সুন্দরবনের জন্য ভালোবাসা
Tweet
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্ধশত বছর আগে আমাদের প্রাণপ্রিয় যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে, তার এক কোণে, প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর ধরে বসে আছে বিশ্বের বৃহত্তম মোহনাবন বা বাদাবন—নাম যার সুন্দরবন। এটা আমদের গর্ব। একে বিশ্বের প্রাকৃতিকভাবে বিরাজমান মহা আশ্চর্যের একটি বললেও বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না।
প্রসিদ্ধ চৈনিক পর্যটক-পরিব্রাজক ও বৌদ্ধ ধর্মযাজক হিউয়েন সাং ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ সাল পর্যন্ত ধর্মপ্রচার এবং পরিব্রজনের জন্য অবস্থান করেন পুরোনো ভারতবর্ষে। সে সময় সুন্দরবনকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘সাগরসীমানায় অবস্থিত ফসলি নিম্নভূমি’ হিসেবে। সম্ভবত তিনি ৬৪০ সালের দিকে বর্তমান বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থান করেন। এর কাছাকাছি কোনো এক সময় তিনি সম্ভবত সুন্দরবন দর্শন করেছেন ধরে নেওয়া যেতে পারে।
অর্থাৎ ভারতবর্ষে আগমনকারী পরিব্রাজক ও শাসক, যাঁদের কাছে সুন্দরবনের মতো একটি বিশেষ বনের সংবাদ পৌঁছেছে। এবং তাঁরা এ বনের খবর নিয়েছেন বা এটি দর্শনের চেষ্টা করেছেন। মোগল আমল থেকে এ অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টি পড়ে সুন্দরবনের ওপর। জীবনধারণের জন্য অনেকে বাধ্য হন দেশের এ দুর্গম এলাকার আশপাশে বসতি করার জন্য। জীবনযুদ্ধে তাঁরা জয়ী হয়েছেন এবং বারবার পরাভূত হয়েছে সুন্দরবনের পরাক্রম।
যুগ যুগ ধরে সুন্দরবন লাখো মানুষের জীবন–জীবিকার উৎসস্থলই রয়ে যায়নি, সে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা চাঙা রেখেছে। হাজার মানুষকে রক্ষা করেছে গোর্কি, সিডর, আইলার মতো ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল থেকে।
কেবল উপমহাদেশেরই–বা বলি কেন, বিশ্বের কোথাও আমাদের সুন্দরবনের মাপের ও প্রকৃতির কোনো বন নেই। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বন, ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া ও মধ্য আফ্রিকার চিরহরিৎ ও মিশ্র চিরসবুজ বনের সক্ষমতা রাখে সুন্দরবন। আর এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সব গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন এবং আচ্ছাদিত বন বা গ্যালারি ফরেস্ট থেকে বেশ ভিন্নতর।
প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী, সুন্দরবন সমুদ্রমুখ বনের পর্যায়ে পড়ে। মূলত নদীর মোহনায় মিঠাপানির স্রোত যখন সাগরের লোনাপানিতে মেলে, তখন সেখানে পানির গতিবেগের হেরফের ও তা ঘূর্ণনের ফলে নদীবাহিত হয়ে আসা পলি ও বালু জমে গড়ে ওঠে মাটি। এ ভূমি দারুণ উর্বরা। ফলে এতে বেড়ে ওঠে সুন্দরবনের মতো সব বাদাবন। বিশ্বের বহু উপকূলীয় এলাকায় এমন বন দেখা গেলেও সেখানে সুন্দরবনের মতো এমন উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাহার নেই।
এখানে আছে সুন্দরীগাছসহ ৩০০-৩৫০ প্রজাতির গাছ, বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর, তিন প্রজাতির গন্ডার, বুনো মোষ, বারশিঙ্গা বা জলাভূমির হরিণ, মায়া হরিণ, বনবিড়াল ও গন্ধগোকুল, শিয়াল-বেজির দল, লোনাপানির কুমির, কুমিরসদৃশ কালা গদি বা রিং লিজার্ড বা মনিটর, বিষধর রাজগোখরা বা কিং কোবরাসহ আরও অসংখ্য প্রজাতির গোখরা, শাকিনী, বাঁশবোরসহ বহু প্রজাতির সাপ ও সরীসৃপ, প্রায় তিন শ পাখির প্রজাতি, অনেক ব্যাঙ, মাছ ও চিংড়ি-কাঁকড়াসহ বহু জানা-অজানা অমেরুদণ্ডী প্রাণী।
আমাদের সুন্দরবনের কোনো কোনো এলাকায় প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো বসতির নমুনা মিলেছে। নলিয়ান রেঞ্জের আদাচাই নামের বনখণ্ডে ইট, সুরকি এবং চুন দিয়ে বানানো পুরোনো দালান দেখেছি। এটা খুবই বিরল। সুন্দরবনের চারপাশজুড়ে জনবসতি শুরু হয়েছে মোগল আমলের আগে। এ জনবসতি বাড়ছে তো বাড়ছেই। কিন্তু সৌভাগ্য হলো বাংলাদেশে সুন্দরবনের ছয় হাজার বর্গকিলোমিটারের বাইরে এ জনবসতির অবস্থান।
ঘটা করে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সুন্দরবনে বন কাটা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে, ১৮৫০ সালের পরে। তথাকথিত বন সংরক্ষণের নামে সীমিতভাবে সাংবৎসরিক বন কাটার ঘটা চলে ব্রিটিশ ভারতীয়, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এর ফলে সুন্দরবনে এখন ৫০ বছরের পুরোনো সুস্থ একটি সুন্দরী, গেওয়া, পশুর প্রভৃতি কাঠের গুণসম্পন্ন জীবিত গাছের নমুনা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। তবে সুন্দরবনে ‘চিহ্নিত করে গাছ কাটা বা সিলেকশন লগিং’ ব্যবস্থাপনার কারণে এখানে বেশির ভাগ প্রজাতির গাছ রয়ে গেছে। কিন্তু দামি ও বড় গাছের কোনো নমুনা হারিয়ে গেছে। সরকারিভাবে গাছ কাটা আইনের বাইরেও কাঠ চুরি ও বনভূমি দখল দেশের সব বনে যেন একটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যাধির মতো।
পুরোনো আমলে মানুষের বসতি গড়ে ওঠা, কাঠ আহরণ, বন ধ্বংস এবং বৈশ্বিক আবহাওয়ার বৈরিতার কারণে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি এবং দীর্ঘকালেও যে ক্ষতি পোষানো যাবে না, তা হচ্ছে সুন্দরবন এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা। ইদানীং সরকারি পর্যায়ে পরিবেশবান্ধব নয় এমন প্রকল্প, যেমন সুন্দরবনের কাছে রামপাল কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরবন ঘেঁষে নদীর তীরে সাইলো বসানো, বনের নদী দিয়ে জ্বালানি বা রাসায়নিক বহনকারী জলযান বা জাহাজ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ না করা, মাত্রাতিরিক্ত পর্যটনশিল্প গড়ে ওঠা ও বনের ভেতরে বা বনভূমিতে পরিবেশ অবান্ধব পর্যটনকেন্দ্র বানানোর কারণে সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়েছে।
প্রতিদিন শত শত ডিজেল ও পেট্রলচালিত পর্যটক ও মাছ ধরা নৌযান চলাচল, মাছের বা চিংড়ি-কাঁকড়ার পোনা আহরণ, বিষ ঢেলে মাছ মারা, চোরাইভাবে বাঘ ও হরিণ মারা, ইত্যাদি সুন্দরবনের গতিশীল জীবনযাপনের জন্য বাধাস্বরূপ।
বিশ্ব ভালোবাসার দিনে আমাদের প্রাণপ্রিয় সুন্দরবনের কথা খুব মনে পড়ছে। আমরা শুধু আমাদের ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের পশুপাখি, বনবাদাড়, জলাভূমি, নদ–নদী, খাল–বিল, বিল-হাওর-বাঁওড়, অভয়ারণ্য, সাগরসৈকত, বেলাভূমি, দ্বীপাঞ্চল, গভীর সাগর, পাহাড়ি ঝরনা, বৃক্ষকুল আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ তাদের দিকে একটু ভালোবাসা মেশানো শুভদৃষ্টি ফেরালে কি হয় না।
চলুন, প্রকৃতির রীতিনীতি মেনে প্রাকৃতিক লীলাভূমি সুন্দরবন, নারিকেল জিনজিরা বা সেন্ট মার্টিন, বগা লেক, নীলসাগর, টাঙ্গুয়ার হাওর, বাইক্কা বিল, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, পাবলাখালী, সাঙ্গু-মাতামুহুরী প্রভৃতি দেখে আসি। আর ফিরতি পথে বয়ে আনি বুকভরা অক্সিজেন এবং প্রাণভরা ভুলে না যাওয়ার মতো অজস্র স্মৃতি।
রেজা খান: দুবাই সাফারির প্রধান বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ