সাকরাইন ঢাকাবাসীদের কাছে উৎসবমুখর একটি দিন
Tweet
মাসুদুল হাসান জায়েদীঃ আকাশটা মেঘে নয়, ছেয়ে যাবে ঘুড়িতে
কাটা খাওয়া কিছু ঘুড়ি জমা হবে ঝুড়িতে।
নাটাই হাতে মল্লযুদ্ধ, সুতায় সুতায় কাটাকাটি
জোর আওয়াজে বাজবে গান, ছাদে ছাদে মাতামাতি।
ঘুড়িতে ঘুড়িতে যুদ্ধ শেষে যখন সন্ধ্যাবেলা
ছাদে ছাদে শুরু হবে আগুন নিয়ে খেলা।
চারিদিকে দেখতে পাবে হাজার হাজার মানুষ
দুলকি চালে উড়ছে দেখ হরেক রঙের ফানুশ।
আঁধার আকাশে ফুটবে যখন কোটি তারকারাজি
রাতের আঁধার লুকিয়ে দিবে তুমুল আতশবাজি
ছাদে ছাদে দেখো চলে কত খানা-পিনা
তরুন-তরুণীরা করে নাচা আর গানা
সুন্দরী ললনারা করে কলরব
এভাবেই হয় মোদের সাকরাইন উৎসব
পৌষ সংক্রান্তি হয় জেনো পৌষ মাসের শেষে
উৎসবে যোগ দিতে হবে পুরান ঢাকায় এসে।
পৌষ সংক্রান্তি বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। পৌষ মাসের শেষ দিন পালন করা হয় পৌষ সংক্রান্তি, যা কথার ভেদে সাকরাইন উৎসব নামেও পরিচিত। যদিও এখন পুরানো ঢাকাতেই এই উৎসব সার্বজনীনভাবে পালন করতে দেখা যায়। এ দিন পুরনো ঢাকার দয়াগঞ্জ, মুরগীটোলা, কাগজিটোলা, গেন্ডারিয়া, বাংলাবাজার, ধূপখোলা মাঠ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সদরঘাট, কোটকাচারী এলাকার মানুষ সারাদিন ঘুড়ি ওড়ায়, খাবার এর আয়োজন করে, সন্ধ্যায় আগুন নিয়ে খেলে, ফানুস ওড়ায়, আতশবাজি ফোটায়।
বাংলা একাডেমী ও লোকনাথ পঞ্জিকার তারিখের তারতম্যের কারণে পৌষ সংক্রান্তি এখন এলাকা ভেদে দুটি তারিখে পালন করা হয়। সাধারণত ১৪ জানুয়ারি হয় কলতাবাজার, লক্ষ্মীবাজার থেকে শুরু করে সূত্রাপুর গ্যান্ডারিয়া দয়াগঞ্জ ইত্যাদি এলাকাগুলিতে আর ১৫ই জানুয়ারি শুরু হয় কোর্ট হাউজ, শাঁখারী বাজার তাঁতি বাজার ইত্যাদি এলাকায়। তবে চার বছর পর পর দুই পঞ্জিকার তারিখের ঘর একই কাটায় আটকায়।
উৎসবের আসল আকর্ষণ ঘুড়ির কাটাকাটি খেলা। মাঞ্জা দেয়া সুতা দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয় আর তাতেই সুতায় সুতা লেগে ঘুড়ি কাটা যায়। কেউ কারও ঘুড়ি কাটতে পারলেই সকলে একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে ‘ভাকাট্টা…. লোট’ বলে। এই সুতা মাঞ্জা দেওয়ার প্রস্তুতিও বিস্তর। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর থেকেই পুরানো ঢাকার ছেলেরা সুতায় মাঞ্জা দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। শিরীষ আর সাগু দানা জাল দিয়ে ঘন আঠাল তরল তৈরি করা হয়। এর সাথে মেশানো হয় পছন্দসই রং। সুতার রিল বেশ সময় নিয়ে তাতে ডুবিয়ে রাখা হয়। এরপর সুতা ধারালো করার জন্য কাঁচগুড়া করে বেটে পাউডারের মত করা হয়, যাকে বলে চুর। সব প্রস্তুতি শেষ হলে একজন সুতার রিল ধরে, আর অন্যপ্রান্তে আরেকজন লাটাইয়ে সুতা প্যাঁচাতে থাকে। মাঝে একজন চুর ধরে রাখে। আঠালো তরলের কারণে চুর সুতার গায়ে লেগে যায়। এরপর সেই সুতা রোদে শুকানো হয়। একেই বলে মাঞ্জা দেওয়া সুতা। যার মাঞ্জা যত ভাল হয় তার সুতা ততই ধারালো হয় আর সেই বেশি ঘুড়ি কাটতে পারে।
বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি ঘিরে পালিত হয় উৎসব। ভারতে এই দিনটি ‘মকর ক্রান্তি’, নেপালে ‘মাঘি’, থাইল্যান্ডে ‘সংক্রান’, লাওসে ‘পি মা লাও’, মিয়ানমারে ‘থিং ইয়ান’ ও কম্বোডিয়ায় ‘মহাসংক্রান’ নামে পরিচিত। মোঘল আমল থেকেই বাংলার এই উৎসব পালিত হলেও ঢাকার নবাবরাই ঢাকায় এই উৎসবের প্রবর্তন করেন। সেই সময় এই দিনে খাজনা আদায় শেষে নবাবরা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব আর খানাপিনার আয়োজন করতেন। কালক্রমে এটি সাধারণ মানুষের উৎসবে পরিণত হয়।
নতুন ঢাকাতে খুব বেশি দেখা না গেলেও পৌষ সংক্রান্তির সকালে পুরানো ঢাকার প্রায় সব বাড়ির ছাদে আবালবৃদ্ধবনিতা প্রায় সবাই লাটাই আর ঘুড়ি নিয়ে হাজির হয়। কোন কোন বাড়ির ছাদে মাইক বা লাউড স্পিকার দিয়ে গান বাজানো হয়। আকাশ চলে যায় ঘুড়িদের দখলে। চলতে থাকে ঘুড়ির লড়াই। আর সেইসব ঘুড়িরও আছে নামের বাহার। চশমাদার, চক্ষুদার, পঙ্খিরাজ, গাহেলদার আরও কত কি! যারা ঘুড়ি ওড়ায় না তাদেরকে দেখা যায় ছাদ জুড়ে লগগা (চিকন বাঁশের মাথায় গাছের ডাল বা বড়ই কাটা বাধা) নিয়ে ছুটোছুটি করে কাটা ঘুড়ি ধরতে ব্যস্ত। সন্ধ্যা নেমে এলে শুরু হয় আতশবাজির খেলা। কোন কোন বাড়ির ছাদ থেকে ওড়ানো হয় ফানুস। সেই সাথে চলে মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনে ফু দিয়ে আগুনের কুন্ডলী বানানোর প্রতিযোগিতা। এই উৎসবটি কেন্দ্র করে বাসায় বাসায় বেড়ানোও হয়। দূরে থাকা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা পুরানো ঢাকায় বেড়াতে আসে। ইদানিং রাতের বেলা অনেকে বাড়ির ছাদে কনসার্ট বা ডিজে পার্টিরও আয়োজন করেন। সেই সাথে থাকে নৈশভোজ। পুরানো ঢাকাবাসীদের কাছে এটি অত্যন্ত উৎসবমুখর একটি দিন। যা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একসাথে পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে।