রন্ধনশালার আলোকিত শিল্পী রুপা
Tweet
কিশোরগঞ্জ জেলায় নানা বাড়িতে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জাকিয়া জাহান রুপা১৯৮১ সালে ১২ আগষ্ট। পৈত্রিক নিবাস ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার জলইগাতী গ্রামে হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা নানা বাড়িতে। শৈশবের সোনালী দিনগুলি কেটেছে ছোট্টছোট্ট হাড়ি-পাতিল আর গাছের লতা পাতা দিয়ে চড়ুইভাতি খেলে। আরেকটু বড় হ’লে খেলাধুলার সীমানা বাড়ির উঠোন থেকে বিস্তৃত হয় পুকুরপাড় অবধি। বন্ধুরা মিলে একমুঠো করে চাল দেওয়া, পুকুর থেকে মাছ ধরা, ইট দিয়ে চুলা বানানো, খড় দিয়ে ঘর তৈরি করে চড়ুইভাতি খাওয়া যেন ছিল রুপার নিত্যকার আয়োজন। মায়ের চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে নানীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রুপা উপভোগ করেছেন শৈশব আর কৈশোরের ষোল আনা।
তিন ভাই বোনের মধ্যে রুপা সবার বড়। বাবা মোহাম্মদ শামস্ উদ্দিন ছিলেন সমাজ সেবা অধিদপ্তরের প্রথম শ্রেনীর একজন কর্মকতা। মা ফিরোজা আক্তার একজন গৃহিনী। বাবার সরকারি চাকুরীর সুবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখার সৌভাগ্য পেয়েছিলেন। রুপার জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলায়। তিনি ১৯৯৭ সালে ভৈরব এমপি পাইলট গার্লস হাই স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৯ সালে রফিকুল ইসলাম মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। স্কুল ও কলেজে পড়াকালীন সময়ে বিভিন্ন রকম খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে গালর্স গাইড ও স্কাউটের সাথেও জড়িত থেকে নিজেকে গড়ে তুলেছেন বুদ্ধিদীপ্ত ও চৌকস করে।
২০০৬ সালে মাস্টার্স পাশের পর ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডে কিছুদিন চাকরী করেছেন। এরপর পরিবারিক আয়োজনে প্রকৌশলী মুহাম্মদ জাকিরুল ইসলাম খানের সাথে বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। সরকারী গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানী লিমিটেড (জিটিসিএল) এর ঊর্ধ্বতন কর্মকতা স্বামীর সাথে টাংগাইলে বসবাসকালে তিনি ঢাকার ব্র্যাক ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেন। অল্প দিনের মধ্যেই স্থানীয় লিটল স্টার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ২০০৭ সালে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত সেখানে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্কুলে চাকরিকালীন নিজের যোগ্যতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখে অর্জন করেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকের সম্মাননা। বর্তমানে স্কুলটির নাম বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ , ভূয়াপুর , টাংগাইল। স্কুলের চাকরিটিও ছেড়ে দিয়ে এরপর ঢাকায় চলে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন মোহাম্মদপুর। সংসার জীবনে রুপা এক মেয়ে ও এক ছেলের জননী।
বর্তমানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরারস এসোসিয়েশন (বিটিইএ)’র কো- চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন রুপা। দুরন্ত শৈশব পেরিয়ে জীবনের এতগুলো বছরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কাউট, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ব্যাংকে চাকরি, স্কুলে শিক্ষকতা কতো কিছুতেই সফল রুপা, তবুও যেন নিজের পেশাগত জীবন নিয়ে তৃপ্ত হতে পারছিলেন না। একাধিক সফল পেশা ছেড়ে তৃপ্তির অন্বেষণ করতে যেয়ে একদিন তিনি অনুভব করলেন মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনার উষ্ণতা। সেই উষ্ণতা টুকুর প্রতি নিবেদিত হয়েই আর কোনোরকম নতুন চিন্তাভাবনা ছাড়াই তিনি শুরু করলেন পথচলা। শৈশব-কৈশরের সেই পুরাতন ভালো লাগাটাই রন্ধন শিল্পী হয়ে ওঠার টার্নিং পয়েন্ট। অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে দেখলেন, মা কখনই তাকে বাহিরের খাবার খেতে দিতেন না। সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তায় চিপস থেকে শুরু করে প্রায় সব খাবারেই নিজের হাতে তৈরী করে খাওয়াতেন। আরও মনে পড়ে গেল আনুষ্ঠানিক রান্নার হাতে খড়িতো তিনি মায়ের হাতেই পেয়েছেন কৈশোরে। উপরন্তু এসএসসিতে ব্যবহারিক ক্লাসের সময় শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা শিরিন আক্তারের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলেন পোলাও আর রোস্ট রান্না করার পদ্ধতি। এরকম টুকরো টুকরো স্মৃতি হাতড়ে রুপার আত্মবিশ্বাসের পারদ তরতর করে উপরে উঠছে। মনে পড়ছে মাঝেমধ্যে তিনি যখন রান্না করতেন সেই খাবার খেয়েতো সবাই খুব প্রশংসা করতেন। কলেজে পড়াকালীন নিতান্তই কৌতুহল বশত সংগ্রহ করেছিলেন সিদ্দিকা কবীরের রেসিপির বই। এছাড়াও টিভিতে সিদ্দিকা কবীর, কেকা ফেরদৌসী, লবী রহমান, রহিমা আক্তার রীতা, আলপনা হাবীব ও কল্পনা রহমান প্রমুখদের রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো তিনি আগ্রহভরে দেখতেন। হঠাৎ ফিরে পাওয়া রুপার এই আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া এসে দোলা দিলো মা, শাশুড়ী ও খালাদের কাছে শেখা ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন রকম খাবার, পিঠাপুলি ও বিভিন্ন স্বাদের আচারগুলো।
খৃষ্টীয় ২০১১ সাল সাল। জাকিয়া জাহান রুপার রন্ধন শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প এখান থেকেই শুরু। আরা কালেকশন্স’র হুসনে আরা আপার কাছে কেক বানানো শেখার পর চেপে বসলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রান্না শেখার নেশা। ২০১৩ সালে পর্যটন করপোরেশন থেকে বেকারী এন্ড পেস্ট্রি প্রোডাকশন সাটিফিকেট কোর্স করেন এবং “হোটেল অবকাশ”ইন্টার্নি করেন। ২০১৬ সালে লিপি’স ইউফরিয়া থেকে ফুড এন্ড বেভারেজ প্রোডাকশনের উপর শর্ট কোর্স করেন। রান্না শেখার প্রতি তুমুল আগ্রহ দেখে স্বামী প্রকৌশলী মুহাম্মদ জাকিরুল ইসলাম খানের পরামর্শ দেন টনি খান কালিনারী ইনস্টিটিউট এন্ড হোটেল ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হতে। ২০১৬ সালে এখান থেকে এক বছরের শেফ কোর্স করেন ফুড এন্ড বেভারেজ প্রোডাকশনের উপর। ২০১৬ সালেই বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার অধীনে সাটিফিকেট ইন ন্যাশনাল স্কিল ষ্ট্যাণ্ডার্ড বেসিক কোর্স কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। রান্না বিষয়ক উচ্চতর জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে তিনি একে একে ২০১৬ সালে NTVQF LEVEL- 1 ও ২০১৭ সালে NTVQF LEVEL-2 অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন ইউসেফ বাংলাদেশ থেকে। এরপর ২০১৯ সালে NTVQF LEVEL- 4 (অনলি এসেসর পার্ট) ইউসেফ বাংলাদেশ থেকে কম্পিটেন্ট হন।
রন্ধনশিল্পের প্রতি শতভাগ নিবেদিত পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী রুপা ইতোমধ্যে চ্যানেল আই সহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে রান্না বিষয়ক বেশকিছু অনুষ্ঠান করছেন। দৈনিক ও সাপ্তাহিক অনেক পত্র পত্রিকায় নিয়মিত রেসিপি লিখছেন। উইমেন্স কালিনারী এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সদস্য রুপা কারিগরি শিক্ষা র্বোডের একজন এসেসর, স্বনামধন্য শেফ, ও প্রতিষ্ঠিত রন্ধনশিল্পী। RUPA’S KITCHEN এর মাধ্যমে অনলাইন ও অফলাইনে খাবারের অর্ডার নিয়ে সরবরাহ করছেন। গায়ে হলুদ ও জন্মদিনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুড কার্ভিং করছেন। ব্যস্ততার মধ্যেই অফলাইনে বাসায় কুকিং ও বেকিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন রান্নার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার অর্জন করেছেন। রন্ধনশিল্পে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সর্বশেষ ২০২১ সালে ১৩ মার্চ “ইউনাইটেড মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটস” এর পক্ষ থেকে কীর্তিমান নারী -২০২১ সম্মাননা অর্জন করেন। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তিনি Rupa’s kitchen নামক নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল থেকে নিয়মিত উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন।