দল গাছও ওখানে প্রচুর পাওয়া যায়। এছাড়া শন, নলখাগড়া, গোলপাতার মতো উদ্ভিদও জন্মে প্রচুর। তবে মোটমাট কয় প্রজাতির গাছ যে ঐ বনে আছে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। কারণ, আমাদের প্রিয় এই বনে যে ঠিকমতো জরিপই হয় না। আর এই বনে জরিপ করাও তো মুখের কথা না! শেষ বড়োসড়ো জরিপটি হয়েছিল এখন থেকে প্রায় একশ সতেরো বছর আগে, ১৯০৩ সালে। তখনো বনটিতে প্রায় ৩৩৪ প্রজাতির গাছ ছিল।
সুন্দরবনের বনবাসীরা
সুন্দরবনের পশুপাখির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পশুটির নাম শুধু আপনি কেন, সম্ভবত পৃথিবীর সবাই জানে– রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তবে দিনদিন মানুষের আগ্রাসনে সুন্দরবন যেমন ছোট হয়ে যাচ্ছে, তেমনি কমে যাচ্ছে ওদের সংখ্যাও। ২০০৪ সালের জরিপে দেখা গেছে, এখন সুন্দরবনে মোট বাঘই আছে ৪৪০টি। তারমধ্যে ২৯৮টা মেয়ে বাঘ, ১২১টা ছেলে আর বাকি ২১টা বাঘের বাচ্চা।
এছাড়া সুন্দরবনের অন্যান্য বিখ্যাত আর গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীদের মধ্যে আছে হরিণ, বানর, মহিষ, গণ্ডার, মেছোবাঘ, লোনাপানির কুমির, মিঠাপানির কুমির, ঘড়িয়াল, কচ্ছপ, হাঙর, ডলফিন, শুশুক, বন্য শূকর, বনরুই, বনবিড়াল, শেয়াল আর গিরগিটি। এদের মধ্যে আবার হরিণ একটু বেশিই বিখ্যাত। বিশেষ করে কয়েক প্রজাতির হরিণ তো বেশ পরিচিত; ঐ যে মাথায় শুকনো গাছের ডালপালার মতো আঁকাবাঁকা শিংওয়ালা চিত্রা হরিণ, তারপর মায়াভরা চোখের মায়া হরিণ, আর শুধু ম্যানগ্রোভ বনেই দেখা যায় যেই হরিণদের- প্যারা হরিণ।
সুন্দরবনে কিন্তু খুব মজার মজার সব মাছ পাওয়া যায়। ওগুলো খেতেও যেমন মজা, দেখতেও তেমনই সুন্দর আর বৈচিত্র্যময়। আর ওদের নামগুলোও কত্তো সুন্দর! কয়েকটার নাম শুনেনই না– পারশে, বাটা ভাঙান, ভাঙান, গুল বাটা, খরুল ভাঙান, খরশুলা বা খল্লা, কাইক্কা বা কাইকশেল, মেদ মাছ, বড় কান মাগুর, দাগি কান মাগুর, গুলশা ট্যাংরা, নোনা ট্যাংরা, শিলং, কাজলী, ভোল, গনগইন্যা, রেখা, গুটি দাতিনা, লাল দাতিনা, লাক্ষা (স্থানীয় নাম তাড়িয়াল), তপসে (স্থানীয় নাম রামশোষ), ঢেউয়া, মেনো (ডাহুক মাছ নামেও পরিচিত), ফ্যাসা, বৈরাগী। এগুলো তো গেল লোনা পানির মাছেদের কথা। সুন্দরবনে কিছু মিঠা পানির বিল আছে, যেগুলোতে মিঠা পানির মাছও পাওয়া যায়। মিঠা পানির মাছগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় জিওল মাছ। এছাড়া কই, শিং, মাগুর, টাকি, শোল, ট্যাংরা, পুঁটি, খলসে, চ্যালা, দাঁড়কিনা, কুঁচো চিংড়ি, আরো কত্তো মাছ যে পাওয়া যায় এই বনের নদী- নালা- খাল- বিলে! তবে দিন দিন এসব মাছও কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ায় মিঠা পানির বিলগুলোতে ঢুকে পড়ছে সাগরের লোনা পানি। ফলে মিঠা পানির মাছেদের বাসাও সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সুন্দরবনের নদী-নালাগুলো যেমন মাছে ভরা, তেমনি ওগুলোতে আছে বিষাক্ত আর বিষহীন নানা জাতের সাপ। আছে অজগরের মতো বিশালদেহী সাপ, আছে চন্দ্রবোড়া, কিং কোবরা, গুঁইসাপ, সামুদ্রিক সাপের মতো বিষধর সাপ। আরো আছে হাঙ্গর, কুমির, ঘড়িয়াল। সুতরাং, সুন্দরবনে গিয়ে আবার মাছের লোভে নদীতে লাফ দিয়েন না যেন!
প্রথম পর্বের লিংক https://www.porjotonia.com/?p=10047