বৃদ্ধাশ্রম নয় পরিবারই হোক বর্ষীয়ানদের আমৃত্যু আবাস
Tweet
পুরোনো লাল রঙের প্রকান্ড একটা লোহার গেইট। গেইট পেরুলেই শ্যাওলা পড়া হেরিংবোন পথ। পথের ধারে থরে থরে জমে আছে শুকনো পাতা। যেন পায়ের নিচে পড়লেই মর্মর করে কেঁদে উঠবে কোনো নিঃসঙ্গ মায়ের অন্তর। শুনশান-নিরব আর রৌদ্রছায়া মাখানো এই রাস্তার দু’ধারে সারি সারি আমগাছ, লিচুগাছ, কাঁঠালগাছ। একটু দূরে ডালিমগাছ, গাছে গাছে নাম জানা-অজানা কতো পাখির কিচিরমিচির। এই সরু রাস্তা ধরে আরও একটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে একতলা বিশিষ্ট একটা আধাপাকা বাড়ি। বাড়ির দক্ষিণ বারান্দা ঘেঁষে বেশ কয়েকটা বকুলগাছ; চারপাশটা বকুল ফুলের ঘ্রাণে ম-ম করছে। উত্তরের দিকে বেশ বড় একটা কুমড়োর মাচা, শত শত কুমড়োর ফুল যেন হলুদ রঙে ফুটে আছে অব্যক্ত বেদনা নিয়ে আকুল হয়ে। পাশ দিয়ে হেঁটে আসছেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ একজন বৃদ্ধা। বিগত সাত বছরে যাকে একবারের জন্যও দেখতে আসেননি তাঁর নাড়িছেঁড়া ধন ছেলেমেয়ে কিম্বা কলিজার টুকরা নাতি–নাতনি কেউই। তবুও অগ্রহায়ণ মাসের আদুরে বিকেলবেলায় প্রতিদিন সূর্য ডোবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত পথচেয়ে অপেক্ষা করেন, এই বুঝি সেদিনের ছোট্ট খোকা তাকে নিতে আসবেন। জীবনের এই নিদানকালে হয়তো বুঝে গেছেন এই অপেক্ষা অর্থহীন, এর কোনো শেষ নেই। অপেক্ষার প্রহর অবসান হলে ব্যাথার কালো পাহাড় বুকে নিয়েই হয়তো মাগরিবের ওয়াক্তে জায়নামাজে বসে দু’হাত তোলেন সন্তানদের মঙ্গল কামনায়। গাঢ় নিঃশ্বাস গোপন করে হয়তো এতটুকু আশা নিয়ে জীবন প্রদীপ নিবু নিবু করে জ্বলে নাতি-নাতনীদের সাথে মাখামাখি না হোক মৃত্যুর পর অন্তত নিজের লাশটা যেন স্বামীর ভিটায় দাফন হয় হে দয়াময়।
বৃদ্ধাশ্রমের এই ভয়াবহ বাস্তবতা আমাদের সংস্কৃতি নয়। গাঢ়তর পারিবারিক বন্ধন ও আবেগপূর্ণ জীবনবোধ আমাদের ঐতিহ্য। দৈনন্দিন ব্যস্ততা আর রুটি রুজির করালগ্রাসে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ। বর্ষীয়ানদেন দূরে রেখে স্বামী-স্ত্রী আর এলসেসিয়ান নিয়ে পশ্চিমের যে সংসার উন্মাদনা তা আমাদের নয়। দক্ষিণ এশিয়ার পারিবারিক সংস্কৃতি বর্ষীয়ানদের ঘিরে, বর্ষীয়ানদের নিয়ে। বিলুপ্তপ্রায় এই দক্ষিণ এশীয় মূল্যবোধ পুনঃজাগরণের উদ্দেশ্য নিয়েই বাতিঘরের জন্ম।
“বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বর্ষীয়ানদের আমৃত্যু আবাস” (ব্যতিক্রম বাদে), এই তত্বে বিশ্বাসী মাহবুবা আখতার কবিতা ও হেলেনা কামাল আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর এবং বাংলাদেশে নিউটন হকসহ আরও কয়েকজন “বাতিঘর”কে একটি সাংগঠনিক রুপ দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন ২০১৬ সাল থেকে।
বর্ষীয়ানদের জন্য বর্ষীয়ানদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন “বাতিঘর” তিনটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে –
১। বর্ষীয়ান জনগোষ্ঠীর (মুরুব্বী) জন্য দক্ষিন এশীয় মুল্যবোধ পুনঃজাগরণ করা।
২। পরিবারে এবং সমাজে বর্ষীয়ান জনগোষ্ঠীর জন্য পারিবারিক সন্মান, মর্যাদা এবং আন্তরিক সেবা-যত্নের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা।
৩। বর্ষীয়ান জনগোষ্ঠীর শারিরীক ও মানসিক স্বাস্হ্য সুরক্ষার জন্য তাঁদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করা।
উপরোক্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য বাতিঘর একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরী করছে। যাতে করে উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত তথা সকল শ্রেণীর বর্ষীয়ান নাগরিকদেরকেই বাতিঘরের সুবিধাভোগীর আওতায় নিয়ে আসা যায়।
বর্ষীয়ান জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন জরুরী। বৃদ্ধাশ্রম নামক আতংক বর্ষীয়ানদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের অন্যতম কারন বলে মনে করে বাতিঘর। বৃদ্ধাশ্রম নয় পরিবারই হবে বর্ষীয়ানদের আমৃত্যু আবাস এই সামাজিক দাবি বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাতিঘর।
সমৃদ্ধশালী অতীতের মতোই বর্তমান ও ভবিষ্যতে বর্ষীয়ান সদস্যসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে পারস্পরিক সম্মান, মর্যাদা, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন জীবন উপভোগ করার পরিবেশ ফিরে আসবে। এই অস্থির সমাজে স্থিতিশীল জীবন যাত্রার রোল মডেল হবে বাতিঘর এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট মাহবুবা আখতার কবিতা।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে পরিবারে এবং সমাজে উপেক্ষিত বেশকিছু বর্ষীয়ান নাগরিক বাতিঘরকে একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পেয়ে তারা আনন্দিত। এই প্ল্যাটফর্মে তারা কথা বলতে পারছেন, মতামত জ্ঞাপন করতে পারছেন, ইচ্ছামতো হাসতে পারছেন, এই ছোটছোট কিন্তু অমূল্য আনন্দটুকু পেয়েই তাদের বিপর্যস্ত মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন হচ্ছে, পরিবারে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীদের কাছে মর্যাদা পাচ্ছেন।
বাতিঘর সকল বর্ষীয়ানদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিচরণের পাতা, পারস্পরিক মনের ভাব আদান-প্রদানের পাতা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও প্রতিভা প্রকাশের পাতা, আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবার পাতা। সর্বোপরি বাতিঘর হয়ে উঠুক বৈশ্বিক নম্রতা চর্চার এক অনবদ্য মানবিক পাতা।