২৩ বছর আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঘটে যাওয়া সেই মর্মান্তিক দিন ছিলো ২৩শে ফেব্রুয়ারী
Tweet
২৩ ফ্রেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ক্রিকেটে ব্যাথাতুর দিন। একটা সময় ছিল এদেশের ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে ঘরোয়া লিগই ছিল আনন্দ বিনোদনের খোরাক। প্রিমিয়ার লিগ, রেলিগেশন লিগের পয়েন্ট টেবিল নিয়ে পরেরদিন পত্রিকায় খুঁটিয়ে পড়তেন প্রিয় দল পিছিওয়ে গেল না তো? আবাহনী-মোহামেডানের সেই লড়াই আর নেই অথচ এদেশের ঘরোয়া লিগে এই দুই দলের নাম ছিল উজ্জ্বল, সেই দ্বৈরথ ছিল উত্তেজনার, উপভোগ্য। ফুটবলে ফরাশগঞ্জ কিংবা মুক্তিযোদ্ধা, ক্রিকেটে কলাবাগান অথবা হকিতে ইয়াং মেরিনার বা উষা ক্রীড়াচক্র বাগড়া দিতো দুই শীর্ষ দলকে। না এখন সেসব নেই।
১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, ফাগুন যেমন রঙ ছড়াচ্ছিল, শীত কেটে রোদ যখন উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করেছিল ঠিক এমনই দিনে উত্তাপের ম্যাচে মাঠে নামে আবাহনী মোহামেডান। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম তারকা ছিলেন সেসময় রমন লাম্বা। ভারতের এই ক্রিকেটার ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। প্রত্যেক মৌসুমে নিয়ম করে আবাহনীতে খেলতে আসতেন। এভাবে লাম্বা হয়ে উঠেছিলেন আবাহনীর ‘ঘরের ছেলে’। কে জানতো আবাহনী তার ঘরের ছেলেকে চিরতরে এভাবে হারাতে যাচ্ছে। এই ম্যাচেই মৃত্যু যে তার জন্য ওঁত পেতে রয়েছে তা কি অদৌ জানতে পেরেছিলেন?
রমন লাম্বার মৃত্যু সেদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি রমন লাম্বার মৃত্যু হয়। আবাহনী ওই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে খুব সম্ভবত ১৫৭ রান তুলেছিল। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য জয় চাই আবাহনীর। মোহামেডানের হয়ে তখন ব্যাট করছিলেন মেহরাব হোসেন অপি। নন স্ট্রাইক এন্ডে ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। নিয়মিত অধিনায়ক আকরাম খান তখন মাঠের বাইরে। তাঁর হয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট৷
এদিন মোহামেডানকে আরও চেপে ধরতেই পাইলট বল তুলে দিয়েছিলেন বাঁহাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ খান জেমের হাতে। জেমের ওভারে বারবার শর্ট মিড উইকেট থেকে হেঁটে হেঁটে স্লিপে আসছিলেন রমন লাম্বা। অপির কাছে গিয়ে দু-চার কথা শুনিয়েও যাচ্ছিলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সাইফুল্লাহ খান জেম বলছিলেন, ‘ওই ওভারটি ছিল সার্কেলের শেষ ওভার। শেষ তিন বলে যেন রান না হয় সে জন্য আমি রমন লাম্বাকে শট মিড উইকেটে থাকতে বলেছি। কিন্তু ও বারবার স্লিপে চলে আসছিল। আমি ওকে বললাম, ‘আমার লাস্ট বল তুমি স্লিপে এসো না। চার হয়ে গেলে ওদের (মোহামেডান) রান বেশি হয়ে যাবে। তুমি শট মিড উইকেটেই থাকো।’ কিন্তু ও হাঁটতে হাঁটতে এসে অপিকে স্লেজিং করছিল এবং ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়াচ্ছিল হেলমেট ছাড়া। আমি বারবার নিষেধ করেছি। হেলমেট নিতে অনুরোধ করেছি, কিন্তু ও শোনেনি। শেষ অবধি বলই করে ফেলেছি। অপির পুল শট রমন লাম্বার মাথায় লেগে ওপরে উঠে যাওয়ার পর পাইলট ওই ক্যাচটা ধরে। সে সময় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলা হতো। স্ট্রেচারও থাকত না…ওকে হাঁটতে হাঁটতে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া হলো৷ হেঁটে যাওয়ার সময় মোটামুটি কথা বলতে পারছিল। ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পর আর কথা বলেনি।”
৩৮ বছরের রমন লাম্বা মাঠে জ্ঞান হারাননি। কিন্তু ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পর তাঁর সহ্যক্ষমতার সীমা পেরিয়ে যায়। বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যান রমন লাম্বা। সেই যে সংজ্ঞা হারালেন আর ফিরলেন না। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তিনদিন থমকে ছিলেন রমন লাম্বা। দেশ সেরা সব চিকিৎসকদের চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে, ২৩ ফেব্রুয়ারি।
ভারতের হয়ে আশির দশকে অভিষেক হয় রমন লাম্বার৷ ৪ টেস্ট আর ৩২ ওয়ানডেতে থেমে গিয়েছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার৷ বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে ঘরোয়া লিগ খেলেছেন। খেলতে খেলতেই প্রেম হয়ে যায় আইরিশ তরুণী কিমের সঙ্গে। এই যে রমন লাম্বা মাঠে নেমে হেলমেট পড়তে চাইতেন না সেটা ওই কিমের জন্যই।

সাইফুল্লাহ খান জেম বলেন, আমি ১৩ দিনের মতো একটা ঘরে বসেছিলাম। খারাপ লাগার জন্যে আমার মাথায় খানিকটা সমস্যা হয়েছিল। রমন লাম্বার স্ত্রী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, ‘তুমি এত দুশ্চিন্তা কোরো না।’
ওর স্ত্রী যখন বাচ্চা নিয়ে আসতেন, তখন দেখেছি তাদের সম্পর্ক। সারাক্ষণ রমন লাম্বার কানে কি যেন গুনগুন করে বলে যাচ্ছিল। এটা দেখে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। আমাকে কিম বলেছিলেন, ‘তুমি এটা নিয়ে কোনো অনুশোচনায় ভুগো না। আমাকে দেখার জন্য আমার হাজবেন্ড হেলমেট পড়তেন না। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।’
ভারতের হয়ে খেলার সময়ও হেলমেট পড়তেন না রমন লাম্বা। তাহলে তো কিম দেখতে পাবে না! যে অভ্যাসটা তাঁর রয়েই গিয়েছিল। শুধু ক্রিকেট নয় প্রেমেরও সংজ্ঞা নতুন করে লিখে গিয়েছেন রমন লাম্বা। কিমকে নিয়ে দিল্লিতে সুখের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। মোহামেডান ম্যাচে নামার আগে সাইফুল্লাহ খান জেমের কাছে দিল্লির সেই ঘরের কথা শুনিয়েছেন। নতুন বাড়িতে কিমকে নিয়ে থাকবেন৷
সাইফুল্লাহ খান জেম স্মৃতি ঘেঁটে বলছিলেন, ‘ও প্রচণ্ড রসিক ছিল। মাঠে ঠিক তার উল্টো। ভীষণরকম প্রফেশনাল। ও খালি জিততেই চাইত৷ হার পছন্দ করত না। ওর মানসিকতাই ছিল ‘আমি হারব না।’ জয়ের নেশা ছিল। প্র্যাকটিসে বলত কাল সেঞ্চুরি করব, তাই করতোও। ৩০-৪০ হলেই আমরা ধরে নিতাম ও ১০০ মেরে দেবে।” এই জন্যই বোধহয় রমন লাম্বা বন্ধুদের সঙ্গে রসিকতা করে বলতেন, ‘আমি ঢাকার ডন।’
অর্জুনা রানাতুঙ্গারা গর্ব করে বলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে ঢাকায় এসে তাঁরা ক্লাব ক্রিকেট খেলেছিলেন বলে বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়েছে। এমন দাবি করার প্রথম অধিকার কিন্তু রমন লাম্বার। তিনিই এ দেশের প্রথম বিদেশি মহাতারকা। রাশি রাশি রান করে, দলকে ট্রফি জিতিয়ে তারকার সম্মান যেমন ধরে রাখতে পেরেছিলেন, তেমনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন একটা হাওয়াও বইয়ে দিয়েছিলেন। আটত্রিশেও ঢাকার মাঠে এসেছিলেন তারুণ্যদীপ্ত ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন হয়ে।