হুমকির মুখে নারিকেল জিঞ্জিরা
Tweet
মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা নারিকেল জিনজিরা নামে পরিচিত সেন্টমার্টিনে গড়ে উঠেছে হোটেল, রিসোর্ট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঢেউ থেকে রক্ষা করতে সাগর থেকে প্রবাল পাথর তুলে এনে ঠেক দেওয়া হচ্ছে রিসোর্টের সামনের অংশ। সেন্টমার্টিনের দীর্ঘ সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে পলিথিন ব্যাগ, বোতলসহ আরও অনেক কিছু। সেন্টমার্টিনের পরিবেশ রক্ষায় সেখানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ ও রাতযাপনসহ অন্যান্য বিষয়ে সরকারের সুদৃষ্টি চেয়ে গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন কক্সবাজারের পরিবেশবাদীরা।
দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সেন্টমার্টিন আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। অক্টোবর-নভেম্বর থেকে শুরু করে মধ্য মার্চ পর্যন্ত সেখানে দলবেঁধে ঘুরতে যান পর্যটকরা। করোনার কারণে এ বছর পর্যটকের সংখ্যা কম থাকলেও প্রতিদিনই কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাচ্ছে কমপক্ষে ৭টি জাহাজ। দুই দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে নতুন যুক্ত হয়েছে আরেকটি জাহাজ। এখন প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ৫ হাজার পর্যটক সেখানে রাত যাপন করছেন। শুক্র-শনিবার এই সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
পর্যটকদের কাছে অতি আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা সেন্টমার্টিনে পরিকল্পনার কোনো ছাপ চোখে পড়েনি।
সরেজমিন দেখা গেছে, দ্বীপ জনপদ পুরো সেন্টমার্টিন জুড়েই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় নানা রকম হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ। যে যেখানে জমি পাচ্ছেন, সেখানেই তৈরি করছেন রিসোর্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যাওয়া ব্যবসায়ীরা সেখানে জমি কিনে বিনিয়োগ করছেন। প্রতিদিন এই বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়ছে। বঙ্গোপসাগরের বুকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপ জনপদ সেন্টমার্টিনের আয়তন মাত্র ৩ বর্গ মাইল বা ৭ দশমিক ৮ বর্গ কিলোমিটার। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি অনেকটা নৌকার মতো দেখতে এই দ্বীপ জনপদ কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। যেখানে প্রায় ১২ হাজার মানুষের বসবাস। স্থানীয়রা বলছেন, হোটেল রিসোর্টের সংখ্যা হবে কমপক্ষে দুই শতাধিক। বাইরের ব্যবসায়ীরা এখানে জমি কিনে হোটেল-রিসোর্ট গড়ে তুলছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে একেবারে সমুদ্র সৈকতের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রিসোর্ট, যা সৈকতের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
এসব রিসোর্টের অনেক জায়গা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে রিসোর্টের একেবারে দেয়ালে এসে জোয়ারের পানি ধাক্কা দেয়। সমুদ্র সৈকতে পা রাখলেই দেখা যায়, সৈকত থেকে কিছু দূরে বিশাল বিশাল প্রবাল জেগে উঠেছে। বিশেষ করে ভাটার সময় এসব প্রবাল পুরোটাই জেগে ওঠে। দৃষ্টিনন্দন এসব প্রবাল তুলে এনে সমুদ্রের পাড়ে গড়ে ওঠা রিসোর্টে দেয়ালে ঠেক দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। বেসরকারি হোটেল, রিসোর্টের পাশাপাশি সরকার একাধিক স্থাপনাও আছে একেবারে সৈকতের তীরে। জোয়ারের সময় পানির আঘাতে এসব স্থাপনার সীমানা দেয়ালও ভেঙে পড়েছে সৈকতে।
গত প্রায় ২ দশকে সেন্টমার্টিনে গড়ে ওঠা হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট অধিকাংশই অবৈধ। নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র বা অনুমতি। আর এসব স্থাপনা করতে গিয়ে পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি সমুদ্র সৈকতের বালি আহরণ করা হয়েছে। এ দ্বীপে আগে তালগাছসহ অনেক উঁচু গাছপালা ও কেয়াবন ছিল। এসব কেটে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। জিও টেক্সটাইল দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, এই সৈকতে প্রায়ই সমুদ্র থেকে বিশালাকৃতির কচ্ছপ উঠে আসে। অনেক সময় সেগুলো সৈকতের নানা জনজালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। সামুদ্রিক কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রাণী সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপে ডিম পাড়তে আসত। পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় এখন এ সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে পর্যটকদের অতিরিক্ত উপস্থিতি এবং রাতে সৈকতের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা হোটেল ও রিসোর্টের আলোর কারণে ডিম পাড়াসহ বিচরণের পরিবেশ না থাকায় কচ্ছপের দ্বীপে আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সৈকত ঘেঁষে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনা না থাকলে হয়তো কচ্ছপ, কোরালসহ অন্যান্য প্রাণীর জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিত না। স্থানীয়রা জানান, কোনোরকম নজরদারি না থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যাওয়া পর্যটকরা সেন্টমার্টিনের পরিবেশের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে পর্যটকরা ডাবের খোসা, চানাচুর, তেঁতুলের প্যাকেট, পানি ও পানীয়জাত দ্রব্যের বোতল যত্রতত্র ফেলে সৈকতের পরিবেশকে নোংরা করে তুলেছেন। সেন্টমার্টিনের মেইন বিচ, কোনাবাড়ি বিচ, উত্তর-পূর্ব বিচসহ বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সৈকত জুড়েই ময়লা-আবর্জনা। এগুলো ভাটার সময় গভীর সমুদ্রে চলে যায়, আবার জোয়ারের সময় তীরে চলে আসে। এসব ময়লা-আবর্জনা কাউকে পরিষ্কার করতে দেখা যায়নি।
কক্সবাজারের পরিবেশবাদীরা বলছেন, দেশের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করতে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে মাস্টারপ্ল্যান করতে করতে। অপরিকল্পিতবাবে যেসব হোটেল, রিসোর্ট গড়ে উঠেছে সেগুলো উচ্ছেদ করে পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন কত সংখ্যক পর্যটক সেন্টমার্টিনে যেতে পারবেন তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। সেন্টমার্টিনে সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ যাতে নোংরা ও নষ্ট না হয় সে জন্য প্রশাসনকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ময়লা-আবর্জনা সৈকত থেকে প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, সেন্টমার্টিনে হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁগুলোতে প্রতিনিয়ত মিষ্টি পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শৈবাল, প্রবাল, কচ্ছপ, লাল কাঁকড়া,শামুক ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী নিধন বন্ধ করতে হবে। সেন্টমার্টিন ঘুরতে আসা ট্যুরিস্ট হ্যাভেন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান বাবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমুদ্রের প্রবাল পাথর সেন্টমার্টিনের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে। ?এই প্রবাল পাথর ?উত্তোলন করে সমুদ্র তীর ভরাট করেই রিসোর্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। ?এটা পরিবেশ বিরোধী কাজ। ?এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা করে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। ?এ ছাড়া সমুদ্র তীর দখলবাজদেরও ?উচ্ছেদ করতে হবে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক দীপক শর্মা দীপু বলেন, সেন্টমার্টিনকে রক্ষায় এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে এটি যে সংকটে পড়বে তা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এখানে কেউ কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। কাঁচা টাকা কামানোর জন্য যে যেভাবে পারে হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ গড়ে তুলছে। এটি থামাতে হবে। পর্যটকদেরও আরও সচেতন হতে হবে পরিবেশের বিষয়ে। না হলে এই দ্বীপ অচিরেই সৌন্দর্য, রূপ-লাবণ্য হারাবে। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। স্বচ্ছ পানি ও চারপাশ জুড়ে প্রবাল পাথর বেষ্টিত মনোলোভা পুরো দ্বীপটিই রূপ-লাবণ্যে ভরপুর। নৈস্বর্গিক এই দ্বীপ দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এটি সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্রও। সেন্টমার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়ি-জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির জীববৈত্র্যির বসবাস ছিল। এসব প্রাণীর অনেকটাই এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন সময়ে মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রাণী।